ভিটামিন হল এমন এক ধরনের পুষ্টি উপাদান যা খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং আমাদের শরীরের বিভিন্নরকমের কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। এর অপর নাম হল খাদ্যপ্রাণ। রাসায়নিক দিক থেকে এরা হল কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনজাত এক ধরনের জৈব যৌগের একটি গ্রুপ।
নানা রকমের খাবার থেকে আমরা এর বড় একটা অংশ পেয়ে থাকি। কিছু কিছু ভিটামিন আমাদের শরীরেই সামান্য পরিমাণে তৈরি হয়ে থাকে। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’-এর তথ্য অনুসারে, ভিটামিনের অভাব হলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। রোগপ্রতিরোধ শক্তি কমে যায় এবং বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রয়োজন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনের। প্রতিটি ভিটামিনের কার্যকারিতা ভিন্ন।
আরও পড়ুন-ভারতীয় ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত টরন্টো! গুকেশে মজে কিংবদন্তি কাসপারভ
১৯১২ সালে পোল্যান্ডের এক বায়োকেমিস্ট কাশিমির ফাঙ্ক (Casimir Funk) প্রথম ভিটামিন আবিষ্কার করেন। তাঁকে ভিটামিন থেরাপির জনক বলা হয়। যার পোলিশ নামটা আসলে— Kazimierz Funk।
লন্ডনের বিখ্যাত লিস্টার ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে প্রথম ভিটামিন আবিষ্কার করেন। ভিটামিন আবিষ্কার করে নাম দেন Vitamine যা ভাঙলে হয় Vital Amine। তখন তিনি ভেবেছিলেন, এর মধ্যে Amine নামের গ্রুপের রাসায়নিক উপাদান রয়েছে।
অর্থাৎ ভিটামিনের মধ্যে Amine আছে যা শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নাম দিলেন— Vital Amine বা Life Amine। ল্যাটিন Vita মানে Life।
পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, যে সব ভিটামিনের মধ্যে Amine গ্রুপের কিছু থাকে না তাই E বাদ দিয়ে সংশোধন করে হল বানানটি দাঁড়াল Vitamin।
ভিটামিন সাধারণত দু’ধরনের— ফ্যাট সলিউবল এবং ওয়াটার সলিউবল।
ফ্যাট সলিউবল অর্থাৎ এই ধরনের ভিটামিন ফ্যাট বা চর্বিতে দ্রবীভূত হতে পারে। যেমন ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে হল ফ্যাট সলিউবল।
ওয়াটার সলিউবল হল জলে দ্রবণীয়। এদেরকে সঞ্চয় করে রাখা যায় না। জলে মিশে যায় বলে অতিরিক্ত পরিমাণে জমা হলে ইউরিনের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে। ভিটামিন সি এবং সবরকম বি ভিটামিন হল ওয়াটার সলিউবল। বি ভিটামিনের অন্তর্গত হল বি-১ (থায়ামিন), বি-২ (রিবোফ্লাভিন), ভিটামিন বি-৩ (নিকোটিনামাইড), এবং বি-৫ (ক্যালসিয়াম প্যান্টোথেনেট), বি-৬ (পাইরিডক্সিন) এবং বি-১২ (সায়ানোকোবালামিন)।
আরও পড়ুন-রোড শোয়ে মানুষের বাড়ানো মুড়ি খেলেন দেবাংশু, মিশলেন ঘরের ছেলের মতো
ভিটামিন বি-১২
এই ভিটামিন বি-১২ মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। ভিটামিন বি-১২ হল ভিটামিনের মধ্যে সবচেয়ে রাসায়নিকভাবে জটিল এবং একমাত্র ভিটামিন যা প্রাণী বা পশুর থেকে পাওয়া যায়।
কেন জরুরি এই ভিটামিন
ভিটামিন বি-১২ শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এই ভিটামিন বিভিন্ন জরুরি ক্রিয়াকলাপ করে। ডিএনএ থেকে শুরু করে লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। রক্তকণিকা ও স্নায়ুকোষের স্বাস্থ্যরক্ষায়, ডিএনএ ও জিনগত উপাদান তৈরিতে এবং হাড় ভাল রাখতেও এই ভিটামিন গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া চুল, নখ ও ত্বক ভাল রাখতেও এর জুড়ি মেলা ভার। ভিটামিন বি-টুয়েলভের অভাবে আসে প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমাদের মধ্যে এই ভিটামিন নিয়ে সচেতনতা একেবারেই নেই। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের প্রায় ৪৭ শতাংশ মানুষ এই ভিটামিনের অভাবে ভুগছেন। বিশেষত, যাঁরা নিরামিষ খাবার খান এবং যাঁরা অপুষ্টির শিকার তাঁদের মধ্যে এই ভিটামিনের ঘাটতি বেশি দেখা যায়। আর তার থেকে জন্ম নেয় বিশেষ কিছু অসুখ।
আরও পড়ুন-মালদহ ও বহরমপুরের দুই সাংসদ বিজেপির হাত শক্ত করেছে: অভিষেক
কতটা প্রয়োজন ভিটামিন বি-১২
ভিটামিন বি-১২-এর প্রয়োজন ব্যক্তিভেদে আলাদা। একজন প্রাপ্তবয়স্কের দিনে ২.৪ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি-১২-এর প্রয়োজন। গর্ভবতী নারীর এই ভিটামিনের চাহিদা হল দিনে ২.৬ মাইক্রোগ্রাম। আর সন্তানকে স্তন্যপান করানো মহিলাদের দিনে ২.৮ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি-১২-এর প্রয়োজন। তবে এই সামান্য পরিমাণ ভিটামিন বি-১২ জোগান দেওয়া সহজসাধ্য বিষয় নয়।
ঘাটতির কারণ
ডায়েটের মাধ্যমে শরীরে ভিটামিন বি-১২ পর্যাপ্ত পরিমাণে না পৌঁছালে বা পৌঁছানোর পরও তা ঠিকমতো শোষণ না হলে এর ঘাটতি হয়। এছাড়াও বিশেষ কিছু সমস্যা রয়েছে যা ভিটামিন বি-১২-এর ঘাটতির জন্য দায়ী, যেমন—
অ্যাট্রোপিক গ্যাসট্রিক
পেরনিসিয়াস অ্যানিমিয়া
ক্রোন ডিজিজ, সিলিয়াক ডিজিজ
অতিরিক্ত মদ্যপান
ইমিউনিটির সমস্যা, যেমন গ্রেভস ও লুপাস রোগ।
এছাড়াও কিছু ওষুধ রয়েছে যা এই ভিটামিন শোষণে বাধা দেয়।
ভিটামিন বি-১২-এর ঘাটতির উপসর্গ
খুব দুর্বলতা অনুভব হয়। মাথা হাল্কা লাগে।
ভিটামিন বি ১২-এর অভাবে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।
রক্তশূন্যতাও আসে, মাথা ঘোরে, দুশ্চিন্তা এবং অবসাদ তৈরি হয়।
কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ শরীর ঝিনঝিন, অবশ লাগা কিংবা বৈদ্যুতিক শকের মতো লাগে। শরীরে অসাড়ভাব।
ভিটামিন বি-১২-এর ঘাটতিতে দৃষ্টি ঘোলাটে লাগতে পারে, একটি জিনিসকে মনে হতে পারে দুটো।
চুল সাদা হয়ে যায়, চুল পড়ে। নখের স্বাভাবিক রং হারিয়ে যায় এবং ত্বকের নানা সমস্যার কারণ হতে পারে ভিটামিন বি-১২-এর অভাবে।
এর অভাবে পেটের সমস্যাও শুরু হতে পারে। পেটে সংক্রমণ, প্রদাহ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়েরিয়া ইত্যাদি দেখা যায়।
চিন্তাশক্তি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে ভিটামিন বি-১২-এর অভাব দেখা দিলে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, মস্তিষ্কের স্নায়ুর রোগ— যেমন ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্স, পার্কিনসন্সের সঙ্গে ভিটামিন বি-১২-এর প্রবল যোগ রয়েছে।
মুখে ঘা হলে অনেকেই পরামর্শ দেন ভিটামিন বি-১২ খাওয়ার। মুখের ঘা থেকে মুখের ভিতর জ্বালাভাব, দুই-ই কমাতে পারে এই ভিটামিন।
আরও পড়ুন-দেউচায় বিপুল কর্মসংস্থানের আশ্বাস, প্রায় ২৬ হাজারের চাকরি বাতিল নিয়ে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
ভিটামিন বি-১২-এর উৎস
উদ্ভিজ খাবারের থেকে প্রাণিজ খাবারে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে ভিটামিন বি-১২ থাকে। ডিম, মাশরুম, শূকর, ভেড়া, মুরগি, টার্কি, মাটন, গরুর লিভার ইত্যাদি, সামুদ্রিক মাছ, যেমন— টুনা, স্যামন, কাঁকড়া ভিটামিন বি-১২-এর দারুণ উৎস। দুধ, দই, ছানাতেও ভাল মাত্রায় এই ভিটামিন পাওয়া যায়। যাঁরা প্রাণিজ প্রোটিন খান না তাঁদের জন্য ভিটামিন বি-১২-এর ভাল উৎস হল ছোলা, পালংশাক, ছানার জল, পনির বিট, দই, ব্লুবেরি, মাশরুম, সিরিয়াল এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য; চাল, গম, ভুট্টা, টোফু, সয়ামিল্ক ইত্যাদি।