সন্দেশখালির দুটি ব্লকে মোট ৫৪টি গ্রাম আছে, তার মধ্যে সিপিএম অধুনা বিজেপি প্রভাবিত দু-তিনটি গ্রামে যে ভয়ঙ্কর নির্মম অত্যাচারের অভিযোগ ঘিরে বর্তমান সময় সারা বাংলার রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছে। সে-বিষয়ে কিছু কথা আর অনেক জিজ্ঞাসা।
আরও পড়ুন-এনসিআরবি ক্রাইম রিপোর্টে প্রথম দশে গুজরাটের দুই শহর, বিরোধীদের নিশানায় মোদি সরকার
সন্দেশখালির সিপিএমের বিধায়ক নিরাপদ সর্দার নিরাপদে এতদিন ধরে সন্দেশখালি থেকে আলিমুদ্দিনে এসেছেন গেছেন, সংগঠনের কাজ করেছেন, মহম্মদ সেলিমের পায়ের কাছে বসে কমিউনিজম শিখেছেন, কিন্তু একবারের জন্যেও তাঁর মনে পড়েনি সন্দেশখালিতে কট্টর তৃণমূল-বিরোধী দু-তিনটি গ্রামে মহিলাদের ওপর এত অত্যাচার হচ্ছে এবং সেটা কমরেড সেলিমকে জানানো দরকার! বিকাশ সিং সন্দেশখালির এত বড় বিজেপির সংগঠক এবং তার সঙ্গে কাঁথির গদ্দারবাবু-সহ বিজেপির বড় বড় নেতাদের এত ঘনিষ্ঠতা, কিন্তু তারও এতদিন একবারের জন্য মনে পড়েনি যে সন্দেশখালির একটা অংশে মহিলাদের ওপর এত অত্যাচার হচ্ছে এটা কলকাতার নেতাদের জানানো উচিত!
আরও পড়ুন-আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে আবাসিক চিকিৎসকরা
আজকের দিনে হাতে হাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইলের যুগে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বিস্তৃত সাম্রাজ্যে এতদিন ধরে চলে আসা মহিলাদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচারের একটা ভিডিও ক্লিপিংস বা অডিও রেকর্ড নেই এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। মণিপুরে একটি জাতিদাঙ্গার কত ভিডিও-অডিও ক্লিপিংস বাজারে ছড়িয়ে ছিল! আর এক্ষেত্রে তো ময়দানে দুটো শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য পোর্টাল মিডিয়া! কেউ কোনও খবর পেল না। শুধু পিছন ঘুরে থাকা কয়েকজন মহিলা, তাদের পরস্পর-বিরোধী বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী সম্বন্ধে একরাশ ঘৃণাযুক্ত কথাবার্তা! এত জোলো আর সস্তা চিত্রনাট্যে বাজিমাত কীভাবে সম্ভব?
সন্দেশখালি বিধানসভা এলাকায় রাজ্যের প্রত্যেকটি ছোট-বড় মিডিয়া হাউসের অসংখ্য সাংবাদিক কাজ করেন। দীর্ঘ দশ বছর ধরে সন্দেশখালির একটা অংশে মহিলাদের ওপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন হল। অথচ বিস্ময়করভাবে এদের কারও কাছেই তার কোনও খবর একটিবারের জন্যেও পৌঁছোল না! এটা বিশ্বাসযোগ্য?
ঘটনার পরের দিন জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ঘুরে রিপোর্ট দেন কোনও মহিলা তাঁদের কাছে ‘নারী নির্যাতনের’ অভিযোগ করেননি। এবং তাঁরা কোথাও বলেননি যে সন্দেশখালির কোথাও যেতে বা তথাকথিত ‘নির্যাতিতা’দের কাছে পৌঁছোতে কেউ তাদের বাধা দিয়েছে। তাহলে হঠাৎ এতদিন পর যখন বাস্তবটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে তখন আবার কেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনকে এলাকায় আসতে হল? মনপসন্দ রিপোর্ট পেশ হয়নি বলে? সন্দেশখালির মাটি না ছুঁয়েই দিল্লি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে তিনি কীভাবে মিডিয়ার সামনে বলে দিলেন সন্দেশখালিতে বীভৎস মহিলা নির্যাতন হয়েছে?
আরও পড়ুন-নাগপুরে প্লাস্টিক ফার্নিচার তৈরির কারখানায় ভয়াবহ আগুন
যে মহিলা কমিশন মণিপুরে চোখের সামনে চরম নারী নির্যাতনের ভিডিও দেখে, হরিয়ানার বাসিন্দা ভারতীয় জাতীয় দলের কুস্তিগিরদের চোখের জল ও প্রকাশ্য অভিযোগ শুনেও নিস্পৃহ থাকতে পারে, আদালতে প্রমাণ করতে হবে বলে নিজেদের গুটিয়ে রাখে, সেই মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান কীভাবে তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র মুখঢাকা মহিলাদের হাত ধরে টানা, ফোনে ডেকে পাঠানো ইত্যাদি ঘটনার মৌখিক অভিযোগে এতটা অতি-তৎপর হতে পারেন? অভিযোগের ভিত্তিতে প্রমাণ-সহ তদন্তের আগেই কেন ঘটনার বাস্তবতা প্রমাণে এত তাড়াহুড়ো! মিডিয়া ট্রায়ালেই অভিযোগকে সত্য বলে চালানোর মরিয়া চেষ্টা? তাহলে কি বঙ্গের বিরোধীরাও ভাল করে জানে যে মিথ্যাচার আদালতে ধোঁপে টিকবে না, তাই যা করার তা মিডিয়া ও কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়েই করতে হবে?
আরও পড়ুন-‘কখনও কোনো নির্বাচিত সরকার প্রতিবাদকারী নিরীহ কৃষকদের হত্যা করেনি’ তোপ মুখ্যমন্ত্রীর
পশ্চিমবঙ্গের কোন তৃণমূল নেতা কোন ব্যবসায়ীর থেকে টাকা নিয়েছে, কোন সাংসদ কোন গরু পাচারকারীর থেকে টাকা নিয়েছে, কোন কাউন্সিলর কোন ভেড়ির মালিকের সাথে যুক্ত, কোন সাংসদের পিএ এলাকায় তোলাবাজি করে, কোন এমএলএ দুর্নীতিতে যুক্ত, কোন টাউন সভাপতি এলাকায় জমির দালালি করে, সারা বাংলা জুড়ে এরকম হাজারো খবর যে অধিকারী খোকার পকেটে থাকে, তার কাছে সন্দেশখালিতে দশ বছর ধরে চলা ‘ভয়াবহ নারী নির্যাতনের’ কোনও খবর ছিল না! এটা বিশ্বাসযোগ্য?
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পর ধারাবাহিক হিংসার ঘটনা ঘটে সন্দেশখালিতে। সেইসময় বিজেপির দাবি মেনে মোদি-শাহ সন্দেশখালিতে ন্যাশনাল কমিশন ফর সিডিউল কাস্টের সদস্যদের পাঠান। ২০১৯ সালের ১৩ জুন তাদের সামনে গ্রামবাসীরা হিংসা, মারধর, খুন, ডাকাতির অভিযোগ নির্ভয়ে করলেও একজন মহিলাও শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের অভিযোগ করেননি। আবার ঠিক দু বছরের মাথায় ১৬ জুন ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর হিংসার ঘটনার তদন্ত করতে সন্দেশখালিতে আসে ন্যাশনাল কমিশন ফর সিডিউল ট্রাইবের সদস্যরা। তাদের কাছেও ভোট-পরবর্তী বিভিন্ন হিংসার ঘটনার সাক্ষ্য দিলেও একজন গ্রামবাসীও নারী নির্যাতনের ঘটনার উল্লেখ করেনি। তাহলে হঠাৎ করে আজ কোথা থেকে উড়ে এল এত বছরের ধারাবাহিক ‘নারী নির্যাতনের’ খবর?
আরও পড়ুন-‘দিদি নাম্বার ওয়ান’-এর মঞ্চ মাতালেন বাংলার দিদি
একটা কথা জগাই মাধাই গদাইরা এক সুরে বলছে যে সন্দেশখালির মহিলারা নাকি শেখ সাহাজাহানের ভয়ে এবং পুলিশ প্রশাসনের প্রতি অনাস্থায় এত বছর ধরে তাদের ওপর হয়ে চলা শারীরিক নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে পারেননি! এ-রাজ্যের পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, মধ্যমগ্রামের নারী নির্যাতনের ঘটনাপ্রবাহে কোথাও মনে হয়েছে যে এই বাংলায় মহিলারা প্রতিবাদে ভয় পান? এটা বিশ্বাসযোগ্য? সন্দেশখালির ওই দুটি গ্রামের পুরুষরা দিনের পর দিন নিজেদের মা-বোন-বউয়ের ইজ্জতের থেকে নিজেদের প্রাণের মূল্য বেশি ভেবেছেন! এটা বিশ্বাসযোগ্য?
কয়েকদিন আগে রাজ্যের তিন মন্ত্রী সন্দেশখালিতে ১৪৪ ধারা জারি আছে এমন কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রভাবিত গ্রামের বাইরের এলাকাগুলি পরিদর্শন করেন। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য মহিলারা রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে পুষ্পবৃষ্টি করেন, শঙ্খধ্বনি দেন, উলু দেন, জোর গলায় বলেন তাঁরা তাঁদের গ্রামে নিরাপদে নিশ্চিন্তে আছেন, কোথাও কোনও অস্থিরতা বা অত্যাচারের ঘটনা নেই। যদি এগুলো সাজানো ঘটনা হয় এবং এই মহিলারা যদি তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থক বা তাদের পরিবারের সদস্য হন তাহলে বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রভাবিত গ্রামে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পরিবারের মহিলা সদস্যদের দিয়ে মুখ ঢেকে পিছন ঘুরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘নারী নির্যাতনের’ মিথ্যা বা সাজানো অভিযোগ আনা অসম্ভব হয় কী করে? চিত্রনাট্যের গলদেই তো সব ফাঁস হয়ে যাচ্ছে! মাছ ঢাকার মতো শাক পাওয়া যাচ্ছে না যে!