মৃণাল সেন এবং কলকাতা যেন অবিচ্ছেদ্য। নগরজীবন নানারূপে ধরা দিয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবিতে। ফুটে উঠেছে ভাল দিক, মন্দ দিক। সদাব্যস্ত মহানগর তাঁকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। তিনি বাধ্য হয়েছেন নগরকেন্দ্রিক এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে যেতে। তাঁর ছবি যেন সময়ের দলিল। শহরের দলিল। এই প্রসঙ্গে উঠে আসে তিনটি ছবির নাম, ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১), ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) এবং ‘পদাতিক’ (১৯৭৩)। তিনটি ছবি পরিচিত মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ট্রিলজি’ নামে। কী কী দেখিয়েছেন তিনি? নাগরিক জীবন, বস্তি থেকে রাজপথ, বিপ্লব, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ঔপনিবেশিকতা, সন্ত্রাসবাদ, বেকারত্ব, সামাজিক প্রতারণা, নিপীড়ন, ভণ্ডামি ইত্যাদি। নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন ছবি তৈরির সময়। সৎ থেকেছেন শিল্পের প্রতি।
কলকাতা এসেছে তাঁর আরও কিছু ছবিতে। যেমন ‘মহাপৃথিবী’। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একটা বিশেষ সময়ের শহরকে। বিশেষ সময়, উত্তাল সময়। যখন মহানগরের বাতাসে বারুদের গন্ধ, গলির মুখে যুবকের লাশ। সমস্তকিছুর কেন্দ্রে সেই কলকাতা।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় আরও একটি ছবির কথা। সেটা ‘চালচিত্র’ (Chaalchitra Ekhon)। ১৯৮১ সালে তৈরি। অভিনেতা হিসেবে অঞ্জন দত্তের প্রথম ছবি। খুব বেশি মানুষ দেখার সুযোগ পাননি। কারণ ছবিটা এখানকার সিনেমাহলে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়নি। তবে দেখানো হয়েছে ভেনিস-সহ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে। হয়েছে উচ্চ প্রশংসিত, পুরস্কৃত। একটা সময় কলকাতা দূরদর্শনে প্রদর্শিত হয়েছে কয়েকবার।
‘চালচিত্র’ও কিন্তু পুরোদস্তুর নাগরিক ছবি। কেন্দ্রীয় চরিত্র কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক যুবক, দীপু। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক। সংবাদপত্রে লিখতে চান। পেতে চান সাফল্য। সম্পাদক তাঁকে মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে একটি আর্টিকেল লেখার বরাত দেন। ভাবনাচিন্তা শুরু হয় দীপুর। যেভাবেই হোক, লাগবে একটা ঘটনা। কিন্তু চাইলেই তো আর চট করে পাওয়া যায় না। চলতে থাকে খোঁজ। এইভাবেই তিনি চারপাশের পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখেন, চিনতে থাকেন। তাঁর মনে জাগতে থাকে বেশকিছু প্রশ্ন। কিছু সহজ, কিছু জটিল। কিছু প্রশ্নের উত্তর পান, কিছু পান না।
শহরের এমন একটা বাড়িতে তাঁর বসবাস, যেখানে বারো ঘর এক উঠোন। প্রতিবেশীদের মধ্যে নিত্য কলহ। নানা বিষয়ে। দীপু বিষয়গুলোকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। আর্টিকেল লেখার জন্য। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর চোখে মন্দের পাশাপাশি নির্ভেজাল কিছু আলোকিত মুহূর্তও ধরা পড়ে।
আরও পড়ুন-প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি ৩ দেশের
আটের দশকের সেই ‘চালচিত্র’ ছবিটি সম্প্রতি অন্যরূপে ফিরে এসেছে অঞ্জন দত্তের পরিচালনায়। ‘চালচিত্র এখন’ নামে। এই ছবি পরিচালক মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে শিষ্য অঞ্জনের শ্রদ্ধাঞ্জলি৷ ছবিতে অঞ্জন অভিনয় করেছেন মৃণাল সেনের চরিত্রে। চরিত্রটির নাম কুণাল। পাশাপাশি অঞ্জনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাওন চক্রবর্তী। তাঁর চরিত্রের নাম রঞ্জন। রিমেক বা বায়োপিক নয়, ছবিটি তৈরি হয়েছে মূলত ‘চালচিত্র’র মেকিং নিয়ে। মৃণাল সেনের সঙ্গে অঞ্জনের পরিচয়, অভিনেতা নির্বাচন, শুটিং ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এটা মূলত দু’জন মানুষের অসমবয়সি বন্ধুত্বের গল্প।
‘চালচিত্র’র (Chaalchitra Ekhon) কেন্দ্রবিন্দু এক উঠোন বারো ঘর। তবে ছবিটি শুধুমাত্র বাড়ির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি। ঘুরেফিরে এসেছে শহরের রাজপথ, গলি। ক্যামেরা ছুটেছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। ব্যাগ কাঁধে দৌড়নো যুবকের পিছনে। ধরা পড়েছে নানা মুহূর্ত। বাস, ডবলডেকার, গাড়ির হর্ন, শহুরে কোলাহল, ব্যস্ততা। বাড়ির বাইরের মানুষগুলোর ছবিও মূল চরিত্রের সামনে অন্য ভাবে ফুটে ওঠে। আলোর পাশাপাশি ধরা পড়ে কালো। শহরকে দেখা এবং জানা হয়ে যায় নতুন ভাবে। ‘চালচিত্র এখন’ ছবিতেও দেখানো হয়েছে সমস্তকিছু। তবে একটু অন্য ভাবে।
প্রথম ছবিতেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন অঞ্জন। দীপুর চরিত্রে করেছিলেন সাবলীল অভিনয়। তিনি যে ক্যামেরার সামনে রয়েছেন, বিন্দুমাত্র বোঝা যায় না। এতটাই স্বাভাবিক তাঁর হাঁটাচলা, কথাবার্তা। জানা যায়, তাঁকে নাকি ভরপুর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন পরিচালক। তাই নবাগত অভিনেতা নিজের মনের মতো চরিত্রটি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। খাঁটি নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকের চরিত্রে তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ, বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘চালচিত্র এখন’ ছবিতে অঞ্জনের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন শাওন। ডায়লগ থ্রোয়িং, চোখের ভাষা, অভিব্যক্তি সবকিছুই নজর কেড়েছে। তিনি কিন্তু অঞ্জনকে হুবহু কপি করার চেষ্টা করেননি। চরিত্র নির্মাণ করেছেন নিজের মতো করে। অঞ্জনও তাই। মৃণাল সেনকে নকল করার পথে পা বাড়াননি। লুকের দিকে বিশেষ মনোযোগী না হয়ে দু’জনেই বাজিমাত করেছেন অভিনয়ে, সংলাপে, চঞ্চলতায়।
অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিদীপ্তা চক্রবর্তী, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সুপ্রভাত দাস, কঙ্কণা হালদার, রূপঙ্কর বাগচী, মেঘলা দাশগুপ্ত, দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়। সংগীত পরিচালনায় অঞ্জন এবং নীল দত্ত। চিত্রগ্রাহক প্রভাতেন্দু মণ্ডল, সম্পাদক অর্ঘ্যকমল মিত্র, প্রযোজনা অঞ্জন দত্ত প্রোডাকশন।
ছবিটি নন্দনে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আন্তর্জাতিক বিভাগে প্রথম প্রদর্শিত হয় এবং বিশেষ জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। ঢাকায় দ্বাবিংশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয় এবং সেখানে অঞ্জন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। ১০ মে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে কলকাতার কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ এবং হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে।
‘চালচিত্র’ (Chaalchitra Ekhon) ছিল মৃণাল সেনের একটি মাস্টারপিস। হয়তো ছবিটি ঘিরে উন্মাদনা কম। খুব বেশি মানুষ দেখার সুযোগ পাননি। তাতে কী? যুগ যুগ ধরে বহু উৎকৃষ্ট শিল্পই থেকে গেছে দৃষ্টির অগোচরে, কোলাহলের বাইরে, আলোচনার বাইরে। তবে ‘চালচিত্র এখন’ বহু দর্শকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এই ছবিটির সূত্রেই আগ্রহ তৈরি হয়েছে মৃণাল সেনের মূল ছবিটি ঘিরে। ছবিটি মৃণাল সেনকে নতুন ভাবে চিনতে, জানতে সাহায্য করে। অঞ্জন আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করলেন। বুঝিয়ে দিলেন গিটার, দার্জিলিং, বড়দিন, বো ব্যারাকস, ব্যোমকেশ ছাড়াও তিনি এগোতে পারেন। পারেন সাফল্য মুঠোয় পুরতে। ছবিটি তাঁর একটি মাস্টারপিস হয়ে থাকল।