(গতকালের পর)
পরিস্থিতি তখন হাতের বাইরে। বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া বাংলার সমাজ ও রাজনীতিকে গ্রাস করে ফেলেছে। কংগ্রেস যদি হক সাহেবের সঙ্গে সরকার গড়ত, তবে হয়ত বঙ্গভঙ্গের মর্মান্তিক দিনগুলি দেখতে হত না, এই বিষয়ে ঐতিহাসিকরা মোটামুটিভাবে একমত।
আরও পড়ুন-ক্যান্ডিডেটস দাবায় গুকেশের কিস্তিমাত, কনিষ্ঠতম চ্যাম্পিয়ন, উচ্ছ্বসিত আনন্দ
ফজলুল হক কখনও মনেপ্রাণে স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র মেনে নিতে পারেননি। যদিও রাজনৈতিক ঘটনাস্রোত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিষাক্ত সম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে তাঁর কিছু করার ছিল না। দেশ বিভাগের মুহূর্ত থেকে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে এই বঙ্গে চলে আসেন। অনেকে নিহত হন। এর অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভারতের উপর পড়ে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন এবং এই অবস্থার জন্য মুসলিম লিগ সরকারের (পূর্ব পাকিস্তান) মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনকে দায়ী করেন। তিনি আরও বলেন, হিন্দু আধিকারিকরা ও বিশিষ্ট হিন্দু অধ্যাপকরা চলে যাওয়ার ফলে প্রশাসন ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তাই যোগ্য মুসলিম অফিসার নিয়োগ করার পর বাদবাকি সমস্ত পদে অমুসলিম অফিসার নিয়োগ করা প্রয়োজন। যদি হিন্দু-মুসলিম অফিসাররা একযোগে কাজ করেন ও সমানভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ধীরে ধীরে দূর হবে। এর প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে এবং ক্রমান্বয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূর হবে। নচেৎ, তিনি সতর্ক করে বলেন, পাকিস্তানের বিনাশ অনিবার্য। মুখ্যমন্ত্রী কি গঠনমূলক পরামর্শ শুনবার লোক?
আরও পড়ুন-হিংসা-বিধ্বস্ত মণিপুরে ফের ভোট হল ১১ বুথে, বুধবার পুনর্নির্বাচন অরুণাচলের ৮টি বুথেও
উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় আশা করেছিলেন, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবাধ বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দেবে। অচিরেই তাঁরা হতাশ হলেন। প্রচার করা হল, বাংলাভাষা মুসলিম ধর্মের প্রকৃত বাহন হতে পারে না। উর্দু ভাষা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক একমাত্র জাতীয় ভাষা স্বীকৃত হল। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩.৩ ভাগ অংশের মাতৃভাষা হল উর্দু। অপরদিকে, দেশের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। শুরু হল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশাল ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। ২০ জন ছাত্র নিহত হন এবং বহু আহত হন। ফজলুল হকের হাঁটুর ওপর পুলিশের লাঠি পড়ে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই হাঁটুর ব্যথায় আজীবন তাঁকে কষ্ট পেতে হয়েছিল। অবাঙালি আমলা, পশ্চিম পাকিস্তানের ভূস্বামী ও পুঁজিপতিরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবী সমাজ ক্ষোভে ফুঁসতে আরম্ভ করলেন। এই ক্ষোভের নেতৃত্ব দিলেন ফজলুল হক। শিক্ষিত ও সচেতন বাঙালি মুসলিমরা প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করে মুসলিম লিগ বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন ও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এই বিষয়ে উদ্যোগী হন ফজলুল হক, মওলানা ভাসানি ও সোহরাওয়ার্দি। দেশ বিভাগের পূর্ব মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দির চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে। মুসলিম লিগের নেতৃত্ববৃন্দের সঙ্গে তাঁর প্রবল মতপার্থক্য হয়। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ফজলুল হক, মওলানা ভাসানি ও সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। পাকিস্তানের মধ্যে থেকেও পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবটি হকসাহেব নিজেই খসড়া করেন। বলা যায়, শেখ মুজিবের আওয়ামি লিগ এই সংগঠনের উত্তরসূরি।
আরও পড়ুন-সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোট করে বিপাকে বিজেপি প্রার্থী দেবব্রত বাগ
১৯৫৪-র ৩০ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে হকসাহেব কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গবাসী অন্তর দিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানায়। কলকাতায় একটি বক্ততায় তিনি বলেন : ‘বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। তাঁহারা একই ভাষায় কথা বলেন। তাঁহাদের আদর্শ এক এবং জীবনধারণের প্রণালীও এক।’ তিনি আরও বলেন, “আমি ‘ভারত’ শব্দটির দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কেই বুঝাইছি। এই বিভাগকে কৃত্রিম বিভাগ বলিয়াই আমি মনে করিতে চেষ্টা করিব। আমি ভারতের সেবা করিব।’ কলকাতায় অপর একটি সভায় তিনি প্রকাশ্যেই বললেন যে, “পাকিস্তান শব্দের কোনও অর্থ হয় না। ‘পাকিস্তান’ বলিতে প্রকৃতপক্ষে কিছুই বুঝায় না। উহা বিভ্রান্তি সূচনা করিবার একটি পন্থা। ইহা কেবল উদ্দেশ্য সাধনের উপায়মাত্র।”
বজ্রকণ্ঠে আরও বললেন, “দুই বাংলার মানুষে মানুষে কোনও ভেদ নাই। এই কৃত্রিম সীমারেখা আমি মানি না।” গ্র্যান্ড হোটেলের হলঘরে এক জনাকীর্ণ সভায় হকসাহেবকে শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ ইংরেজিতে ভাষণ দিতে বলেন, আবার কেউ কেউ বাংলাতে বলতে অনুরোধ করেন। বহু ভাষাবিদ ফজলুল হক বাংলা ভাষাতেই ভাষণ দেন। এই সমস্ত ভাষণের রিপোর্ট পেয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বিগ্ন হল। ঢাকা বিমানবন্দরে পা দেওয়ামাত্র তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে বরখাস্ত করে স্ব-গৃহে অন্তরীণ করা হল। কিন্তু কণ্ঠস্তব্ধ করা গেল কি? ‘শের-ই-বঙ্গাল’–এর ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন মওলানা ভাসানি, মুজিবর রহমান প্রমুখ জননেতারা।
আরও পড়ুন-দিলীপের কুকথায় কমিশনকে নালিশ
অবিভক্ত বাংলার দুই বিতর্কিত এবং চর্চিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফজলুল হক এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়— উভয়ের ভাবনা-চিন্তাধারার মধ্যে স্ববিরোধিতা ছিল মনে হয়। হকসাহেব ১৯৪০-এ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি জিন্নার দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। ভারত তথা বাংলা ভাগের অব্যবহিত পরে তিনি সাবেকি পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন। তখন অবশ্য বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একই প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। অপরদিকে, শ্যামাপ্রসাদের মতো অতি-দক্ষ ও দূরদর্শীসম্পন্ন শিক্ষা-প্রশাসক ভারতবর্ষে এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। বিশাল হৃদয়ের উদার মনোভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। তবে কেন হিন্দু মহাসভার নেতা হলেন? এই বিষয়গুলি নিয়ে আজও তেমনভাবে ঐতিহাসিক গবেষণা হয়নি। তবে সময় এবং পরিস্থিতি অনেক সময় বাধ্য করে এমন কিছু সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যেটা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা মানসিকভাবে আদৌ চাননি। ইতিহাসের বিচার বড় নিষ্ঠুর। ইতিহাস কাউকে মনে রাখে না বা ক্ষমাও করে না। ভবিষ্যতে কখনও ইতিহাস তাঁদের ভূমিকা মূল্যায়ন করবে— তাঁরা ঠিক ছিলেন কিনা?