এখনও লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হয়নি। ইতিমধ্যে কোনও রাজনৈতিক দলই কোনও রাজ্যের পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী-তালিকা বের করতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম তৃণমূল কংগ্রেস দল। গতকাল দুপুরে বাংলার ৪২টি লোকসভা কেন্দ্রেই দলের প্রার্থী ঘোষণা করলেন জাতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। না! সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে নয়। ব্রিগেড ময়দানে। মানুষের দরবারে। যতদূর মনে পড়ে, এত বড় চমক দেশের রাজনীতিতে কখনও কোথাও ঘটতে দেখা যায়নি। অভিষেক এক-একজন করে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করছেন, আর জনকল্লোলে সাড়া দিয়ে নেত্রী মমতাদিদির সাথে প্রার্থীরা বিশেষভাবে তৈরি ঢালু-পথে ময়দান পরিক্রমা করলেন। এমন বিরল দৃশ্যও ভূ-ভারতে কখনও দেখা যায়নি। সংগঠন কত মজবুত ও যুগোপযোগী হলে এমনটি কোনও দল যে করতে পারে, সারাদেশে তৃণমূল কংগ্রেস তার বিস্ময়কর নজির রাখল।
এবারেও প্রার্থী-তালিকাতে অসামান্য ভারসাম্য বজায় রয়েছে। ৪২ জন প্রার্থীর মধ্যে ১২ জনই মহিলা।
পুরনো মহিলা সাংসদেরা যেমন অনেকেই রয়েছেন, নবাগতাদের মধ্যে তেমনই সায়নী ঘোষ, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ শর্মিলা সরকার ও জুন মালিয়া-র নাম উল্লেখযোগ্য। এই ৪ জনের মধ্যে তিনজন অভিনয় জগতের এবং ডাঃ শর্মিলা সরকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। দলের দুই প্রবীণতম নেতা অধ্যাপক সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নব প্রজন্মের সবচেয়ে পরিচিত মুখ, দেবাংশু ভট্টাচার্য এই প্রথম সংসদ নির্বাচনে লড়বেন।
আরও পড়ুন-দিল্লির মহিলাদের কাছে আর্জি আপের, মোদি-বয়কটের ডাক কেজরির
রবীন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে অভিভাষণে বলেছিলেন, “নূতনত্বে আর নবীনত্বে প্রভেদ আছে। নূতনত্ব কালের ধর্ম, নবীনত্ব কালের অতীত। মহারাজা বাহাদুর আকাশে যে জয়ধ্বজা ওড়ান, আজ সে নতুন, কাল সে পুরানো। কিন্তু সূর্যের রথে যে অরুণধ্বজা ওড়ে, কোটি কোটি যুগ ধরে প্রতিদিনই সে নবীন। …নতুন আসে অকস্মাতের খোঁচা দিতে, নবীন আসে চিরদিনের আনন্দ দিতে।” ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী-তালিকা অকস্মাতের খোঁচা দিতে নয়, সূর্যের রথের অরুণ ধ্বজার মতোই নবীনত্ব-গুণে সমৃদ্ধিশালী। সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রার্থী-তালিকা বাংলার জনাশিসের জন্য যখন নিবেদিত হল, তখন যেন দিনাজপুর থেকে দেগঙ্গা, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, সর্বদিগন্ত মন্দ্রিত হল অভিন্ন আহ্বানে, “সুপ্তি ত্যজি বরি লও তারে, লুপ্ত হোক অপমান,/ দেখা দিক শাশ্বত কল্যাণ।” বাংলার হকের টাকা মেরে, পেটের ভাত ছিনিয়ে, বাংলার কৃষ্টিকে ধূল্যবলুণ্ঠিত করে, দিল্লির জমিদাররা যে অপমান করেছে, এই ৪২ জন প্রার্থীর মস্তকোপরি জনাশিস বর্ষিত হয়ে তার অবসান ঘটাক। এই আর্তিতে মুখরিত আজ দার্জিলিং থেকে দেগঙ্গা।
আরও পড়ুন-রেল রুখে দিয়ে কেন্দ্রকে কড়া বার্তা কৃষক আন্দোলনকারীদের
সংখ্যালঘু ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে গোপাল লামা, প্রকাশ চিক বড়াইক, শান্তিরাম মাহাতোদের। ঝাডগ্রাম থেকে প্রার্থী, পদ্মশ্রী তথা বঙ্গভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত সাঁওতালি কবি কালীপদ সোরেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কালচার বা সংস্কৃতি বলিলে বুঝি উন্নত মানবসমাজের অন্তরঙ্গ বস্তুগুলি, তাহার আধিমানসিক আধ্যাত্মিক জীবন; তাহার সামাজিক জীবনের সৌন্দর্যময় প্রকাশ;… তাহার বাহ্য সভ্যতার প্রাণবস্তু।” প্রার্থী-তালিকায় সকল কৌমসমাজ, সকল জনজাতির প্রতিনিধিত্ব বঙ্গসংস্কৃতির সেই প্রাণবস্তুকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আরও পড়ুন-বিজেপির ফের সেই প্রতিহিংসার রাজনীতি, বিহারে গ্রেফতার লালু-ঘনিষ্ঠ
প্রার্থী-তালিকায় আছেন ভারতীয় ক্রিকেটের দুই স্বনামধন্য প্রাক্তন খেলোয়াড কীর্তি আজাদ, ইউসুফ পাঠান। মালদহ উত্তর ও দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে লড়বেন যথাক্রমে সদ্য স্বেচ্ছা-অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ পুলিস অধিকারিক প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত গবেষক শাহনওয়াজ আলি রহমান। সুতরাং রাজনীতির জগতের পরিচিত মুখ ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন অংশ তথা পেশার উজ্জ্বল ব্যক্তিদের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে প্রার্থী-তালিকায়। এতদিন নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব ইত্যাদি জল্পনা-কল্পনার আশ্রয়ে টিভি-র সান্ধ্য আসর সরগরম ছিল। এবার ওসব আর হালে পানি পাবে না। কারণ, ছিদ্রান্বেষীদের সমস্ত অপপ্রচার মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে এই তালিকা। নবীন-নবীনা আছেন, প্রবীণতমও আছেন। ডাক্তার আছেন, গবেষকও আছেন। অধ্যাপক, উকিল, কবি, অভিনেতা-অভিনেত্রী, বাগিচা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান, খেলোয়াড, ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গ ও পেশার সফল ব্যক্তিরা আবারও লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী হলেন। এমন বৈচিত্র্য ও পরম্পরার নিখুঁত সমন্বয় এবারেও ঘটালেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সেনাপতি অভিষেক। ময়দানে প্রার্থী-পরিচয় পর্বের সময়েই তাই জনগর্জনে শোনা গেল— খেলা হবে।