“Vaccines are the tugboats
Of Preventive health”
—William Foege
“prevention is better than cure” — অর্থাৎ রোগের চিকিৎসা করার থেকে, রোগ প্রতিরোধ করা বেশি জরুরি। বিশেষ করে ভাইরাস, যাদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক বিশেষ সুলভ নয়, সহজেই যারা মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেদের আকারে পরিবর্তন আনতে সক্ষম, তাদের জন্য একমাত্র উপায় প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ অর্থাৎ ইমিউনিটি গড়ে তুলতে টিকাকরণের ভূমিকা প্রায় অপরিহার্য। মহামারী বা অতিমারী রুখে দিতে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির ক্ষেত্রে গণ-টিকাকরণের কার্যকরী ফলাফল কোভিড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে যে ফ্লু এবং অ্যাডিনো ভাইরাসজনিত জ্বর এবং শ্বাসনালির অসুস্থতা একরকম মহামারীর আতঙ্ক ফিরিয়ে আনছে, যাকে এক কথায় আমরা বলছি ‘এআরআই’ বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন, তারও প্রতিকার লুকিয়ে আছে এই টিকাকরণেই।
আরও পড়ুন-আজ ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া, ঝড়ে বিপর্যস্ত ট্রেন পরিষেবা
ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকাকরণ শুরু করার বিষয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স-এর সিদ্ধান্ত হল ছয় মাস এবং সাত মাস বয়সের সকল শিশুকে এই টিকাটির দুটো ডোজ দেওয়া। তারপর প্রতি এক বছরের ব্যবধানে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত টিকাটি দিয়ে যেতে হবে। পাঁচ বছর বয়সের পরেও যেসব শিশুদের asthma, জন্মগত হৃদযন্ত্রের ত্রুটি, কিডনিজনিত রোগ, থ্যালাসেমিয়া ইত্যাদি থাকে, তাদের এই টিকা প্রতি বছর অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে নিয়ে নিতে হবে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
অ্যাডিনো ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা এই মুহূর্তে সার্বিকভাবে উপলব্ধ নয়। তবে যেভাবে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ক্রমশ একটি উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যার আকার নিচ্ছে, তাই অদূর ভবিষ্যতে এই ভাইরাসের টিকা সর্বসাধারণ বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের জন্য শুরু করতে হবে। এই মুহূর্তে জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচি এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স-এর নির্দেশিত টিকাসূচির অন্তর্ভুক্ত ভাইরাসরোধী টিকাগুলো হল :
১) পোলিও
২) মিজিলস বা হাম
৩) মাম্পস
৪) রুবেলা
৫) ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু
৬) ভ্যারিসেলা বা চিকেন পক্স
৭) জাপানিজ এনকেফেলাইটিস
৮) হেপাটাইটিস এ, বি
৯) রোটা ভাইরাস
১০) এইচপিভি বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস
উপরোক্ত টিকাগুলো নিয়মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেওয়া হয় বা শিশুবিশেষজ্ঞরা দিয়ে থাকেন। যদিও ১০ নম্বর টিকাটি নিয়ে এখনও মানুষের মধ্যে সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি।
মেয়েদের মধ্যে সর্বাধিক যে সমস্ত ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, সার্ভিকসের ক্যানসার তাদের মধ্যে অন্যতম। এই সারভাইক্যাল ক্যানসারের অন্যতম কারণ হল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ। ক্যানসার প্রতিরোধে বর্তমানে যে একমাত্র ভ্যাকসিনটি প্রচলিত আছে, সেটি এই এইচপিভি ভ্যাকসিন।
আরও পড়ুন-কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প দেশ জুড়ে হওয়া উচিত : বোস
ভ্যাকসিন, যেগুলো এখনও পাইপ লাইনে
১) ডেঙ্গু ভ্যাকসিন : মশাবাহিত দুটি রোগ বর্ষার শুরু থেকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে আমাদের, ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়া। যদিও বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বজায় থাকে প্রায় সারা বছর। তার প্রধান কারণ, ডেঙ্গুর মশা পরিষ্কার জমা জলে ডিম পাড়ে। সেটা ছাদের খোলা ট্যাঙ্কের জল হোক বা ঘরের ফুলদানির জল। আর, এই মশা দিনেরবেলা ঘুরে বেড়ায়, ফলে মশারি টাঙিয়ে এর হাত থেকে বাঁচা কঠিন। এর পাশাপাশি খোলা ড্রেন, পুকুর, বৃষ্টির জমা জলে বেড়ে ওঠে ম্যালেরিয়ার মশার লার্ভা।
তবে হেমারেজিক ডেঙ্গু আর সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া আমাদের প্রধান চিন্তার কারণ। প্লেটলেট দ্রুত কমে গিয়ে যেমন ডেঙ্গুতে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তপাত আরম্ভ হয়, তেমনি সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় খিঁচুনির পর রোগী চলে যেতে পারে কোমায়।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের দুর্গ থাকবে বাংলা, দিল্লি থেকে উৎখাত হবে বিজেপি, মনোবল তুঙ্গে সর্বাত্মক অভিযান
বর্তমানে ভারতবর্ষের বাইরে নয় থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মানুষদের জন্য ডেনভ্যাক্সিয়া নামক ভ্যাকসিনটি প্রচলিত আছে। এই ভ্যাকসিনটি কেবল ইতিপূর্বে যাদের একবার ডেঙ্গু হয়ে গিয়েছে, সেরকম সেরো-পজিটিভ ব্যক্তিকেই দেওয়া যায়। তবে ভারতে এটি ব্যবহারের লাইসেন্স এখনও পায়নি। প্যানাসিয়া বর্তমানে ফেজ থ্রি ট্রায়াল চালাচ্ছে ভারতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের উপর। সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন বর্তমানে ফেজ টু ট্রায়ালে আছে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা নিশ্চই ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন পাব।
২) ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন : ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিনের ফেজ থ্রি ট্রায়াল চলছে ছয় থেকে বারো সপ্তাহ এবং পাঁচ থেকে সতেরো মাসের শিশুদের উপরে।
আরও পড়ুন-বাংলায় ফিরল টাটা
৩) এইচআইভি : এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস, যা শরীরে ঢুকলে সৃষ্টি হয় মারণ রোগ এইডস, তার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের। যেহেতু এই রোগ একবার হলে, টিটেনাস বা rabies – এর মতোই নিরাময়ের সঠিক কোনও রাস্তা নেই, অসহায়ের মতো কষ্টকর মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়, তাই, প্রতিষেধক বা টিকাই হল বাঁচার একমাত্র রাস্তা।
বর্তমানে পাস্তুর এবং অন্যান্য বেশ কিছু সংস্থা এই ভাইরাসের ভ্যাকসিনের উপর একাধিক ট্রায়াল চালাচ্ছে। তবে, এখনও অবধি সন্তোষজনক সাফল্য হাতে এসে লাগেনি।
আরও পড়ুন-প্রশ্ন উঠছে, সিপিএমের নিন্দা করবে তো কংগ্রেস
৪) হেপাটাইটিস সি ভ্যাকসিন: যে সমস্ত ভাইরাসের প্রভাবে আমাদের জন্ডিস দেখা দেয়, তাদের মধ্যে জলবাহিত হয়ে আমাদের শরীরে আসে হেপাটাইটিস এ ভাইরাস। তাই এই জন্ডিসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। সুইমিংপুলের বা পুকুর নদীর জলে, যেখানে এক জায়গায় বহু লোক বাস করে সেখানে, হস্টেল, মেস, ক্যাম্পে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। হেপাটাইটিস এ ভ্যাকসিন এক বছর বয়স হলেই দিয়ে দেওয়া হয়।
হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস কিন্তু একমাত্র রক্তবাহিত হয়েই এক শরীর থেকে অন্যের শরীরে যায়। অর্থাৎ, যদি হেপাটাইটিস বি বা সি’র জীবাণু যার রক্তে আছে তার রক্ত সুস্থ লোকের শরীরে ঢোকে, তবে এই রোগ হতে পারে।
অর্থাৎ রক্ত নিলে, সংক্রমিত রোগীর রক্ত টানা সুচ আঙুলে ফুটে গেলে অথবা যৌন মিলনের সময়ে এই রোগ রোগীর শরীর থেকে অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আরও পড়ুন-নজরে বিরাট, চোখ নেতা হার্দিকেও
হেপাটাইটিস বি ও সি দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক জন্ডিস, সিরোসিস অফ লিভার এবং লিভার ক্যানসারের অন্যতম কারণ।
হেপাটাইটিস বি’র টিকা উপলব্ধ থাকলেও বর্তমানে মারণ ভাইরাস এই হেপাটাইটিস সি’র একটি ট্রাইভ্যালেন্ট টিকা এনিম্যাল ট্রায়াল ফেজে রয়েছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই মারণ ভাইরাসের টিকা পেয়ে যাব।
৫) ক্যানসার প্রতিরোধক ভ্যাকসিন : বর্তমানে ভারতে ক্যানসার প্রতিরোধে একমাত্র ভ্যাকসিনটি সারভাইক্যাল ক্যানসারের ভ্যাকসিন। লিভার ক্যানসার প্রতিরোধে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনের অবদান অনস্বীকার্য নয়। পঞ্চাশোর্ধ ছেলেদের মধ্যে অন্যতম প্রচলিত ক্যানসারের নাম প্রস্টেট ক্যানসার। বর্তমানে ভারতের বাইরে, শিপুলিউসেল টি নামক ভ্যাকসিন প্রস্টেটের কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের অগ্রগতি রোধে ব্যবহৃত হয়।
চামড়ার এক ধরনের ক্যানসার, মেলানোমা এবং লসিকা গ্রন্থির ক্যানসার লিম্ফোমার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বর্তমানে ফেজ থ্রিতে রয়েছে। অর্থাৎ হয়তো কিছু আরও ক্যানসারের প্রতিষেধক আমরা পেতে পারি আসন্ন ভবিষ্যতে। ক্যানসারের আগমন বন্ধ না করতে পারলেও, এরা হয়তো তার দ্রুত অগ্রগতিকে থমকে দিতে সক্ষম হবে।
আরও পড়ুন-মেঘে ঢাকা অনিল
৬) ট্রাভেলার্স ডায়েরিয়া : বাঙালি ঘুরতে ভালবাসে। দুটো দিনের ছুটি পেলেই ব্যাগ পিঠে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছোট্ট সফরে। কিন্তু, বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ করে সব আনন্দ মাটি করে দেয় ট্রাভেলার্স ডায়েরিয়া। হোটেলে বন্দি হয়ে থেকে ক্রমাগত ল্যাট্রিন ছুটতে ছুটতে বিপদ আর দুর্গতির শেষ থাকে না। সঙ্গে আত্মীয়-বন্ধুদেরও আনন্দ মাটি হয়ে যায়। কখনও কখনও বিদেশ বিভূঁই-এ প্রাণ সংশয় পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
এই ডায়েরিয়া ঘটানোর প্রধান অপরাধী হয় এন্টেরোজেনিক ই কোলাই নামক এক ব্যাকটেরিয়া।
বর্তমানে এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে একটি স্কিন প্যাচ ভ্যাকসিনের ফেজ থ্রি ট্রায়াল চলছে ভারতের বাইরে। যদিও এখনও অবধি সেভাবে সাফল্য আসেনি, তবে আমরা আশাবাদী হতেই পারি।
৭) গ্রুপ এ স্ট্রেপ্টকক্কাস ভ্যাকসিন : রিউম্যাটিক ফিভার এবং গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস শিশু-কিশোরদের জন্য একটি ত্রাস। প্রথমটি থেকে হৃৎপিণ্ডের ভালভ আক্রান্ত হলে সারা জীবন পেনিসিলিন ইনজেকশন নিয়ে যেতে হবে তিন সপ্তাহ অন্তর। দ্বিতীয়টিও একবার হলে বারংবার ফিরে আসতে থাকে।
আরও পড়ুন-আজ কলকাতা পুরসভার বাজেট
প্রবল জ্বর আর জয়েন্ট পেইনের পরেই হার্ট বড় হয়ে গিয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় রিউম্যাটিক ফিভারে। স্টেরয়েড, এসপিস্পিরিন আর পেনিসিলিন ইনজেকশন নিয়ে যেতে হয় দীর্ঘদিন। হার্টের ভালভ নষ্ট হয়ে যায়।
নেফ্রাইটিসে শরীর ফুলে যায়, বেড়ে যায় রক্তচাপ, ক্রিয়েটিনিন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ডায়ালিসিস পর্যন্ত দরকার হতে পারে।
এই দুই রোগের কারণ যে ব্যাকটিরিয়া, তার প্রতিরোধক তৈরিতে অনেকটাই সফল ফাইজার, GlaxoSmithKline, নোভারটিস প্রভৃতি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থা।
আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই রোগ প্রতিরোধে অবশ্যই সক্ষম হব।