উত্তরাখণ্ড বিধানসভায় ধ্বনিভোট ও প্রবল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি-সহ পাশ হয়ে গেল ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ বিল। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি বিরোধী কংগ্রেস বিধায়কদের সঙ্গে কোনও আলাপ-আলোচনা না করেই বিলটি পেশ করেন। বিরোধী বিধায়কদের বক্তব্য, তাঁরা এই বিল আটকাতে চাননি। কিন্তু বিলের বেশ কিছু অংশ খুঁটিয়ে দেখার জন্য বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু শাসক বিজেপি সেই সুযোগ দেয়নি। শোনা যাচ্ছে খুব দ্রুত আরও দুই বিজেপি-শাসিত রাজ্য গুজরাট ও অসমে এই বিল আনা হবে। বোঝাই যাচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগে রামমন্দিরের পাশাপাশি অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও হতে চলেছে বিজেপির আরেকটি নির্বাচনী হাতিয়ার।
আরও পড়ুন-ছাত্রীর অভিযোগে যাদবপুরে স্থগিত প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা
নামে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হলেও এই বিল কিন্তু এখনই সকলের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে না। এর আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে সংবিধানের ধারা ৩৬৬-র ২৫ নং ক্লজ ও ধারা ১৪২-এর পার্ট ২১-এর অধিকারবলে বিশেষ সুবিধা যাঁরা ভোগ করেন সেই তফসিলি সমাজকে। কিন্তু সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর বিস্ফোরক দাবি, এই বিলের মাধ্যমে নতুন করে ফের ‘হিন্দু কোড বিল’ লাগু করা হতে চলেছে এবং সেটা চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে দেশের সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষের উপরে। হিন্দু যৌথ পরিবারকে এই আইনে স্পর্শ করাই হয়নি। এই বিলে উত্তরাধিকার, বিবাহ, দাম্পত্য-সংক্রান্ত ধারায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে কোনও বদল ঘটানো হয়নি। অর্থাৎ এই বিল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে কোনও অভিন্নতার আওতায় আনেনি। বরং হিন্দু কোড বিলের আইনি বিষয়গুলো দেশের অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেবার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিজেপির মতো একটি আগ্রাসী রাজনৈতিক হিন্দুত্বের শক্তি আসলে হিন্দু আইনের অধীনে দেশের অন্য সমস্ত গোষ্ঠীকে নিয়ে আসতে চায়।
আরও পড়ুন-পোল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদলের সঙ্গে বৈঠকে অরূপ বিশ্বাস
এই বিল কিন্তু গত বেশ কয়েকবছর ধরেই আইনি পরিসরে বিবিধ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাইশতম ল’ কমিশন এই বিলের আওতায় সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেওয়ায় দেশের প্রধান মহিলা সংগঠনগুলো আপত্তি জানিয়েছিল। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বহুক্ষেত্রেই মহিলাদের অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়ায়। আবার গতবছর জুন মাসে ল’ কমিশন বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে এই মর্মে মতামত চেয়ে পাঠালে মুসলিম মহিলাদের অধিকার রক্ষায় যেসব সংগঠন কাজ করেন, তাঁরা বলেন, সংখ্যালঘু মেয়েদের বিবিধ আইনি সুরক্ষার নিশ্চিত প্রয়োজন। কিন্তু বিজেপি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েই যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। বিভিন্ন পার্সোনাল ল’-তে হস্তক্ষেপ না করে সরকারের উচিত ছিল ওই পার্সোনাল ল’-গুলিতে নারী-পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে যে চরম বৈষম্য রয়েছে, সেগুলো বাতিল করা। এই প্রসঙ্গে দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যায়। কর্নাটকে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার অধিকার কেড়ে নেবার দাবিতে হিন্দুত্ববাদীরা লাগাতার ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। কিন্তু কোনও মুসলিম মহিলা স্বেচ্ছায় হিজাব পরার অধিকার চাইতেই পারেন, সেটাকে অন্যায় বলা যায় না কোনওমতেই। ধর্মান্তর-বিরোধী আইন লাগু করার চেষ্টা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা, এটি তাদের বহুল কথিত ‘লাভ জেহাদ’-বিরোধী প্রচারের অংশ। কিন্তু দুজন প্রাপ্তবয়স্ক আলাদা ধর্মের নারীপুরুষ যদি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চান, তাতে বাইরের কারও বাধা দেবার কোনও কারণ থাকতে পারে না।
আরও পড়ুন-চোপড়ার শোকার্ত পরিবারের পাশে রাজ্য
‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’, ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন’, ‘বেবাক’-এর মতো নারী-অধিকার সমিতিগুলি বারবার দাবি জানিয়ে আসছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হোক পার্থক্যের (ডিফারেন্স) ভিত্তিতে নয়, বরং বৈষম্যের (ডিসক্রিমিনেশন) অবসানের জন্য। তাঁরা ২৫ দফা সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। যেমন, মুসলিম মহিলাদের জন্য মুসলিম ল’-এর মধ্যেই বিশেষভাবে বিবাহ, ডিভোর্স, দত্তক গ্রহণ, সন্তানের কাস্টডি, সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার, খোরপোশ পাবার অধিকার, মুসলিম মেয়েদের বিবাহের রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি। ‘বেবাক’ নামক সংগঠনটি পরিষ্কার বলেছেন, মুসলিম মেয়েদের রক্ষার নামে এই আইন আসলে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু ধর্মকে টার্গেট করতে চাইছে, তার ‘অপরাধীকরণ’ ঘটাচ্ছে। তাঁরা জাতীয় ল’ কমিশনকে জমা দেওয়া আবেদনে স্পষ্ট বলেছেন, কেবল ‘তিন তালাক’ নয়, যেকোনও ধরনের একপাক্ষিক ‘তালাক’ নিষিদ্ধ করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে লক্ষ্য করে এই বিধি চাপানো হচ্ছে, যাতে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা যেকোনও ধরনের বিষমকামী দাম্পত্যকেই অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর সমকামী, বিষমকামী সম্পর্ক বিষয়ে এই বিধি পুরোপুরি ঔপনিবেশিক আইনের অনুসারী। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের যৌনাচরণের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই আইন সেই পুরো ইতিহাসকেই খারিজ করে দেয়।
ভারতে বহুত্ববাদী পারিবারিক ও সাধারণ আইনের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, যেমন, পণপ্রথাবিরোধী আইন, সতীদাহ-নিবারণ আইন, বাল্যবিবাহ-নিরোধক আইন, দাম্পত্যহিংসা-নিরোধক আইন ইত্যাদি। এগুলির কোনওটির জন্যই নতুন করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনার কোনও প্রয়োজন ছিল না। মেয়েদের মৌলিক অধিকার রক্ষা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার ইত্যাদির জন্য পার্সোনাল ল’-এর সংস্কার জরুরি, পার্সোনাল ল’-কে নিকেশ করার দরকার নেই। আসলে বিজেপি ইউসিসি চাইছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগকে ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করবে বলে।