মনের মধ্যে নরম আনন্দের সঞ্চার করে কবিতা

বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমীদের কাছে পরিচিত নাম রফিক উল ইসলাম। দীর্ঘদিন নিয়োজিত আছেন সাহিত্য সাধনায়।

Must read

অংশুমান চক্রবর্তী: বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমীদের কাছে পরিচিত নাম রফিক উল ইসলাম। দীর্ঘদিন নিয়োজিত আছেন সাহিত্য সাধনায়। লেখালিখির পাশাপাশি করেন সম্পাদনা। গতবছর আবিষ্কার থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘অঘোরে ঘুমিয়ে চন্দ্রকণা’। নামটা কৌতূহল জাগায়। আগ্রহী করে তোলে পাতার পর পাতায় যেতে। বইটিতে আছে ছোট ছোট বেশকিছু কবিতা। প্রত্যেকটা মাত্র কয়েক পংক্তির। দেখা যায় মেধা ও মননের মহা সম্মিলন।
‘মেঘ’ কবিতায় কবি লিখছেন :
‘এটুকু জেনো শুধু, আকাশেরও হাত আছে,/ সে-হাত দিয়ে তোমার চুলে মেঘ দেবে ভরে।/ যদি তুমি ঠিকঠাক মাথা উঁচু করে রেখে/ চলে যেতে পারো তার অপরূপ স্নানঘরে!’
আপাতভাবে মনে হতে পারে নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা। হয়তো তাই-ই। তবে আমার মনে হয়েছে, কবিতাটির ব্যাপ্তি বিরাট। এরমধ্যে মেঘজন্মের সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট। তুমুল হাওয়ায় ঢেউ ওঠে কৃষ্ণঘন চুলে। চুল তখন হয়ে যায় বেগবতী নদী। তুমুল তাপে নদীর জল হয় বাষ্পীভূত। জন্ম নেয় মেঘ। বৃষ্টি। উন্মুক্ত সিক্ত পৃথিবী যেন হয়ে উঠেছে অপরূপ স্নানঘর। অসীমের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায় কবিতাটির। ভাল লাগে।
অসাধারণ এক নিবেদনের কবিতা ‘দরজা’। কবি লিখছেন :
‘বন্ধ দরজার ওপারেই তুমি আছো।/ আমি তো জানি, আর দরজায় মাথা কুটি–/ হে ওপার, আমাকেও একটু সঙ্গ নিয়ে বাঁচো?’
প্রিয়জনের প্রতি এই গভীর নিবেদন। প্রিয় মানব অথবা মানবীর প্রতি। অবশ্যই। তবে যিনি আরাধ্য, তাঁর প্রতি নয় কি? ‘হে ওপার’ প্রয়োগটি ভাল লাগে। আছে সম্ভ্রম। বোঝানো হয়েছে নিখুঁত দূরত্ব। আছে একটা তীব্র আর্তি। তবে কবিতার শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। বিস্ময়সূচক চিহ্ন যথাযথ হতে পারত। হয়তো আরও জোরালো হত নিবেদন।

আরও পড়ুন-উর্দি ছেড়ে কোচিং শিক্ষক পুলিশ

অন্ত্যমিলের ব্যবহার আছে কয়েকটি কবিতায়। আছে নিখুঁত মিল এবং মাত্রার প্রয়োগ। আমরা জানি, ছন্দ ভাঙতে হলে ছন্দ শিখতে হয়। কবিতাগুলো পড়ে মনে হল, এই কবি ছন্দে সিদ্ধহস্ত।
‘নদীকে’ কবিতায় কবি লিখছেন :
‘আস্ত একটি নদীকে যদি তোমার আঁচলে বেঁধে দিই,/ তুমি কি পুরোপুরি নদীরই হয়ে যাবে?/ আমি যে অপূর্ণ, ভাঙাচোরা, তাই বলে কি সকল আমি/ অবহেলার ঘূর্ণিপাকে একাকী হারাবে?’
এক অভিমানী স্বর ধরা পড়েছে কবিতায়। দুটি প্রশ্নে লেগে রয়েছে অসহায়তা। অক্ষরে অক্ষরে মিশে রয়েছে নির্ভেজাল সারল্য। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ থাকলেও এই কবিতা সম্পূর্ণ মানবিক।
অনবদ্য প্রেমের কবিতা ‘বৃষ্টি’। চোখ রাখা যাক কবিতায় :
‘আজ বৃষ্টি ভিজে গেছি খুব,/ এসো জ্বর হয়ে, সর্বাঙ্গে জড়াও!/ তাপ-উত্তাপ বোঝে নাকি থার্মোমিটার? সবটুকু উষ্ণতা তুমিই মেপে নাও…।’
বিষয়বস্তু সাবেক। তবে ‘তাপ-উত্তাপ বোঝে নাকি থার্মোমিটার?’ উচ্চারণটি স্বতন্ত্র। কবিতাটি শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে তুমুল শরীরী।
ভালো লাগে ‘রাজপাট’, ‘হাওয়াবিবি’, ‘মসজিদের অনেক ভেতরে’, ‘ক্লান্ত পথের শেষে’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। দেবাশিস সাহার চিত্রভাষা প্রশংসনীয়। বইটি সংগ্রহযোগ্য। দাম ২০০ টাকা।

আরও পড়ুন-তুমি অনেকেরই প্রেরণা, কার্তিককে হার্দিক

পৌষালী প্রকাশনী থেকে গতবছর বেরিয়েছে সুদীপ্তা রায়চৌধুরী মুখার্জির কবিতার বই ‘এবং দোয়েল সাঁকো’। এই কবি বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি করেন সাহিত্যচর্চা। আলোচ্য বইটিতে আছে বিভিন্ন স্বাদের কবিতা। শুরুতেই দোয়েল সাঁকো সিরিজ। এই সিরিজে আছে ২৫টি কবিতা। প্রতিটি কবিতায় দেখা যায় চমকে দেওয়ার মতো উচ্চারণ। ভাব ও ভাষায় স্বতন্ত্র। কোনও কবিতা কুয়াশায় মোড়া, কোনও কবিতা স্পষ্ট। প্রায় প্রত্যেকটাই কবিতাই বড়বেশি এই সময়ের। ১৬ সংখ্যক কবিতায় কবি লিখছেন :
‘আগে যে লেকে ফুল ফুটতো,/ পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমাতো/ সেখানে নাকি আজ আর কেউ শব্দের লেনদেন করে না?/ বাজারি প্রতিযোগিতার দাপটে ভেসে গেছে/ সব ঐকান্তিক সুখ পণ্য পশরায়?/ শুধু থই থই করে তোর চির অপ্রিয় ভিড়।’
এই কবি তুমুল সমাজ এবং পরিবেশ সচেতন। তথাকথিত কৃত্রিম অত্যাধুনিক জীবনযাপন আজ নষ্ট করেছে প্রকৃতির ভারসাম্য। ছত্রে ছত্রে দেখা যায় এক উদ্বিগ্ন মনের প্রকাশ।
সিরিজের ২২ সংখ্যক কবিতাটিতে অদ্ভুত এক মায়া লেগে রয়েছে। মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে শরীর এবং প্রকৃতি। কবিতার শুরুটা এইরকম :
‘ধুন্ধুমার কুয়াশা মোড়া রাতে/ ভেসে আসা তারার বারান্দায় জ্যোৎস্নার আলো ওম ছড়ায়,/ বেহিসেবি ছাদের নিপাট আলসে জোছনার অনচ্ছ আলোয় যেন নির্জনের লিফলেট…।’

আরও পড়ুন-পেট্রাপোল সীমান্তের পার্কিং লটে তিন পণ্যবোঝাই গাড়িতে আগুন

ভাল লাগে ‘নির্জনের লিফলেট’ প্রয়োগটি। পরিবেশ শান্ত। তাহলে কুয়াশা মোড়া রাতটি ধুন্ধুমার কেন? বর্ণনার মধ্যে যখন প্রকৃতির বিরূপতা অনুপস্থিত। হতে পারে এই ধুন্ধুমার শরীরী ধুন্ধুমার। রচনা করেছে এক আলুথালু মিলন মুহূর্ত। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের সূচনায় কবি লিখছেন :
‘অন্ধ শরীর জুড়ে প্রবাসী রাত্রি নামে,/ নশ্বর পৃথিবী নিবু নিবু সুখ পোহায় নক্ষত্র বিবাহের হোমাগ্নিতে,/ তবু কিছু কথা উঠোন কেন এলোমেলো করে!’
অর্থ আরও কিছুটা স্পষ্ট হয়। বোঝা যায়, রচিত হয়েছে এক বিবাহ মুহূর্ত। বিবাহ দুই নক্ষত্রের। হয়তো রাতের আকাশের, নয়তো রক্তমাংসের। কবি লিখেছেন ‘অন্ধ শরীর জুড়ে প্রবাসী রাত্রি নামে’। এই শরীর অন্ধ কেন? আলোর স্বাদ অধরা বলে? অনন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা, তাই? সম্ভবত। কিন্তু রাত্রি প্রবাসী কেন? সে কি দূরের কেউ? অচেনা বা সামান্য চেনা? হয়তো বা। মায়া তো বটেই, সমগ্র কবিতা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে গভীর আলোকালো রহস্য।
প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির মধ্যে সেতুবন্ধন করেছে ‘শোকনামা’ কবিতাটি। কবি লিখছেন :
‘প্রেম থেকে ভ্রমে ধাবিত হতে হতে/ এক নামহীন স্টেশনে খুঁজে পেলাম তোমাকে।/ তোমার দশ আঙুলে আজও লেগে আছে নির্ভরতার আতর,/ আমার মায়াজন্মের সমস্ত কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়…।’

আরও পড়ুন-পেট্রাপোল সীমান্তের পার্কিং লটে তিন পণ্যবোঝাই গাড়িতে আগুন

কবিতাটি বর্ণনাধর্মী। অক্ষরে অক্ষরে লেগে রয়েছে অপ্রাপ্তির বেদনা। অনুশোচনা। মনকেমন। কারণ নির্ভরতার আতর লেগে থাকা বিবর্ণ আঙুল উপেক্ষা করে বেছে নিতে হয়েছিল ‘রঙিন কুয়াশা ঢাকা সুগন্ধী পথ’। দিকভ্রান্ত করেছিল আপাত চাকচিক্য। নির্ভরতার আঙুল আজ অতীতের ছায়াপথ। সম্পর্ক নামহীন। তাই বিশ্বচরাচর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘অগনিত শোক’।
ভাল লাগে ‘অনাবিষ্কৃত বনভূমি’ এবং ‘কথার কোলাজ’-এর কবিতাগুলো।
তবে পাতায় পাতায় চোখে পড়েছে বেশকিছু মুদ্রণপ্রমাদ। ‘দোয়েল সাঁকো’র ২০ সংখ্যক কবিতার শুরুতে জুড়ে গেছে ১৯ সংখ্যক কবিতার অনেকটা অংশ। প্রকাশকের আরও একটু মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল। ত্রুটি এইটুকুই। আশা করি কবিতাগুলো পাঠকের মন জয় করবে। দাম ১২০ টাকা।
এক দশকের বেশি সময় ধরে কবিতাচর্চা করছেন রমেশ পাত্র। ‘নদী ও বৈষ্ণবী’ তাঁর প্রথম কবিতার বই। গতবছর প্রকাশিত হয়েছে আবিষ্কার থেকে। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে মুদ্রিত হয়েছে বেশকিছু মনে রাখার মতো কবিতা। বেশিরভাগ কবিতাই নীচু স্বরের। আটপৌরে। নেই অতিরিক্ত আলোর ঝলকানি, রঙের বাহার। নেই নিজেকে অকারণ জাহির করার অপচেষ্টা। কবিতাগুলো মনের মধ্যে নরম আনন্দ সঞ্চারিত করে।
‘ঋণ’ কবিতায় চোখ রাখা যাক :
‘আমাদের উঠোনে রাত্রি চাষ হয়/ নটে শাকের মাথায় নামে নরম বাতাস/ চারিদিকে গোল হয়ে বসে আছে পাড়া/ অঙ্কুরিত চাঁদের মুখে উড়ছে খই।’

আরও পড়ুন-খেতমজুর সংগঠনের কার্যালয় উদ্বোধন করে রাজ্য সভাপতির ঘোষণা: কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু তৃণমূল

ফুটে উঠেছে একটি ছবি। ‘উঠোনে রাত্রি চাষ’ প্রয়োগটি চমৎকার। মহাসম্মিলনের ছবি প্রকাশ পেয়েছে ‘চারিদিকে গোল হয়ে বসে আছে পাড়া’র মধ্যে দিয়ে। যেন কোনও শিশুর জন্মমুহূর্ত। চাঁদশিশু। ছড়িয়ে পড়ে এক আকাশ ভাল লাগা। জ্যোৎস্নার আলোর মতো।
‘জিরাফ’ একটি সংকেতধর্মী কবিতা। কবি লিখছেন :
‘তালগাছ মুড়িয়ে সবুজ আকাশ/ আর খপ করে সূর্য এসে/ পিষে দিচ্ছে মাঠের হলুদ/ পুড়ে যাওয়া হাতানিয়া-দোয়ানিয়া/ আমার অলকানন্দা বমি করছে আজ/ ক্ষয়ে যাওয়া জ্যোৎস্নার নখ দিয়ে/ খুঁটিয়ে তুলছি তাই জীবাশ্মকণা।’
প্রকৃতিকে নির্মূল করে সভ্য হচ্ছে সমাজ। এইভাবে সভ্য হওয়া যায়? আধুনিক হওয়া যায় সৃষ্টিকে ধ্বংস করে? ছোট্ট কবিতাটি ভাবায়। ফুটে উঠেছে সমাজ সচেতন কবির প্রতিবাদী স্বর। জীবাশ্মকণার উল্লেখ করে দিয়েছেন চরম পরিণতির ইঙ্গিত।
আরও একটি ছোট কবিতা ‘আসন্ন ভোগ’। কবি লিখছেন :
‘কোনো বোধ যথেষ্ট নয়/ সামনে পেছনে ডাক সমান সমান/ দাঁড়িয়ে আমি মর্মরিত খোঁপার হাওয়ায়/ আজ কে বেশি প্রিয়/ কাছের না দূর হয়ে যাওয়া গোধূলী/ মুখে মুখে মুখ যখন এক ছবি হয়ে দাঁড়ায়।’

আরও পড়ুন-বিভাজনের রাজনীতি বরদাস্ত নয়: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি চরম প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন কবি। কে বেশি প্রিয়? দূর না নিকট? পাশাপাশি ‘কোনো বোধ যথেষ্ট নয়’ এক সার্থক উপলব্ধি।
ভাল লাগে ‘শ্রীরাধিকা জ্যোৎস্না’, ‘হলুদ পাতার নৌকো’, ‘সাবালক’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। কিছু কবিতায় অতিকথন বর্তমান। উচ্চারণে আরও একটু নির্মেদ হতে হবে। রণেভঙ্গ না দিলে এই কবির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। প্রচ্ছদশিল্পী দেবাশিস সাহা। বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। দাম ১০০ টাকা।

Latest article