প্রদীপ আচার্য: ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিনেই একটা জবর কাণ্ড করে দেখাল অরণি। সবাই খুব তারিফ করল। সবাই সমস্বরে বলল, ‘বাহবা, বাহবা বেশ।’ সত্যিই তো এভাবে তো কেউ ভেবে দেখেনি! এমন একটা কাণ্ড তো করাই যেতে পারে। এমন অভিনব ভাবনা যে কারও মাথায় আসতে পারে, সেটাই তো কেউ ভাবতে পারেনি। ভাবনাটা শুধু অরণির মস্তিষ্কে চুপচাপ সিঁধিয়ে গেছে। রাজনীতিতে অরণির মন্ত্র হল, করে খাওয়া নয়, করে দেখাও।
সেই করেই দেখিয়ে দিল অরণি। ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন সন্ধেবেলা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিল সে। ব্যাপারটা বেশ চমকপ্রদ। কিন্তু শুধুই কি চমক? ঘোরতর শত্রু যে, তাকেও স্বীকার করতে হবে অরণির এই অভিনব ব্যাপারটা শুধু দেখনদারি নয়, প্রশংসারও বটে।
রাজনীতিতে চমক ও গিমিকের অনেকগুলি পাহাড় আছে। সেইসব পাহাড়ের কথা অনেক পুরনো। মানুষ শেষ তক বলেছে, ও এই ব্যাপার? তাই শুধুই চমক দিয়ে কিছু মানুষকে তাৎক্ষণিক সুড়সুড়ি দিতে চায় না অরণি।
আরও পড়ুন-বিশ্ব উদ্বাস্তু দিবসের ভাবনা
সবাই যখন এক বাক্যে বলবে, বাঃ! তখনই তো কিছু করে দেখানোর আসল মজা। সবাইকে খুশি করা অবশ্য শিবেরও অসাধ্যি। স্বয়ং বিসমিল্লাও নাচার। অরণির ক্লাস ছিক্সের বইতে মিলার অ্যান্ড হিজ ডাংকি গল্পের সেই মরালটা? সেই যে ‘ইউ কান্ট প্লিজ এভরিবডি, হি হু ওয়ান্টস টু প্লি এভরিবডি, ক্যান প্লিজ নো বডি।’ অরণি তাই মাঝেমধ্যেই মনে মনে আওড়ায়, ‘সো অ্যা’ম নট টু প্লিজ এভরিবডি।’
সেদিন ভোটপর্ব মিটিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই আইডিয়াটা পিলপিল করে খেলে গেল অরণির মাথায়। বাতাসে এক ধরনের নেশা ধরানো ধুম লেগে আছে। ফাল্গুনি হাওয়া তো। সারাদিন বুথে বুথে চক্কর দেওয়ার পরেও ক্লান্তি নেই। মনটা যেন ভরে আছে কী এক অচেনা ভাললাগায়।
সুতনুকা এক কাপ তোফা চা দিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই ব্যাপারটা খেলে গেল অরণির মাথায়। সে সুতনুকাকে ডেকে বসাল। বলল ব্যাপারটা। শুনে সুতনকা একগাল হেসে গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘সত্যি তোমার মাথায় আসেও।’
‘ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন সন্ধেবেলা ব্যাপারটা ঘটাতে পারলে কেমন হয়?’
‘করতে পারলে তো দারুণ ব্যাপার হবে।’ অরণি বলল, ‘ব্যস, হোম মিনিস্ট্রি গ্রিন সিগনাল দিয়েছে, তখন হচ্ছেই। ডিসিশন পাক্কা।’ সেই থেকে বুঁদ হয়ে বসে বসে ভাবনার বাস্তব রূপ কল্পনা করেছে অরণি। অনেকগুলো ফোন এসেছে ধরেনি। সে যেন এই জগৎ সংসার থেকে অনেক দূরে রয়েছে।
আরও পড়ুন-আইসক্রিমের রূপকথা
রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে ফোনাফুনি সেরে ফেলল। টপ সিক্রেট। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়। পরদিন কাকভোরেই বাইক ছুটিয়ে এসে হাজির বিল্টু। স্কুটার ছুটিয়ে এল শুভ। সাইকেলে চলে এল বাবলু। ওদের তিনজনকে পাখি পড়িয়ে দিল অরণি। বলল, ‘খুব সাবধান, দেখবি চার গুলিয়ে দিস না। হিতে বিপরীত না হয়। অরণি এই শহরের পাঁচবারের কাউন্সিলর। সেই আগের জমানা থেকেই। এখন ভাইস চেয়ারম্যান। হলে কী হবে? সে তো অজাতশত্রু নয়। অবশ্য শত্রু থাকলেও ক্ষতি কিছু নেই। শত্রুরাই বরং ভুলত্রুটিগুলিকে খুঁচিয়ে দিয়ে বন্ধুর মতো উপকারই করে। যারা সামনে দাঁত ক্যালাবে, আড়ালে ফোলা বেলুনে পিন মেরে দেবে। অরণি তাই বিল্টু আর শুভকে পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘টপ সিক্রেট। আগেই পাঁচ কান হয়ে গেলে ব্যাপারটা আর তেমন থ্রিলিং হবে না।’ অরণি বলেছে, ‘অরবিটের মনসুরকে বলবি, রাতে বাড়িতে বসে যেন কার্ডের ডিজাইন করে শ’খানেক ডিজিটাল প্রিন্ট করিয়ে নেয়। কাজটা যেন মনসুর নিজে করে। রামাশ্যামাকে দিয়ে করাতে গেলে মাছি গলে যাবে। চোনা পড়ে যাবে।’
আরও পড়ুন-
সবার সঙ্গেই অরণির সদ্ভাব। তাই সাড়াও পেয়েছে। তবু গোড়া থেকেই এক অপার উত্তেজনা ও এক অজানা আশঙ্কায় অরণির বুকের ভেতরটা কেঁপেছে। তবে সেটা মামুলি, তেমন কিছু নয়। ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর দিন বরং ক্যান্ডিডেটদের টেনশন হয়। অরণির সে নিয়ে কোনও টেনশন নেই। ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন সে যে চমক দিতে যাচ্ছে, সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারবে কি না, সে নিয়েই ওর টেনশন ছিল।
ঋষিরা চলে গেছেন। তবে মুনিরা তো রয়ে গেছেন। তাঁরা দেশের ১৩০ কোটির আত্মায় ভর করে আছেন। একালে সবাই মুনি। তাই নানা মুনির নানা মত। বাসে ট্রামে ট্রেনে এমন লেকচার ঝাড়বে শুনলে পুরাণের মুনিরাই ভস্ম হয়ে যাবেন। বেশির ভাগ লোকই খবরের কাগজের বিদ্যে ফলায়। অরণি তাই এইসব মানুষ নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে চায়। বছরের পর বছর ভেল্কিবাজির রাজনীতিতে অভ্যস্ত মানুষকে কাটোয়ার ডাঁটার মতো সিধে করার কাজটা যে দুরূহ, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে অরণি। এখনও পাচ্ছে। খুঁত ধরা খুঁতখুঁতুনি মানুষের তো অভাব নেই। এইসব মানুষ কোনও খুঁত না পেলে বলবে ‘এত ভাল ভাল নয়। এটা আবার বাড়াবাড়ি’। তা বাড়াবাড়িই হোক না একটু। তাতে যদি কারও ক্ষতি না হয়, তাহলে গায়ে ফোস্কা পড়বে কেন? অরণি যে প্ল্যান করেছে, তা একটু বাড়াবাড়ি হলেও হোক না। পড়ুক না কিছু লোকের গায়ে ফোস্কা। কিছু লোক তো তেড়া ঘাড় নিয়েই জন্মেছে। রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে এসবই সাতপাঁচ ভাবছিল অরণি। তখনই মোবাইলের স্ক্রিনে স্যার কলিং ভেসে উঠল। কল রিসিভ করে চমকে উঠল অরণি। কথাটা স্যারের কানে তুলল কে? স্যার বললেন, ‘দিবাস্বপ্ন দেখার অভ্যেসটা তোর যায়নি দেখছি। একটা উড়ো খবর শুনলাম। করতে পারলে অবশ্য খুবই ইন্সপায়ারিং ইন্সট্যান্স হবে। উইশ ইউ গুডলাক।’
আরও পড়ুন-আগামীর পড়ুয়াদের অতীত, না-চেনাতে এবার বইয়ে বদল
উড়ো খবর? মানে কী? তার মানে খবরটা কি হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে? তাতে অবশ্য ক্ষতি কিছু নেই। আগেই জানাজানি হয়ে গেলে ব্যাপারটা আর সারপ্রাইজ থাকবে না। তারপর কানভাঙানি লোকেরও অভাব নেই।
ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিনটিকে টার্গেট করেই এগিয়েছে অরণি। নিজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আসল কাজটা সেরে রেখেছে। সবাই হাসিমুখে রাজিও হয়েছে। এই পুরভোটে নিজের জয় নিয়ে কোনও সংশয় নেই তার। তার বড় কারণ, এই এত বছরে অরণি এই ওয়ার্ডের সব হেঁশেলের রান্নাই বলতে গেলে চেখে দেখেছে। সারাবছরই সে মাসিমা, কাকিমা, দিদি, বউদি ডেকে ‘এটা কী রান্না হচ্ছে? ও ঝিঙেপোস্ত? ফাটাটাটি! একটু দাও টেস্ট করি।’ আড়ালে নারীমহলে বলাবলি হয়, অত বড়ঘরের ছেলে দেখো কোনও অহংকার নেই। ব্যস, মহিলাদের মন জয় করতে পারলেই ভোটে জয় নিশ্চিত। তাই পরপর পাঁচবারই জিতেছে। এবার জিতলে ছ’বার হবে।
আরও পড়ুন-মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা
আগের জমানায় ভোটের সময় ছাড়া কাউন্সিলরদের টিকির দেখাও পেত না কেউ। সতুপিসির জামরুল গাছের ডালপাতা পড়ে রতন দাসের উঠোন নোংরা হচ্ছে, তার সমাধানও নাকি করবে পার্টির উঁচুমহল। ধাপে ধাপে কমিটির সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠে পার্টির সিদ্ধান্ত নেমে আসতে আসতেই সতুপিসির শ্রাদ্ধশান্তিও চুকেবুকে গেল। সমস্যা জিইয়ে না রেখে সমস্যার সমাধান করলে নাকি নিজেদেরই সমাধি হয়ে যাবে। সুতরাং সমস্যাকে জিওল মাছের মতো জিইয়ে রাখো। অল্পজলে খাবি খেতে দাও। আর ‘আমরা আছি আমরা আছি’ বলে আমড়াগাছি গল্প ঝেড়ে যাও। সেই পার্টির প্রার্থীদেরও ডেকেছে অরণি। সব দলেরই প্রার্থীরাই এসেছে। রীতিমতো ডিজিটাল প্রিন্টের ছাপা নেমন্তন্ন কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করেছে অরণি। সবাই এসেছে। নেমন্তন্ন কার্ডে অরণি লিখেছে, এবার ভোট হল ভরা বসন্তে। তাই ভোটের ফল বেরোনোর আগের সন্ধ্যায় আমরা কবিগুরুর গানের ভাষায় বলতে চাই, ‘আজি সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে।’
আরও পড়ুন-উর্দি ছেড়ে কোচিং শিক্ষক পুলিশ
এই মিলনমেলার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে শিবমন্দিরের খোলা প্রাঙ্গণ। রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গান বাজছে মাইকে।
বাজল খোল করতাল। সব রঙের আবির মাখামাখি হল। মিলনমেলা হয়ে উঠল মিলনতীর্থ। একাকার হল সব দলের রঙেরই আবির। মিষ্টিমুখও হল। অরণি তার ছোট্ট ভাষণে বলল, ‘ভোটে জেতার পর যে যার দলের রঙের আবির মাখি আমরা। কিন্তু আমাদের রাজনীতি আলাদা হলেও আমাদের সমাজ তো একটাই। তাই আগামিকাল ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন আসুন আমরা পরস্পরের আবিরের রং বিনিময় করি। সবার রঙে রং মিশিয়ে নিই।’ সঙ্গে সঙ্গে মাইকে রবিঠাকুরের গান বেজে উঠল, ‘আজি সবার রঙে রং মেশাতে হবে।’ সবাই সমস্বরে বলল, ‘বাহবা বাহবা বেশ। আহা! ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।’