কেউ কেউ বাঙালি-বিদ্বেষী আচরণ করে এখন বাঙালি আবেগের ডিভিডেন্ড তোলার বাসনায় আগামী জন্মে বাঙালি হওয়ার আদিখ্যেতা করছেন।
ভাল কথা। খুবই ভাল কথা। কিন্তু বাংলা কী ও কেমন, সে-সম্পর্কে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা আছে তো!
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পদসঞ্চার’-এ লিখেছিলেন, ‘সপ্তগ্রাম থেকে গৌড়। বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। কর্ণফুলী-ব্রহ্মপুত্র -গঙ্গা-পদ্মার মায়া দিয়ে মাখানো। তাল-নারকেল-সুপারির জয়ধ্বজা উড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। মেঘের ছায়ায় ছায়ায় স্বপ্ন দেখে নীল পাহাড়। রৌদ্রের ঝিলিক ঝলে নীলকণ্ঠ পাখির পাখায়। জ্যোৎস্নার দুধ-সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে যায় হংস-বলাকা। পলিমাটির চন্দনডাঙায় শ্বেতপদ্মের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে থাকে বকের দল।’ এই বাংলার সঙ্গে, বঙ্গদেশের নিসর্গের এই অন্তর-আকৃতির সঙ্গে পরিচয় আছে ওঁদের? স্পষ্ট বলছি, আগে পরিচিতি হোক, তারপর না হয় বাঙালি হওয়ার কথা ভাববেন।
আরও পড়ুন-অবশেষে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির পূর্বাভাস!
ব্রজেন্দ্রকুমার দে, কবিতা কিংবা উপন্যাস কিংবা নাটক নয়, যাত্রাপালা লিখতেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘দেখলুম বাংলার আসল পরিচয় প্রাসাদে নয়, বস্তিতে। শহরে নয়, পল্লীতে। চাষাভুষো তাঁতি জোলার মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের কোনও প্রভেদ নাই। প্রভেদ শুধু এই খানে, নবাবে আর রাজায়, পণ্ডিতে আর মৌলবীতে।’ যাঁরা মুসলমানকে অপদস্থ করে হিন্দুগরিমা প্রচার করে ভোট ব্যাঙ্কে সিমেন্ট লেপতে মরিয়া, তাঁরা কি এই বাংলার সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা গড়ে তুলতে পারবেন? এখনও পর্যন্ত তো তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
শুধু ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ বললেই তো হয় না। বাংলার আকাশকে বাতাসকে আপন প্রাণে বাঁশি বাজানোর অবকাশ রচনা করে দিতে হয়। সেজন্য নৃতাত্ত্বিক পরিভাষার কচকচানি পরিত্যাগ করে সহজভাবে স্বীকার করে নিতে হয়, আজকের বাঙালি অনার্য আর্য মঙ্গােলীয় সেমীয় নিগ্রো প্রভৃতি নানা গোত্রভুক্ত মানবের রক্ত সংমিশ্রণজাত এক বিচিত্র জনসমষ্টি। একথাটা স্বীকার করার মতো মেধার প্রাখর্য কিংবা বোধের ঔদার্য গেরুয়া গুহায় কাটানো মানুষজনের আছে তো? না থাকলে, বাঙালি হয়ে উঠবেন কী করে?
আরও পড়ুন-আদিবাসীদের জন্য একের পর এক প্রকল্প, মনে করালেন নেত্রী
আসলে, বাঙালি হতে চাইলে বিবেকানন্দ আর সুভাষচন্দ্রকে বুকনিতে নয়, আদর্শে-নৈতিকতায় আধার করে নিতে হয়। মনে রাখতে হয়, ভারতের রাজনীতিতে সুভাষচন্দ্র বসু ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রতিভূ ছিলেন। তিনি ধর্মীয় ও জাতিগত সংকীর্ণতাকে কোনও দিন তাঁর চিন্তার জগতে স্থান দেননি। তাঁর ভারত-ভাবনা সাভারকর, গোয়ালকরদের ভারত ভাবনার থেকে আলাদা ছিল। তিনি এদেশে হিন্দু অতীতের পুনর্নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি জানতেন এবং মানতেন, ভারতে মুসলমান শাসকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ একটা নতুন সমন্বয়ের ধারা গড়ে উঠেছিল। ‘দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ বইতে তিনি সে-কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।
সুভাষচন্দ্র যখন রেঙ্গুনে গিয়েছিলেন তখন তিনি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে চাদর চড়িয়েছিলেন, আবার কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট উৎখাতে তিনি তৎপর হয়েছিলেন কারণ হলওয়েল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রে কালিমালেপন করতে উৎসাহী ছিলেন। স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরি জানাচ্ছে, বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু মহাসভার সংযুক্তির সদা বিরোধী ছিলেন সুভাষচন্দ্র, কোনওদিন চাননি হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি বাংলার ও বাঙালির রাজনৈতিক চেতনায় জায়গা পাক। মনে রাখতে হবে, সেই হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরী আজকের বিজেপি। তারাই এখন মোগল শাসকদের অবদান অস্বীকার করতে, নবাব সিরাজকে পুনরায় কালি মাখাতে উঠেপড়ে লেগেছে।
রাজনৈতিক মতানৈক্য ছিল, তবু, তবুও ১৯৪২-এ মহাত্মা গান্ধীর ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে সমর্থন করতে দ্বিধা করেননি সুভাষচন্দ্র, গোয়ালকর, সাভারকর প্রমুখ বিজেপির পূর্বসূরীরা তখন কমিউনিস্টদের মতোই সেই আন্দোলন থেকে নিজেদের ও নিজ নিজ সমর্থক অনুগামীদের দূরে সরিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিলেন। সেদিনও সুভাষচন্দ্রের বিপ্রতীপে অবস্থান ছিল রাম ও বামের।
আরও পড়ুন-অবশেষে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির পূর্বাভাস!
ব্রিটিশ-বিরোধী বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। তাই আগ্রহী ছিলেন মজলিশ-ই আহরার, আজাদ মুসলিম লিগ ও অকালি দলের হাত ধরার বিষয়ে। আজাদ হিন্দ ক্যান্টিনে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সবাই একসঙ্গে খেত। আজাদ হিন্দ রেডিয়োতে চালু হয়েছিল ‘আজাদ মুসলিম রেডিও’ সার্ভিস। দায়িত্বে ছিলেন হবিবুর রহমান ও এ এম সুলতান। দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষবৃক্ষে যখন সার দিচ্ছিল ব্রিটিশরা, জল ঢালছিল হিন্দু মহাসভা আর মুসলিম লিগ। তখন সুভাষচন্দ্র মহাজাতির জাগরণের জন্য বীজতলা প্রস্তুত করছিলেন। বাঙালি হতে চাইলে সে কথাটা বুঝতে ও মানতে হবে। সে-ক্ষমতা এই জুমলাবাজ ন্যাকা নেতাদের আছে?
৩ মে ১৯৪০-এর ফরোয়ার্ড ব্লক পত্রিকার সম্পাদকীয়, সেখানে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশে এবং অন্যত্র হিন্দুদের মন বিষিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক বিষ উদ্গার করে চলেছে। এদের সম্পর্কে সতর্ক হওয়া দরকার। একথা আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক।
১৮ জুন, ১৯৩৮-এ কুমিল্লায় দেওয়া ভাষণ। সেখানে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘হিন্দুরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া হিন্দুরাজ্যের ধ্বনি কেবল অলস চিন্তা।’ সে-কথাটাও আজ বেশি বেশি করে মনে রাখা দরকার।
এত কিছু জেনে বুঝে ও মেনে বাঙালি হতে পারবেন তো মোদিবাবু?
বোধ হয় না। দরকারও নেই। বাঙালি ওঁর বিদায় চায়।