পড়ার ফাঁকে লেখা
বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারের কন্যা। বড় হয়েছেন লেখালেখির পরিবেশে। কাঁচা বয়সেই তাঁর মনে জন্ম নিয়েছিল সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ। ছোটবেলা কেটেছে শিলংয়ে। সেখানেই লেখালিখির শুরু। লিখতেন মূলত গল্প। কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তুলতেন সাদা পাতা। একদিন স্কুলের পত্রিকা ‘প্রসূন’-এ পাঠিয়ে দিলেন নিজের লেখা গল্প। ছাপাও হয়ে গেল। ছোট্ট মেয়ের লেখাটি পড়ে আবাক বড়রা। সবাই উৎসাহ দিতেন। তবে মাঝেমধ্যে বকুনি দিতেন মা। চিন্তা করতেন মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে। ছোট্ট মেয়েটি সব বুঝতেন। লিখতেন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে। রায়চৌধুরী পরিবারের সেই কন্যা হলেন লীলা মজুমদার। সাহিত্য সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালির শৈশবকে তিনি রাঙিয়ে তুলেছিলেন তাঁর অসামান্য সৃষ্টি দিয়ে।
আরও পড়ুন-আগুনে ছাই দেড়শো বিঘার গম
আদর্শ ছিলেন সুকুমার
জন্ম ১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায়। বাবা প্রমদারঞ্জন রায় লিখতেন ছোটদের জন্য। তাঁর লেখা ‘বনের কথা’ ধারাবাহিক ভাবে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত হত। মা সুরমা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। উপেন্দ্রকিশোরের আদরের ভাইঝি লীলা মূলত ছোটদের জন্য লিখেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে ছিল ইউ রায় অ্যান্ড কোং-এর ছাপাখানা, অফিস এবং উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের আস্তানা। শিলং থেকে এসে লীলার পরিবার প্রথমে সেই বাড়িতেই ওঠেন। তখন থেকেই লীলা ‘সন্দেশ’ পত্রিকা দফতরের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। জ্যাঠতুতো দাদা সুকুমার রায় ছিলেন লীলার জীবনের আদর্শ। তবে তাঁকে খুব বেশিদিন পাননি। লীলার যখন ১৫ বছর বয়স, তখন প্রয়াত হন সুকুমার।
আরও পড়ুন-ক্যান্ডিডেটসে চমক বিদিতের, হার প্রজ্ঞানন্দের
ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন
লীলা মজুমদারের বহুল পঠিত লেখা ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’। লিখেছিলেন কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে। ‘রংমশাল’ পত্রিকার জন্য। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন লীলা। ভেবেছিলেন, আদৌ উপন্যাস লিখতে পারবেন কিনা। ভাবতে ভাবতেই তাঁর মনে গল্পের জন্ম হয়। ধীরে ধীরে লেখা হয়ে যায় ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’। ছোটদের কাছে তো বটেই, সেই লেখা সমাদৃত হয় বড়দের কাছেও। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা ‘টংলিং’, ‘হলদে পাখির পালক’, ‘সব ভুতুড়ে’, ‘মেঘের শাড়ি ধরতে নারী’ ‘গুপীর গুপ্তখাতা’, ‘মাকু’, ‘ছোটদের তাল বেতাল’। লিখেছেন বড়দের জন্যও। বুদ্ধদেব বসুর চাপে। তাঁর প্রথম বড়দের গল্প ‘সোনালি রুপালি’ প্রকাশিত হয় ‘বৈশাখী’ পত্রিকায়। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদও করেছিলেন।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় নিহতের নাম গণতন্ত্র
স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ
দার্জিলিংয়ে ‘মহারানী গার্লস স্কুল’-এ শিক্ষকতা দিয়ে লীলার কর্মজীবনের শুরু। বিশেষ স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আহ্বানে লীলা বিশ্বভারতীতে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। বেশ কিছুদিন এই গুরুদায়িত্ব পালনের পর তিনি যোগ দেন আশুতোষ কলেজে। একটা সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন স্বাধীনভাবে সাহিত্যচর্চা। দুই দশক এইভাবেই কাটিয়ে দেন। ১৯৫৬ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে চাকরিতে যোগ দেন। সেইসময় কলকাতা বেতারের ‘মহিলা মহল’ অনুষ্ঠানে তাঁর ‘ঠাকুমার চিঠি’, ‘ইষ্টকুটুম’-এর গল্প সমাদর পেয়েছিল। ‘গল্পদাদুর আসর’-এ পঠিত হয় ‘হলদে পাখির পালক’ ও ‘টাকার গাছ’। অভিনীত হয় ‘বক বধ পালা’। ১৯৬১ সালে সারা দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছিল রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী। আকাশবাণীতেও ছিল কর্মব্যস্ততা। সেই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন লীলা। ৭-৮ বছর পর আকাশবাণীর চাকরিতে ইতি টেনে পুরোদমে শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। সম্পাদক হিসেবে ছিলেন কড়া ধাতের। এমন কিছু লেখা ‘সন্দেশ’-এ ছাপতে দিতেন না, যেগুলো ছোটদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। পেয়েছিলেন ভাইপো সত্যজিৎ রায়ের সহযোগিতা।
আরও পড়ুন-‘ক্ষমতা থাকলে লড়াই করে জেত’ এনআইএ’র আচরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
বিচ্ছেদ ঘটেছিল বাবার সঙ্গে
ঘোরতর সংসারী ছিলেন লীলা। ১৯৩২ সালে বিয়ে করেন নিজের পছন্দের পাত্র হার্ভার্ড ফেরত দন্ত চিকিৎসক সুধীরকুমার মজুমদারকে। তাঁরা ব্রাহ্ম, সুধীরকুমার হিন্দু। পরিবারে এই বিয়ে ঘিরে প্রবল ঝড় উঠেছিল। বাবার সঙ্গে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল লীলার। যদিও মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই বিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুকুমারের মতো রবীন্দ্রনাথও ছিলেন লীলার জীবনে ভরসার জায়গা।
আরও পড়ুন-আবার ভারতীয় পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু, মার্কিন মুলুকে, প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা
নানা রঙের লেখা
টানা সাহিত্যচর্চা করতে পারেননি লীলা। মাঝেমধ্যেই বিরতি নিতে হয়েছে। আবার লেখালিখি শুরু করেছেন। ‘সন্দেশ’-এর পাশাপাশি লিখেছেন ‘মৌচাক’, ‘রামধনু’, ‘রংমশাল’, ‘বৈশাখী’, ‘পরিচয়’ প্রভৃতি পত্রিকায়। সাহিত্যচর্চার জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার-সহ আরও অনেক পুরস্কার। ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল প্রয়াত হন লীলা মজুমদার। তাঁর নানা রঙের লেখা আজও পাঠক মনকে নিয়ে যায় কল্পনার জগতে। এইভাবেই তিনি থেকে যাবেন। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে।