রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বদল

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশিত পথে চলে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ সম্ভবায়িত করেছেন ব্রাত্য বসু। কীভাবে? বিশ্লেষণে শিক্ষক নেতা বিজন সরকার

Must read

২০২১-এর বিধানসভায় তৃতীয়বার জেতার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব দেন অধ্যাপক ব্রাত্য বসুকে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিত ব্রাত্য বসু শিক্ষাদপ্তরকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন। তৎকালীন বামদল আন্দোলনে নেমেছিল রাজ্যে যাতে কম্পিউটার চালু না হয়। রাজ্যে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছিল। বছরের পর বছর আধুনিকতার ছোঁয়া না পেয়ে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা (Bengal Education) থেকে পিছিয়ে পড়ে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েরা। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়েছে ভারতবর্ষের সেরা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর হাত ধরে। রাজ্যের শিক্ষকদের আধুনিক ধ্যানধারণা-সহ নতুনভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরির উদ্দেশ্যে নতুন নতুন প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জট কাটিয়ে তিনটি জেলার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও মালদহ জেলার বহু বেকার ছেলেমেয়ে আজ শিক্ষকতার চাকরি করছে। সারা রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কলকাতায় আগামী ২১ নভেম্বর শুরু হচ্ছে বিশ্ববাণিজ্য সম্মেলন। এবার এই প্রথম এই সম্মেলনে থাকছে এডুকেশন কনক্লেভ। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইছে আমাদের রাজ্য বাংলা। সারা ভারতের মধ্যে বুনিয়াদি শিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ দেশের সেরা এবং প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে সাম্প্রতিককালে বিদ্যালয় প্রধান এবং সহ-শিক্ষক ও সহ-শিক্ষিকাদের জন্য বিভিন্ন যুগান্তকারী প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে যার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বিদ্যালয় উপকৃত হচ্ছে। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় একটি সমাজসেবা। নিজেদের কীভাবে আরও উন্নত করে ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগানো যায় সেটাই এই প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোর উদ্দেশ্য।
সাম্প্রতিক সময়ের এরকম কয়েকটি কর্মশালার উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি—
(১) বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও সাবধানতা বিষয়ক কর্মশালা (School Safety & Security)
পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন এবং মধ্য শিক্ষা পর্ষদের যৌথ উদ্যোগে এই কর্মশালার মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়ে কীভাবে বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও সাবধানতা বিষয়ক কমিটি তৈরি করতে হবে এবং ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে সেই কমিটির ভূমিকা কী হবে সেগুলি আলোচনা হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনওভাবেই মানসিক, দৈহিক নির্যাতনের শিকার না হয়, প্রতিটি শিশু যাতে বিদ্যালয়ে নিজেকে নিরাপদ বোধ করে এবং স্কুলে বা বাইরে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হলে যেন নির্ভয়ে সেটি শিক্ষক-শিক্ষিকাকে জানায় সে-বিষয়ে কীভাবে নিরন্তর কাজ করতে হবে সেটাই এই কর্মশালার নির্যাস।
(২) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (Disaster Management)
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ ও দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যেমন— ভূমিকম্প, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা, যেমন— জলে ডোবা, সড়ক দুর্ঘটনা, আগুন লাগা, সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই ধরনের প্রশিক্ষণ ভীষণ প্রয়োজনীয়।
(৩) প্রশ্ন তৈরি ও পাঠ্যক্রম বিষয়ক কর্মশালা
(Workshop on Curriculum and Question Framing)
পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন এবং মধ্য শিক্ষা পর্ষদের যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বর্তমান পাঠদান পদ্ধতি, পাঠ্যক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি বিষয়ে ATI সল্টলেকে বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সারা রাজ্যের বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই কর্মশালায় অংশ নেয়। পরবর্তীকালে তাঁরা নিজ অঞ্চলের শিক্ষক, শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
(৪) নেতৃত্ব দানের গুণাবলি বৃদ্ধি বিষয়ক কর্মশালা
(Leadership Development Programme)
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এবং IIM, Calcutta-র যৌথ উদ্যোগে এই কর্মশালার মাধ্যমে রাজ্যের সমস্ত উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধানদের IIM, Calcutta-র জোকা ক্যাম্পাসে ২ দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ হয়। Management Guru-রা এই প্রশিক্ষণ দেন এবং কীভাবে নিজের বিদ্যালয়কে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সে-বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। এই ধরনের যুগান্তকারী প্রশিক্ষণ আগে কোনদিনও হয়নি।
(৫) কৃত্রিম মেধা বিষয়ক কর্মশালা
(Training on Artificial Intelligence and Data Science)
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিষয়ের স্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ১৬ দিনের এই বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে যাতে তাঁরা নিজ বিদ্যালয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স/ডাটা সায়েন্স বিষয় পাঠ দান করতে পারেন।
(৬) Professional Development & Hybrid Learning
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ এবং মাইক্রোসফট-এর যৌথ উদ্যোগে বিদ্যালয় প্রধান এবং ২ জন সহ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে যাতে বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে আরও উন্নতমানের পাঠদান সম্ভব হয়। মাইক্রোসফট ফর্ম-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কীভাবে সম্ভব, one drive, power point presentation, Microsoft Outlook app, Microsoft Team-এর ব্যবহার করে কীভাবে উন্নত পাঠদান সম্ভব সেগুলি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। Hybrid Learning-এর ৫টি উপাদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেই ৫টি উপাদান হল— Learning Environment, Class Community, Lesson Design, Engagement & Interactivity এবং Assessment & Feedback. প্রশিক্ষণ শেষে একটি অনলাইন প্রশ্নোত্তর হয়। এবং সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় Microsoft Educator হিসেবে সম্মানিত করা হয় অংশগ্রহণকারী সকলকে। এই ধরনের প্রশিক্ষণ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা জগতে প্রথম দেওয়া হল।
(৭) Training on UDISE
সমগ্র শিক্ষা মিশন-এর উদ্যোগে বিদ্যালয় প্রধান এবং কম্পিউটার জানা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ শিবির হয় যাতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কীভাবে স্কুল-সংক্রান্ত তথ্য আপলোড করতে হবে সেটি শেখানো হয়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সমস্ত বিষয়ে অনলাইনের মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। AI (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স), ডেটা সাইন্স— এই দুটি নতুন বিষয় উচ্চমাধ্যমিক স্তরে চালু করা হয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর সমস্ত কাজও অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মাসপয়লা বেতন-ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এখন আর শিক্ষকদের তীর্থের কাকের মতো বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ২০১৬ সালের উচ্চপ্রাথমিক স্তরে যে টেট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগ-প্রক্রিয়ার কাউন্সেলিং শুরু হয়েছে। ২০২২ সালে প্রাইমারি টেট পরীক্ষা হয়েছে এবং ডিসেম্বরে আরেকটি টেট পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে এবং খুব শিগগিরই প্রতিবছর এই পরীক্ষা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া শিক্ষাদপ্তর চালু করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক-এর ক্ষেত্রে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক— সবক্ষেত্রেই স্টুডেন্ট পোর্টাল চালু হয়েছে। ডুপ্লিকেট মার্কসিট, তথ্য সংশোধন প্রভৃতি ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর হাত ধরে পদোন্নতির জন্য কমিটি তৈরি হয়েছে। এর ফলাফল আগামীতে দেখতে পাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ বাঁকুড়াতে দু-দিনের ‘পড়ানোর কৌশল’-এর উপর একটি কর্মসূচির আয়োজন করেছিল । এই কর্মশালার মাধ্যমে ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পড়ানোর কৌশলে উন্নতি ঘটবে তা সহজেই অনুমেয়। সমস্ত দিক দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এবং উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। দেশের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী সবচেয়ে উন্নত বুনিয়াদি শিক্ষা এবং অনলাইন ট্রেনিং ও অনলাইন ব্যবস্থার (Bengal Education) মাধ্যমে তা ক্রমশই আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। দক্ষ নাবিক শত দুর্যোগ কাটিয়ে ক্রমশ আলোর পথে যাত্রা করছে।

আরও পড়ুন- আজ নবান্নে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক

Latest article