শীতকাল মানেই বিয়েবাড়ি— পেটপুজো, আনন্দ, উৎসব। শীতে নাকি খাবার হজম হয় ভাল। যতখুশি খাও চিন্তা নেই। কিন্তু জানেন কি শীতকালেই রয়েছে বড় বিপদের ঝুঁকি। ঠান্ডার কারণে এই ঋতুতে বহু অসুখবিসুখের বাড়বাড়ন্ত হয়। বেড়ে যায় বেশকিছু বিপজ্জনক রোগের ঝুঁকিও। এর পিছনে রয়েছে গুরুতর কিছু কারণ। তাই এই সময় প্রয়োজন জীবনযাত্রার বদলের, সতর্কতার এবং সচেতনতার।
তথ্য অনুযায়ী শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের রোগীর সংখ্যা বছরের অন্যন্য সময় যা থাকে তার চেয়ে ৩০% থেকে ৫০% বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে শীতের প্রভাবে রক্তচাপের পরিমাণ ১২ থেকে ১৮ মিলিমিটার বেড়ে যেতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা অনুযায়ী শীতকালে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি কমলে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার বেড়ে যায় শতকরা ৬ ভাগ।
ইস্কেমিক স্ট্রোকে হাসপাতালে ভর্তি ১ লাখ ৭২ হাজার রোগীকে নিয়ে একটা গবেষণা করা হয় তাতে দেখা গেছে শীতের দিনে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। জার্মানিতে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ১১ শতাংশ বাড়ে। আর যাঁদের স্ট্রোকের সঙ্গে অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর আছে তাঁদের এ-হার আরও বেশি। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে তাপমাত্রা কমার কারণে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার বেশি, বিশেষ করে ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের।
আরও পড়ুন-নিহতদের পরিবারের পাশে তৃণমূল নেতৃত্ব
কেন শীতে বাড়ে ঝুঁকি
শীতের প্রভাবে রক্তনালিগুলি সংকুচিত হয় ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। আর এই উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। তাপমাত্রা কমার কারণে শরীরে এড্রেনালিন নিঃসরণ হয়। এটি রক্তনালিকে সঙ্কুচিত করে। এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
শীতের কারণে রক্তের উপাদানেও অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। রক্ত জমাট বাঁধার জন্য দায়ী যেগুলো অর্থাৎ প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা, লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকা, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ফলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতাও বেড়ে যায় প্রায় শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত। কাজেই খুব স্বাভাবিক কারণেই হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রবণতা অনেক গুণে বৃদ্ধি পায়।
গবেষণায় দেখা গেছে খুব বেশি শীতের প্রকোপে ইরেগুলার হার্টবিট বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন শুরু হতে পারে। এর ফলে যে কোনও বিপদ ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ যেমন ফ্লু হলে এই সংক্রমণগুলি একাধিক অঙ্গে প্রদাহ এবং রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে ফলে ট্রিগার করতেই পারে।
শীতকালে মানসিক অবসাদ বাড়ে। স্ট্রেসের মাত্রা বাড়ে। মনের ওপর চাপ থেকেও হতে পারে স্ট্রোক।
কী করে বুঝবেন বিপদ
দু’ধরনের স্ট্রোক (প্যারালাইসিস) হয়ে থাকে। প্রথম ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ভিতর রক্তনালিতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, একে প্যারালাইসিস অ্যাটাক বলে।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, মস্তিষ্কের রক্তনালি ফেটে যায়, যাকে ব্রেন হেমারেজ বলে। দুটোই শীতের সময় হতে পারে।
তবে হৃদরোগ এবং স্ট্রোক দুটো ক্ষেত্রে উপসর্গ আলাদা। এগুলো হলে ব্যক্তি আগে থেকে বুঝতে পারেন তাই তখনই দ্রুত ব্যবস্থা নিন। হৃদরোগে বুকে মারাত্মক ব্যথা বা চাপধরা ভাব অনুভূত হয়। হঠাৎ করেই বমি হয়, খুব ঘাম হতে পারে।
অন্যদিকে স্ট্রোক হলে মাথা ভারী হয়ে যায়, প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, মুখ এক দিকে বেঁকে যেতে পারে, কথা জড়িয়ে যেতে পারে। অনেক সময় চোখে দেখার সমস্যা, শরীরের ব্যালান্স ঠিক রাখতে না পারার সমস্যা হয়, দুর্বল লাগে, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন-আজ সবং কেন্দ্রের ভার্চুয়াল উদ্বোধন মুখ্যমন্ত্রীর, হবে ডেবরাতেও
সতর্ক হন
নিয়ন্ত্রণে রাখুন উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস। ছ-মাস অন্তর ডায়াবেটিস এবং সপ্তাহান্তে একবার প্রেশার মেপে নিন। অনিয়ন্ত্রিত মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এতে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমবে।
অনেকেই সারা বছর ভোর ৫টায় উঠে স্নান করতে যান। এতে স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষত শীতের দিনে, সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসার পরে, হালকা গরম জলে স্নান করা উচিত। ঠান্ডা জলে স্নান করলে পরিণতি খারাপ হতে পারে। অনেক সময়ই দেখা যায় ভোরে স্নান করতে গিয়ে স্নানঘরেই স্ট্রোকের শিকার হয়েছেন অনেকে।
ধূমপান ও মদ্যপানে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। শীতকালে ধূমপান একেবারেই বন্ধ করুন।
হার্টবিট কি অনিয়ন্ত্রিত? হার্টজনিত সমস্যা আছে? ভাল্বের সমস্যা রয়েছে ইত্যাদি কারণে রক্তজমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাই এই সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করান।
পুষ্টিকর খাবার খান। পরিমাণমতো শাকসবজি রাখুন ভাতপাতে। ফাইবার জাতীয় খাবার যেন থাকে। সঙ্গে লিন মিট যেমন চিকেন খান। একটা গোটা ফল নিয়মিত। যে কোনও ধরনের রেড মিট যেমন মাটন, বিফ, পর্ক জাতীয় মাংস বাদ দিন বা খুব কম খান। যে কোনও চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এগুলোয় অনেক বেশি পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যেটা ধমনীতে চর্বির আস্তরণ ফেলে।
নুন রক্তচাপ বাড়ায়। শীতে যেহেতু রিস্ক বেশি তাই শীতকালে নুন খাবেন না। শীতকালে বাইরের খাবার মন ভরে— পেট ভরে নয়। শীতে যতটা সম্ভব জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন। এতে হৃদরোগ এবং স্ট্রোক— দুয়েরই ঝুঁকি বাড়ে।
অতিরিক্ত ওজন থাকলে কমান। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। গবেষণায় দেখা গেছে যাঁরা প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করেন তাঁদের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তচাপ, রক্তে কোলস্টেরল, ডায়াবেটিস-এর মতো সমস্যা কমে। হাঁটা ভাল ব্যায়াম। হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
মানসিক চাপ কমান। মেডিটেশন করুন নিয়মিত। সমীক্ষা বলছে মেডিটেশনে দেহের সাতটা চক্র ব্যালান্স হয়। এত মানসিক চাপ, স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি— সবই কমবে।
রক্তে কোলস্টেরল কমিয়ে ফেলুন। চল্লিশের পর পরীক্ষা করান ৬ মাস অন্তর। কোলেস্টেরল ধরা পড়লে যদি চিকিৎসক ওষুধের কথা বলেন তবে অবশ্যই তা খেতে হবে। এতে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকবে যেটা খুব জরুরি। কারণ কোলেস্টেরল মানে রক্তনালিতে চর্বি জমে রক্তনালির পথ সরু হতে শুরু করে একটা সময় ব্লক হয়ে যায়।