প্রতিবেদন : মুক্তিপণের ধুয়ো তুলে নৃশংসভাবে খুন করা হল বাগুইআটি-জগৎপুরের ২ কিশোরকে। আচমকাই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ১৫ দিন পরে মঙ্গলবার সকালে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালের মর্গে শনাক্ত করা হল মাধ্যমিক পড়ুয়া অভিষেক নস্কর (১৬) এবং অতনু দে (১৫)-র মৃতদেহ। ২২ অগাস্ট নিখোঁজ হয়েছিল এই ২ কিশোর। ২৩ অগাস্ট সন্ধ্যায় ন্যাজাট থানা এলাকায় খালের ধারে পাওয়া যায় একজনের দেহ, দ্বিতীয়জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ২৫ অগাস্ট, মিনখাঁ থানা এলাকায় খালের ধারে।
আরও পড়ুন-কার সঙ্গে দেখা করেন শুভেন্দু? টাওয়ার লোকেশন খতিয়ে দেখুক সিবিআই
দুই কিশোরের মরদেহই এতদিন মর্গে পড়েছিল অশনাক্ত অবস্থায়। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মোট ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার অভিজিৎ বসু নামে একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতারের পরে তাঁকে জেরা করেই পুলিশ জানতে পারে ২ কিশোরকে চলন্ত গাড়িতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে বাসন্তী হাইওয়ের ধারে দুটি আলাদা জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে। এই কাজে হাত লাগিয়েছিল সে নিজেও। অপহরণ এবং খুনের ঘটনায় মূল ষড়যন্ত্রকারী অতনুর পরিবারের পরিচিত ওই এলাকারই সত্যেন্দ্র চৌধুরি নামে এক যুবক। পুলিশ তার খোঁজে চিরুনি-তল্লাশি চালাচ্ছে। ফেরার আরও দুজন। উদ্ধার করা হয়েছে কর্নাটকের নম্বর প্লেট লাগানো একটি গাড়ি। খুনে ব্যবহার করা হয়েছিল সম্ভবত এই গাড়িটিই। আসল রহস্য এখনও অধরা।
আরও পড়ুন-যুবভারতীতে এএফসি কাপের জোনাল সেমিফাইনাল, ডুরান্ড ভুলে সতর্ক মোহনবাগান
কিন্তু খুনের নেপথ্যে মুক্তিপণের লোভ নাকি শত্রুতা বা অন্য কিছু? পুলিশ নিশ্চিত হতে চেষ্টা করছে এ-ব্যাপারেই। মঙ্গলবার সকালে দুই কিশোরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাগুইআটি। উত্তেজিত জনতা ভাঙচুর শুরু করে সত্যেন্দ্রর বাড়িতে এবং শ্বশুরবাড়িতে। পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভপ্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিকে রাজ্যের নারী এবং শিশুকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা জানিয়েছেন, ঘটনার রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং কমিশনারের কাছে। তাঁর আশ্বাস কঠোর শাস্তি পাবে দোষীরা।
আরও পড়ুন-পার্কিনসন
মনে করিয়ে দেয় সঞ্জীব-তীর্থঙ্করের মৃত্যুরহস্য : এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৮৩-র সঞ্জীব-তীর্থঙ্কর মৃত্যুরহস্যকে। ২ মার্চ নিখোঁজ হয়েছিল ব্যারাকপুরের ২ কিশোর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং তীর্থঙ্কর দাসশর্মা। রাতে নিখোঁজ ডায়েরি হয় স্থানীয় থানায়। ৫ এপ্রিল জানা যায় বেলানগরের কাছে পাওয়া গিয়েছে ২ কিশোরের দেহ। কিন্তু দাহ করে দেওয়া হয়েছে শনাক্ত না করেই। মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন দুজনের বাবাই। মুখ্যমন্ত্রী প্রাথমিকভাবে জানান, আত্মহত্যার ঘটনা।
আরও পড়ুন-ভালবাসা, জেদ, গর্ব, অহংকার, সবকিছু মিলেমিশে একাকার
ঠিক কী ঘটেছে : বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রাথমিক তদন্তের পরে জানিয়েছেন, ২২ তারিখ বিকেলে মূল অভিযুক্ত সত্যেন্দ্র ফোনে ডেকে পাঠায় অতনুকে। বন্ধু অভিষেককে সঙ্গে নিয়ে যায় অতনু। বিকেলে দুজনকে নিয়ে গাড়িতে চেপে সত্যেন্দ্র প্রথমে যায় বাইকের একটি শোরুমে। সেখানে টাকাপয়সা নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। পছন্দ হয়নি বাইকও। তারপরে সত্যেন্দ্র, অভিজিৎ-সহ মোট ৪ জন ২ কিশোরকে নিয়ে যায় অন্ধকার বাসন্তী রোডের এক নির্জন জায়গায়। দড়ি রাখা ছিল গাড়ির মধ্যেই। রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে দুজনকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে ফেলে দেওয়া হয় দুটি আলাদা জায়গায় খালপাড়ে। বোঝাই যাচ্ছে খুনের ছক কষা হয়েছিল আগেই।
আরও পড়ুন-ইলিশ কিনতে উপচে পড়া ভিড়
পুরনো সম্পর্ক না শত্রুতা : গোয়েন্দাপ্রধান তদন্তে জানতে পেরেছেন, সত্যেন্দ্রর সঙ্গে অতনুর পরিবারের পুরনো সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসার সূত্রেই এই সম্পর্ক। সেই সূত্রেই বাইক কেনার জন্য সত্যেন্দ্রকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিল অতনু। কিন্তু টাকা নিয়েও বাইক কিনতে গড়িমসি করছিল সত্যেন্দ্র। সেদিন বাইক কেনার কথা বলেই অতনুকে ডেকে পাঠিয়েছিল সত্যেন্দ্র। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, দুই কিশোর নিখোঁজ হওয়ার পরে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ চেয়ে অতনুর বাবাকে এসএমএসও পাঠিয়েছিল সত্যেন্দ্র। কিন্তু তার টাওয়ার লোকেট করা যাচ্ছিল না। তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে এই বিষয়টিই।
আরও পড়ুন-২৪৫০ টন পদ্মার ইলিশ বাংলায়
মুক্তিপণ কি আসলে নাটক : তদন্ত যতই এগোচ্ছে, খুলে যাচ্ছে বিভিন্ন সম্ভাবনার দরজা। শুধুই কি মুক্তিপণের জন্য খুন? তদন্তকারীরা মনে করছেন, মুক্তিপণের ব্যাপারটা আসলে হতে পারে একটা সাজানো নাটক। খুন করতেই অপহরণ করা হয়েছিল স্কুলছাত্র অতনুকে। বন্ধুস্থানীয় অভিষেক সঙ্গে যাওয়ায় খুন হতে হয় তাকেও। কিন্তু কেন খুন করা হল অতনুকে? প্রতিবেশী অতনুর পরিবারের সঙ্গে কীসের শত্রুতা সত্যেন্দ্রর। ব্যবসায়িক না অন্যকিছু? খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
আরও পড়ুন-মহার্ঘভাতা বকেয়া নেই
বিস্ময় পুলিশের ভূমিকায় : কিন্তু পুলিশের ভূমিকাও বিস্মিত করেছে অনেককেই। কেন? ২২ তারিখে নিখোঁজ হওয়ার পরে ২৪ অগাস্ট বাগুইআটি থানায় দুটি পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয় নিখোঁজ ডায়েরি। কিন্তু অভিযোগ, পুলিশ সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, মিডিয়াকে জানাতেও বারণ করেন অভিভাবকদের। দ্বিতীয়ত, দুই কিশোরের মৃতদেহ পাওয়ার পরেও ন্যাজাট এবং মিনখাঁ থানার কৌতূহল জাগলো না তাদের নিয়ে? তদন্তের প্রয়োজন মনে করল না? বসিরহাট হাসপাতাল মর্গে এতদিন ধরে দুজনের মৃতদেহ অশনাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও নিস্পৃহ হয়ে রইলেন বসিরহাটের পুলিশ কর্তারা? বিভিন্ন থানায় জানালেন না? বিধাননগরের গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য, মুক্তিপণের বিষয় বলে খুব সাবধানে এগতে হচ্ছিল পুলিশকে।