বাংলা ১৩২২, ইংরেজি ১৯১৫। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে (বৈশাখ- ফাল্গুন) প্রকাশিত হল উপন্যাস ‘শেখ আন্দু’। এবং প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যসমাজ তো বটেই, সেই সঙ্গে তৎকালীন রক্ষণশীল বঙ্গসমাজে হইচই পড়ে গেল। কারণ, উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এক মুসলমান গাড়ি চালকের সঙ্গে এক হিন্দু যুবতীর প্রেম হল উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। এবং সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা যেটা, সেটা হল এই উপন্যাসের রচয়িতা কোনও পুরুষ নন, এক একুশ বছরের মহিলা, নাম শৈলবালা ঘোষজায়া। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় যখন নারী স্বাধীনতার ভাবনাটাই একেবারে স্বপ্নাতীত ছিল, ঠিক তখনই পুরুষশাসিত বঙ্গসমাজের কঠোর নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে এই উপন্যাস ছিল এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কে এই শৈলবালা? পিছিয়ে যাই ১৮৯৪ সালে। ওই বছরই কক্সবাজারে (বর্তমানে বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন শৈলবালা। পিতা কুঞ্জবিহারী নন্দী ছিলেন পেশায় চিকিৎসক।
আরও পড়ুন-দুই সংগ্রামী মহিলা চিকিৎসক
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর কুঞ্জবিহারী কক্সবাজার থেকে চলে আসেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। স্ত্রী শিক্ষায় বিশ্বাসী পিতা শৈলবালাকে ভর্তি করেন বর্ধমান রাজ বালিকা বিদ্যালয়ে। কৃতী ছাত্রী ছিলেন শৈলবালা, পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে সাহিত্যচর্চা। হেমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত শৈলবালা পিতার শেষ জীবনে এঁদের লেখা পড়ে শোনাতেন অসুস্থ পিতাকে। কিন্তু, তৎকালীন সমাজব্যবস্থার চাপে পড়ে মাত্র তেরো বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মেমারির নরেন্দ্রমোহন ঘোষের সঙ্গে। এবং বিয়ের পরেই সম্মুখীন হন সাহিত্যচর্চায় প্রবল বাধার। রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়ি কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারে না ঘরের বউয়ের সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যচর্চা তো পরের ব্যাপার, মেয়েদের লেখাপড়ার পরিবেশই ছিল না শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু, মানতে নারাজ শৈলবালা। সারাদিন গৃহস্থালি কাজকর্মের পর যখন শ্বশুরবাড়ির সবাই নিদ্রিত, তখন রাত জেগে শুরু করলেন, লেখা ও পড়া। এবং এইখানেই পাশে পেয়ে গেলেন স্বামী নরেন্দ্রমোহনকে। মনের জোর, অধ্যবসায় আর প্রতিভা অবলম্বন করেই শুরু করলেন একের পর এক গল্প-উপন্যাস রচনা।
আরও পড়ুন-রথযাত্রা
শ্বশুরবাড়ির কড়া অনুশাসনে বাড়ি থেকে বেরোনো বা সমাজের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা কঠিন, তাই শৈলবালা স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অন্য পুরুষদের কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন তাঁদের বাড়ির বাইরের অভিজ্ঞতা এবং বাড়িতে বাইরের লোক যাঁরা আসতেন, সে ধোপা, নাপিত, পরিচারক ইত্যাদি যাঁরাই হোক, তাঁদের কাছ থেকেও সাহিত্যচর্চার রসদ সংগ্রহ করতেন। এইভাবেই লিখে ফেললেন ‘শেখ আন্দু’। প্রথমে দ্বিধায় ছিলেন, সাহস পাচ্ছিলেন না, এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে লেখা উপন্যাস কোনও পত্রিকায় দিতে। কিন্ত মনের ভেতরে তীব্র অস্থিরতায় ভুগছিলেন, যে প্রথাগত সামাজিক উপন্যাসের বদলে, হিন্দু-মুসলমানের এই প্রণয় অ্যাখান, যা হয়তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জোর বার্তা বয়ে আনবে তা পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে। এগিয়ে এলেন স্বামী নরেন্দ্রমোহন। উপন্যাসটি জমা দিয়ে এলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। রামানন্দবাবু পড়ে পরে জানাবেন বললেন। তারপর, শুধু অপেক্ষা। প্রায় এক বছর পর, ১৩২১ বঙ্গাব্দে জমা দেওয়া উপন্যাস প্রকাশিত হতে শুরু করল ১৩২২-এ। এবং ধারাবাহিক ভাবে বেরোনোর পরই পাঠকমহলে সাড়া ফেলল তা শুরুতেই বলেছি৷
আরও পড়ুন-উদয়পুর হত্যাকাণ্ড: একসঙ্গে বদলি ৩২ জন পুলিশ আধিকারিক
কিন্তু সমাজের একটা বড় অংশ তো এটা মানবে না, অতএব শুরু হল ধারাবাহিক চলাকালীনই ‘প্রবাসী’ পত্রিকাকে চাপ দেওয়া যাতে, উপন্যাসটি মাঝপথে বন্ধ হয়। কিন্তু কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এসবে কান দিলেন না। উপন্যাস শেষ হল এবং এত বৃহৎ অংশের পাঠকের কাছে সমাদৃত হল যে এসব প্রতিবাদ সম্পূর্ণরূপে চাপা পড়ে গেল। এরপর ১৯১৭ (বঙ্গাব্দ ১২২৪)-এ প্রকাশক ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যান্ড সন্স’ থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ‘শেখ আন্দু’। দু বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণ। এরপর শৈলবালাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক লেখার অনুরোধ পেয়েছেন এবং সৃষ্টির আনন্দে সৃষ্টি করে গেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ… লিখেছেন বসুমতী, কল্লোল, প্রবাসী, ভারতবর্ষ ইত্যাদি খ্যাতনামা পত্রিকায়। আড়াইচাল (১৯১৯), মনীষা (১৯২০), মিষ্টি সরবৎ (১৯২০), অবাক (১৯২৫), নমিতা (১৯১৮), জন্মে অপরাধী (১৯২০), জন্মে অভিশপ্তা (১৯২১), মঙ্গলমঠ (১৯২১)— একের পর এক গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে সেই সময়। কিন্তু বিধিবাম। যে স্বামী ছিলেন সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়, সেই নরেন্দ্রমোহন ১৯২২-এ হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ উন্মাদ। এবং শৈলবালা পড়লেন মহা বিপদে। সাহিত্যচর্চা তো প্রায় বন্ধই, সেই সঙ্গে মাথায় চাপল উন্মাদ স্বামীর চিকিৎসা ও সেবার কাজ। এবং এই করতে করতেই একদিন ঘটে গেল এক বিপর্যয়। উন্মাদ স্বামীর দ্বারা ভারী দ্রব্য দিয়ে মাথায় মারাত্মক আঘাত করার ফলে শৈলবালার প্রাণসংশয় হল। যদি-বা প্রাণে বাঁচলেন, কিন্তু সারাজীবনের মতো হারালেন একটি চোখের দৃষ্টি। কিন্তু অসম্ভব মনের জোর,আত্মবিশ্বাস, জেদ ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা শৈলবালাকে ভেঙে পড়তে দিল না৷ এর মধ্যে ১৯২৭-এ স্বামীর মৃত্যু এবং শ্বশুরবাড়ির অসহযোগিতা ও অত্যাচারে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এই সময় থেকে শুরু হল তাঁর নতুন জীবনসংগ্রাম।
আরও পড়ুন-দু’বছর পর মহাসমারোহে মাহেশের ঐতিহাসিক রথযাত্রা পালন
মধ্য-তিরিশের বিধবা, নিঃসন্তান। শান্তির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কখনও পিতৃগৃহ বর্ধমান, কখনও মেমারি বা কখনও বিপ্লবী স্বামী অসীমানন্দর প্রতিষ্ঠিত পুরুলিয়ার আশ্রমে। এবং এই আশ্রমেই তিনি স্বামী মারা যাবার পর জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন এবং সেই সঙ্গে সাহিত্যচর্চাও চালিয়ে গেছেন। ‘শেখ আন্দু’ ছাড়াও তাঁর অন্য কয়েকটি রচনাতেও মুসলমান চরিত্রের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ‘মিষ্টি সরবৎ’ উপন্যাসে মুসলমান পরিবারের চিত্র, ‘অভিশপ্ত সাধনা’ উপন্যাসে নায়িকার নাম রাবেয়া ইত্যাদি। এখানেই তৎকালীন মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। এই ব্যতিক্রমী চরিত্র প্রকাশ করার জন্যই হয়তো তিনি নামের আগে ‘শ্রী’ নামের পরে ‘জায়া’ ব্যবহার করে নিজের নাম লিখতেন ‘শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়া’। সামাজিক উপন্যাস লেখার পাশাপাশি তিনি দুটি রহস্য উপন্যাসও লিখেছিলেন। বড়দের উপযোগী ‘চৌকো চোয়াল’ যা ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং কিশোর বয়সের উপযোগী ‘জয় পতাকা’ যা চল্লিশ-এর দশকে ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ প্রকাশিত কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এই উপন্যাসটি বাংলা কিশোর রহস্য সিরিজে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে, কারণ এর গতি, রোমাঞ্চ এবং শেষে অপ্রত্যাশিত চমকের জন্য।
আরও পড়ুন-মণিপুরে ধসে মৃত্যু দার্জিলিংয়ের ৯ জওয়ানের, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
সাহিত্যচর্চা ছাড়াও নানারকম সমাজসেবামূলক কাজকর্ম, বিশেষত নারীকল্যাণমূলক কাজ, নারীদের স্বনির্ভর, প্রতিবাদী করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু। জীবনে সাহিত্যসম্মান সেভাবে তিনি কখনওই পাননি। শেষ জীবনে নদীয়ার মানদমণ্ডলী তাঁকে ‘সাহিত্য ভারতী’ ও ‘রত্নপ্রভা’ উপাধিতে ভূষিত করে। ব্যস, এইটুকুই। তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষের রক্ষণশীল পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে এক সাধারণ গৃহবধূ যে শুধু তাঁর কলমটি সম্বল করে প্রতিবাদের বার্তা দিয়েছিলেন বাংলার সাহিত্যসমাজ বা স্বাধীন ভারতের প্রশাসনের কাছে তাঁর কি আরেকটু বেশি সম্মান প্রাপ্য ছিল না? সত্যি কথা বলতে গেলে, শৈলবালার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি, তাই এই প্রজন্মের পাঠক তো বটেই, অনেক প্রবীণ পাঠকের কাছেও তিনি এবং তাঁর সৃষ্টি রয়ে গেছে অজানা।
আরও পড়ুন-রথযাত্রা উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
৭৫ বছর বয়সে শৈলবালা আশ্রয় পান আসানসোলে ভাশুর মুরারি ঘোষের নাতি শ্যামসুন্দর ঘোষের বাড়িতে। এবং শেষ জীবনে এখানেই তিনি পেয়েছিলেন শান্তির সন্ধান৷ ১৯৭৪-এর ২১ সেপ্টেম্বর এই কলম-বিপ্লবী নারীর জীবনাবসান ঘটে এই বাড়িতেই।
আজ শৈলবালা নেই, কিন্তু যে-সময়ে সাহিত্যচর্চা ছিল মেয়েদের কাছে সমাজবিরোধিতা সেই সময় শৈলবালার লেখা নারীদের মধ্যে জাগিয়েছিল মুক্তচিন্তা ও প্রতিবাদী সত্তা।