কেড়ে নেওয়া হল মুখের ভাষা
কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল কথাটা। বাতাসে উড়ছিল ইতিউতি আশঙ্কার স্বর। শাসকরা নাকি কেড়ে নেবে মুখের ভাষা! সুদূর পাকিস্থান থেকে সমন্বয় সাধনের জন্য শাসক শ্রেণি শুধু উর্দু মাত্র ভাষাই চালু করবে যা হবে রাষ্ট্রভাষা। তবুও একটা আশা ছিল পাকিস্থানের রূপকার জিন্না সাহেব কী বলেন! কিন্তু সেই আশা সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট হল ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ। ওইদিন ঢাকার রেস কোর্সে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, বাংলা নয় উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সেই হিসেবে এই পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষীদের শিখে নিতে হবে উর্দুও। যাঁরা মানবেন না তাঁরা হবেন দেশদ্রোহী।
প্রথম থেকেই নারী
আসলে পাকিস্থানের শাসকেরা উপলব্ধি করেছিলেন ভাষা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্র বিরোধী ভাবনা বাসা বাঁধছে এবং এতে যোগদান করেছে আপামর জনসাধারণ থেকে ছাত্রীরাও। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য এক স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেখানে নারীদের ও ছিল উজ্বল উপস্থিতি, যেখানে স্বাক্ষর করেছিলেন জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদক লীলা রায় এবং মিসেস আনোয়ার চৌধুরী। বাংলা ভাষাকে সংহত রূপ দিতে গঠিত হয়েছে ‘তমুদ্দিন মজলিশ’ নামে এক সংগঠন, যেখানে মেয়েদের উজ্বল উপস্থিতি। অনেক সাধারণ ছাত্রী যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা জেবুন্নিসা বেগম, দৌলতুন্নেছা বেগম ও আনোয়ারা বেগমের মতো উচ্চশিক্ষিত মহিলারাও।
মুখে সিগারেট, শাড়ি বদলে প্যান্ট
আরও পড়ুন-অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, কার, কোন উদ্দেশ্যপূরণে আনা হল?
জিন্নার সভার বেশ কিছুদিন আগেই ঢাকার বার লাইব্রেরিতে এক সর্বদলীয় সভায় ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন তাঁর জ্বালাময়ী ভাষায় ছড়িয়ে দিলেন আন্দোলনের মেজাজ— ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে’। আন্দোলনের একেবারে সূচনা লগ্নে একজন ছাত্রীর মুখের এহেন স্পষ্টবাকেই আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী মেজাজ নির্ধারিত হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য জীবনদানের সংগ্রাম ১৯৫১ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি আসতে তখনও অনেক দেরি। কিন্তু এই সময় থেকেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারি–মার্চ থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। যদিও সেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ জায়গায় ঘটেছিল তা সত্ত্বেও মেয়েরা ছিলেন সক্রিয় ও জাগরুক। গঠিত হয় বাংলা ভাষা সংগ্রাম কমিটি। ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকা হল। এগিয়ে এলেন নিবেদিতা নাগ, নাদেরা বেগম, লিলি খান, লায়লা সামাদরা। সেই সময় অনেক স্কুল- কলেজের ছাত্রীরা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করলেও শেমিন গার্লস স্কুলে কর্তৃপক্ষের নিষেধে ছাত্রীরা বাইরে আসতে পারছিলেন না। ওই সময় বিএ পড়ুয়া ছাত্রী হামিদা রহমান অকুতোভয় চিত্তে ছাত্রীদের আন্দোলনে নামান। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, তিনি কলেজের পিছন গেট দিয়ে শাড়ির বদলে ছেলেদের ড্রেস পরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেরিয়ে আসেন। সেই সময়কার আন্দোলনে মেয়েদের এক গৌরবোজ্জ্বল ছবি পাওয়া যায় মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণায়— “যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটেয় শেষ করত। ছোট ছোট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হত না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই, পুলিশি জুলুম চলবে না–এমন নানা ধরনের স্লোগান”।
আরও পড়ুন-চোপড়ার শোকার্ত পরিবারের পাশে রাজ্য
চলে এল ২১ ফ্রেব্রুয়ারি
শুধু ঢাকা নয়, যশোর নারায়ণগঞ্জ পাবনা মাদারিপুর— সর্বত্রই বাংলা ভাষার পক্ষে একজোট হচ্ছে মানুষ। আন্দোলনে গতি বাড়াতে ঢাকায় যুব লিগ ঠিক করে ফেলল ২১ ফ্রেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচি। কিন্তু ২০ ফ্রেব্রুয়ারি ঢাকায় জারি হল ১৪৪ ধারা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি পড়ল উভয় সংকটে। শান্তিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়া না হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ! সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হল। মতানৈক্য থেকে ব্যাপারটা গেল ভোটাভুটির পর্যায়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দেখা গেল, ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষেই অবশ্য বেশি ভোট। বোঝা গেল বয়স্কদের অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। অতএব কী করণীয়!
শিকল ভাঙল মেয়েরাই
২১ ফ্রেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পাকিস্তানি সেনা, পুলিশে ছয়লাপ। সরকারের কাছে খবর আছে ১৪৪ ধারা ভেঙে বেরোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। এমনকী মেয়েরাও এই ব্যারিকেড ভেঙে আসবে। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না এখানেও মতভেদ। বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বিমত উঠে এল। এমনকী এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একপ্রস্থ হাতাহাতিও হয়ে গেল। অবশেষে ছাত্রীদের সংখ্যাধিক্যে উঠে এল ১৪৪ ধারা ভাঙার মত।
সেই মতো ১৪৪ ধারা ভাঙার পরিকল্পনা হল। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে যে মহিলা ও ছাত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রওশন আরা বাচ্চু, নাদেরা চৌধুরী, সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, কাজী আমিনা, শামসুন নাহার, হালিমা খাতুন প্রমুখ। কয়েকদিন ধরেই ছাত্রীরা রাত জেগে লিখেছেন পোস্টার, কেউ দায়িত্ব নিয়েছেন চাঁদা সংগ্রহের। এবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ছাত্রছাত্রীরা ঠিক করে নিয়েছিলেন ১০ জন করে তাঁরা বেরোবেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে ব্যারিকেড ভাঙেন পুলিশের। এগোতে থাকেন সংসদ ভবনের দিকে। পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হন রওশন আরা বাচ্চু। গ্রেফতার হলেন ফরিদা বারি, সালেহা খাতুন সহ অনেকেই।
চত্বর থেকে রাজপথ
১৯৪৮ সালের আন্দোলনে গ্রেফতার হয়েছিলেন নাদেরা বেগম। তিনি মুক্তি পেয়ে যোগ দিলেন আন্দোলনে। ঢাকার রাজপথে ১৪৪ ধারা ভেঙে পায়ে পা মেলালেন আরও অনেক মহিলা। চলল লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস। ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে গুলি চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, গুরুতর আহত অনেক ছাত্রকে নিয়ে আসছেন বন্ধুরা। অনেকে আবার সাধারণ জনতা। ভাষার জন্য এই লড়াই, তাই মনপ্রাণ ঢেলে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীরা নেমে পড়লেন তাঁদের শুশ্রূষায়। হতাহত হলেন বরকত, জব্বার সালাম, রফিক সহ ছয়জন। আর এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে মেয়েরা পথে নামলেন। ঢাকার কামেরুন্নেসা স্কুলের গলিতে সভা করলেন মেয়েরা। সোচ্চার হলেন কবি সুফিয়া কামাল, সঞ্জীদা খাতুন, বেগম নুরজাহান প্রমুখ।
ভালবাসার থেকেও প্রিয় ভাষা
মমতাজ বেগম। আসল নাম কল্যাণী রায়চৌধুরী। কলকাতার হাইকোর্টের বিচারপতির কন্যা। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন সরকারি আমলা আব্দুল মান্নাফকে। নারায়ণগঞ্জের প্রধান শিক্ষয়িত্রী থাকাকালীন জড়িয়ে পড়লেন ভাষা আন্দোলনে। নেতৃত্ব দিলেন মিছিলে, মিটিংয়ে। নেমে এল তাঁর উপর অত্যাচার, পিছু হটলেন না। অবশেষে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করল। সঙ্গে তাঁর কয়েকজন ছাত্রী ইলা বক্সি, বেণু ধর। ছাত্রীরা ছাড়া পেলেও তিনি আটক থাকলেন দেড় বছর। ওই জেলেই বন্দি ছিলেন নাচোলের রানি ইলা মিত্র। তিনি মমতাজকে রাজবন্দি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করলেন। রাজবন্দি হিসেবে স্বীকৃত হলেন। সরকার তাঁকে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসতে বলে। তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন সেই প্রস্তাব। ভাষার প্রতি তাঁর এই কাজে বিরূপ হয়ে তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করলেন শেষপর্যন্ত। ভাষা বিদ্রোহিণী মমতাজ থেকে গেলেন ইতিহাসে।
আরও পড়ুন-ছাত্রীর অভিযোগে যাদবপুরে স্থগিত প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা
বিদ্রোহিনী ভাষা সেনানীরা
‘তমুদ্দিন মজলিশের’ অন্যতম যোদ্ধা আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা। বোন রহিমা আর রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী আন্দোলনকারীদের রান্না করে খাওয়ান নিয়মিত। খবর পেয়ে পুলিশ এল রাতে। ঘরের ভেতর তখন ভাষা সৌনিকরা ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সৌনিকের’ কাজে ব্যস্ত। রাহেলা বুদ্ধি করে তাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলেন, সেই সময় পিছনের দিক দিয়ে পালিয়ে গেলেন ভাষা যোদ্ধারা।
চেমন আরা ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। স্কুলের ছাত্রী অবস্থা থেকেই ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ তমুদ্দিন মজলিশে যুক্ত ছিলেন। পোস্টার লেখা থেকে শুরু করে প্রচার অভিযানে ছিলেন অন্যতম নারীমুখ। পুলিশের গুলিতে নিহত বরকতের রক্তমাখা শার্ট হাতে নিয়ে পরের দিন সকালে মিছিলের পুরোভাগে। তাঁর নারীকণ্ঠের দীপ্ত আওয়াজে মুখরিত হল রাজপথ। প্রতিভা মুৎসুদ্দি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্রী, ২১ ফ্রেব্রুয়ারি সকালের আন্দোলনে অংশ নিলেন। দুপুরে ঢাকার গুলি চালানো ও মৃত্যুর খবর পেলেন। আবার বেরিয়ে পড়লেন নতুন মিছিলে— মন্ত্রিসভার পদত্যাগ চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। স্লোগানে মাতালেন চট্টগ্রাম। ঘরে ফিরে এসে বাবার হাতে প্রচণ্ড মার। ভাষার জন্য একটু মার! তাও আবার বাবার হাতে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল এমনি একটু-আধটু মার, তাতে হল কী! এভাবেই দিন যত এগিয়েছে ঘরের পর্দা ভেদ করে পারিবারিক শাসন মাথা পেতে এগিয়ে এসেছে মেয়েরা, সেখানে স্থান করেছেন সোফিয়া খাতুন, রানি ভট্টাচার্য, লায়লা নুর সহ আরও অনেক ভাষা সেনানী। তাঁরা জেনেছিলেন, এ ভাষা তাঁদের মুখের ভাষা, ভাষাতে কোনও লিঙ্গভেদ নেই। তাঁদের উপলব্ধিতে আগেই ছিল—‘‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে/ চোখে ভেসে ওঠে কত চেনা ছবি/ মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন ঘুমপাড়ানিয়া ছড়া’’