সভ্যতার চাকা ছুটছে। দ্রুত গতিতে। হাতের মুঠোয় বিনোদনের রকমারি উপাদান। তবে কোনও কিছুই বিকল্প হতে পারেনি বইয়ের। সারা বছর সরগরম থাকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। ছোট-বড় অসংখ্য প্রকাশক। নানা বিষয়ের বই প্রকাশে মেতে থাকেন। উৎসাহী পাঠকদের কথা ভেবে। একটা সময় বেশিরভাগ বই প্রকাশ পেত পয়লা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন বহু প্রকাশক হালখাতার পুজোর আয়োজন করেন। আমন্ত্রিত হন লেখক, সম্পাদক, পাঠকরা। তাঁদের উপস্থিতিতে মোড়ক উন্মোচিত হত বইগুলোর। এখন সেই জায়গা দখল করেছে কলকাতা বইমেলা। তবে কোনও কোনও প্রকাশক পুরোনো ঐতিহ্য মেনে বাংলা নববর্ষে প্রকাশ করেন নতুন বই। একবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। আজ পয়লা বৈশাখ। ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থার দপ্তরে নববর্ষের আড্ডায় প্রকাশিত হবে বেশকিছু নতুন বই এবং পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। কী কী বই প্রকাশিত হবে? নতুন বছরের পরিকল্পনা কী? জানতে চাইলাম কয়েকজন প্রকাশকের কাছে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বুকে এঁকে ভোট প্রচার তৃণমূল কর্মীর
দে’জ পাবলিশিং হাউসের কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে বললেন, আমরা মূলত সাহিত্যের বই প্রকাশ করি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটকের বই। পাশাপাশি প্রকাশ করেছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রান্না, সিনেমা, ধর্ম, রাজনীতি, কৃষি ইত্যাদি বিষয়ের বই। ১৯৭০ সাল থেকেই এই লক্ষ্যে আমরা এগিয়েছি। প্রতি মুহূর্তে ভাবনাচিন্তা করি আর কোন কোন বিষয়ে বই বের করা যায়। আমরা বইয়ের পরিকল্পনা করি মূলত গ্রামীণ বইমেলা ঘুরে এসে। আগে নিজে যেতাম বিভিন্ন জেলা বইমেলায়। পাঠকের সঙ্গে কথা বলতাম। জেনে নিতাম কী তাঁদের চাহিদা। নতুন বছর এমন কিছু বিষয়ের বই প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে, যে বিষয়ের বই আমাদের ঘরে নেই। আমি এখনও সময় বের করে বই পড়ি। বিভিন্ন প্রকাশন সংস্থার বই আমাদের বিক্রয় কেন্দ্রে আসে। সেখান থেকে বেছে নিয়ে পড়তে বসে যাই। প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি পড়ি নতুনদের বই। পয়লা বৈশাখ আমাদের দপ্তরে নববর্ষের আড্ডা বসে। বহু বছর ধরেই আয়োজিত হচ্ছে। আগে আসতেন প্রবীণ লেখকরা। এখন আসেন নতুন প্রজন্মের লেখকরা। তাঁদের উপস্থিতিতে আমরা নতুন বই প্রকাশ করি। এই বছর প্রকাশিত হবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘অনুবাদ সমগ্র’। অজয় গুপ্তর সম্পাদনায়। শুভময় মণ্ডল এবং সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবন্ধ সমগ্র এবং’, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘গল্প সমগ্র-১’, দেবেশ রায়ের ‘গল্প সমগ্র-৪’, সাবিত্রী রায়ের ‘রচনা সংগ্রহ’, নবকুমার বসুর ‘পান্থপ্রবাস’-সহ বেশকিছু বই।
পত্রভারতীর কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হল। তিনি জানালেন, এবার পয়লা বৈশাখে আমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি নতুন বই প্রকাশিত হবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বইটি হল কিশোর ভারতী পত্রিকার ৫০ বছরের যাত্রাপথে ৫০টি সেরা উপন্যাস ‘কিশোর ভারতী সেরা উপন্যাস সমগ্র সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ সংকলন’। দাম ১২০০টাকা। প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়-সহ অনেকের লেখাই আছে। আছে কিছু অগ্রন্থিত লেখাও। অনবদ্য সব উপন্যাস। বেশ বড় কাজ। আমার বহু দিনের স্বপ্ন ছিল। বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই সাড়া পড়ে গেছে। এর পাশাপাশি প্রকাশিত হবে দুটো ধর্ম-বিষয়ক বই, সোমব্রত সরকারের ‘বৌদ্ধতন্ত্র’ এবং শ্রীবশিষ্ঠ-র ‘ভারতের আশ্চর্য শিবলিঙ্গ’। আমরা চাই বিভিন্ন বিষয়ের বই প্রকাশ করতে। নতুন বছরে বেশকিছু পরিকল্পনা আছে। সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রচুর বই পড়ি। নতুনদের মধ্যে অনেকেই খুব ভাল লিখছেন। তাঁদের লেখা আরও বেশি করে পড়ব। নিজের লেখালিখির কথা একটু বলি। নতুন বছর একটি দৈনিক সংবাদপত্রের শারদীয়া সংখ্যায় সম্পূর্ণ প্রাপ্তমনষ্ক উপন্যাস লিখব। পাশাপাশি কিশোর ভারতীতে লিখব একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। সবমিলিয়ে ব্যস্ততায় কাটবে নতুন বছর।
আরও পড়ুন-রাজবংশীদের সঙ্গে বৈঠকে পাশে থাকার বার্তা অভিষেকের
প্রবীণ-নবীন লেখকদের মেলবন্ধন ঘটে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ-এর নববর্ষের আড্ডায়। প্রকাশন সংস্থার পক্ষে নুর ইসলাম জানালেন, আমরা মূলত কলকাতা বইমেলায় বই প্রকাশ করি। নতুন বছর অন্য ধরনের বেশকিছু বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। বৈশাখ মাস উপলক্ষে। প্রতি বছরের মতো এবারও আমাদের প্রকাশনা দপ্তরে বসবে নববর্ষের আড্ডা। মধ্যমণি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। যাঁকে বইপাড়ায় সবাই ভানুবাবু বলেই চেনেন, জানেন। বিভিন্ন প্রজন্মের লেখকরা আসবেন। আড্ডা হবে। থাকবে মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা।
পয়লা বৈশাখ বেশকিছু নতুন বই প্রকাশিত হবে দীপ প্রকাশন থেকে। কর্ণধার দীপ্তাংশু মণ্ডল জানালেন, আমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হবে পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘না-জানা ঠাকুরবাড়ি’, দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘ছোটদের দেবারতি’, কমলেশ কুমারের ‘সোনালি রিবন’, সুমন গুপ্তর ‘কিংবদন্তি মহানায়িকার আশ্চর্য জীবনকথা সুচিত্রা সেন’ প্রভৃতি বই। কয়েকটি অন্যরকম বিষয়ের বই প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। পাঠক হিসেবে নতুন বছর পড়ব শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’, অমিতাভ ঘোষের শেষ প্রকাশিত বইটি।
নববর্ষ উপলক্ষে পাঠকদের নতুন বই উপহার দিতে চলেছে পুনশ্চ প্রকাশন সংস্থা। কর্ণধার সন্দীপ নায়ক জানালেন, নতুন বছরে আমরা একটু ভিন্নধর্মী কাজ করতে চাই। পয়লা বৈশাখ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হবে। যেমন, সুশান্ত পাল সম্পাদিত ‘বাংলা-দেশভাগ: স্মৃতি সংস্কৃতি আর্থ-রাজনীতি’, রমাকান্ত চক্রবর্তীর ‘নিধুবাবুর টপ্পা’— এটি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ। এ-ছাড়াও আগামী ১২ মে বিশ্ব জুড়ে পালিত হবে মাতৃদিবস। সেই উপলক্ষে নবীন ও প্রবীণ প্রজন্মের মেলবন্ধনে মাকে লেখা ১০১টি চিঠির একটি সংকলন প্রকাশ করা হবে। বিখ্যাত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার স্বনামধন্যদের লেখা থাকবে। সঙ্গে থাকবে অডিও বুক। লেখক-লেখিকাদের পাশাপাশি সেইসব চিঠি পড়বেন প্রখ্যাত রেডিও জকিরা। দ্রুতগতিতে কাজ চলছে।
আরও পড়ুন-প্র্যাকটিসে হাবাস, স্বস্তি দিচ্ছেন সাহাল
বার্তা প্রকাশন সংস্থা বাংলা প্রকাশনা জগতে নতুন। তবে এরমধ্যেই বেশকিছু উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশ করেছে। সংস্থার কর্ণধার সৌরভ বিশাই জানালেন, আমরা নববর্ষের আড্ডার আয়োজন করেছি। পয়লা বৈশাখ সেই আড্ডায় প্রকাশিত হবে হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপেক্ষা শেষ হয়ে গেছে’, অরিত্রিয়া চন্দ্রর ‘বৃষ্টি শেষে’, মানু গৌতমের ‘ত্বন্বি’, অভি ব্যানার্জির ‘তপ্ত গোধূলি’, সুজল দত্তর ‘ফুড়ুৎ’। সেইসঙ্গে প্রকাশিত হবে ‘শব্দসাঁকো’ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যা।
বছর বছর পয়লা বৈশাখ আসবে। প্রকাশিত হবে নতুন নতুন বই। পাঠকরা আছেন বলেই তো বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে, দিনে দিনে বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। তাই নববর্ষের প্রথম দিনে জোর দিয়ে বলাই যায়, বাঙালির বইপ্রীতি অতীতে ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।