সাত দু’গুণে চোদ্দোর নামে চার হাতে রইল জিডিপির পেনসিল

প্রকৃত চিত্র গোপন করে ভারতীয় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ঢাক পিটিয়ে প্রচার করছে মোদি সরকার। কিন্তু সেটা যে একটা মারাত্মক মিথ্যাচার, তা ক্রমেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। মিথ্যার বেসাতি মানুষকে আর গেলানো যাচ্ছে না। লিখছেন সুব্রতা ঘোষ রায়

Must read

আমাদের কিশোরবেলায়, টেলিভিশনে একটি মিনি ক্যাপসুল শো ‘উল্টা পুল্টা’ চলত, পরিচালনায় থাকতেন বিখ্যাত অভিনেতা নির্দেশক যশপাল ভাট্টি। টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব যশপাল তাঁর ‘ফ্লপ শো’ ও ‘ফুল টেনশন’ এই রকম সহজ হাস্যোজ্জ্বল শো-এর মাধ্যমে তখন ভীষণ জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা, টানাপোড়েনে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিলিয়ে দিয়ে অত্যন্ত মুনশিয়ানায় যেভাবে রম্য চলমান অডিও-ভিস্যুয়াল নাটিকা বানাতেন, তা মানুষের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হত ।

যশপাল নেম কাস্টিং-এ অবশ্য বিনয় ও কৌতুক করে জানান দিতেন মিসডিরেক্টেড বাই যশপাল ভাট্টি। আবছা মনে পড়ছে… একটি শো-এর বিষয়বস্তু ছিল একটি কমেডি ফিল্ম বানানোর পরিপ্রক্ষিতে নির্দেশকের পুরস্কার পাওয়া। তো মঞ্চে শেষমেশ নির্দেশক পুরস্কার নেন, এবং নিতে নিতে নেহাত বেচারা থেরিয়ামের মতো মুখ করে পুরস্কার নির্বাচক গোষ্ঠীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন যে তিনি কিন্তু ট্রাজেডি বানিয়েছিলেন! সাম্প্রতিক জিডিপির হিসেবনিকেশ, জাতীয় শাসক দলের দাবি ও ঢক্কানিনাদে বাস্তব ও প্রচারের বৈপরীত্য যেন যশপাল ভাট্টির কৌতুক আমাদের শ্লেষের মতো মনে করিয়ে দিচ্ছে। ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও ভাট্টি সাহেবকে এই দুর্দিনে বড়ই মনে পড়ছে। যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ যাচ্ছে— তার পরিপূর্ণ রসদ নিয়ে তিনি হয়তো কৌতুকরসেই এই সব বাস্তব ধারাবাহিক দিনরাত্রির ঘটনাবলিতে আবার ধারাবাহিক আঘাত এনে মনোরঞ্জনের মশলায় নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে পারতেন।

আরও পড়ুন : জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রের মিথ্যাচার ফাঁস তৃণমূলের

২০০০– ২০২১এর এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে জাতীয় বৃদ্ধির হার (২০.১%) প্রকাশ হতেই ‘ইন্ডিয়া বাউন্সেস ব্যাক’ বা ‘ভারত ঘুরে দাঁড়াল’ বলে যে ম্যাসিভ সাফল্যের ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে, তা যে কতটা নিরর্থক তা নিয়ে ইতিমধ্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মূল্যবান মতামত ও গবেষকদের ফ্যাক্ট সামনে আসতে শুরু করে দিয়েছে। এবং তাতে সাধারণ সামান্য পাটিগণিত জানা সাধারণ মানুষের বুঝতে বাকি থাকছে না যে এই সব মিথ্যে ধারণা তৈরিতে যমুনার জল বেশ ভাল পরিমাণেই ব্যবহার হচ্ছে! বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তথা ভারতের প্রাক্তন অর্থনীতি উপদেষ্টা কৌশিক বসুর মতে, এই টার্মে জিডিপির প্রকৃত বৃদ্ধির মান আসলে -৯.২% । গত আর্থিক বছরে দেশজুড়ে লকডাউন ও অর্থনৈতিক বিপাকে যেমন তলিয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধির হার, তেমনই প্রায় ২৪.৪% এরও বেশি সঙ্কুচিত হয়েছিল দেশের অর্থনীতির সচলতা। এই অর্থবর্ষে তা কিছুটা বাড়লেও ২০১৯– ২০২০ অর্থবর্ষের তুলনায় এই বছর এই পর্যায়ে বৃদ্ধির হার -৯.২% । অর্থাৎ মাইনাসের ঘরে ।

রেটিং এজেন্সি আইসিআরএ-র প্রধান অর্থনীতিবিদ অদিতি নায়ার বিষয়টিকে বিশদে বুঝিয়ে দিয়েছেন । তাঁর মতে, যদি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের প্রথম তিনমাসের হিসেবে জিডিপি ১০০ টাকা থাকে, তাহলে ২০২০– ২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে তা ২৪% নেমে হয়েছিল ৭৬ টাকা । আর এই চলতি অর্থবর্ষে তা বেড়ে যা হয়েছে, তা হল ৯১ টাকা। অর্থাৎ জিডিপি বাড়লেও তা এখনও দু’ বছর আগের তুলনায় ৯ টাকা কম। সুতরাং সেই যশপাল ভাট্টির কমেডি ট্রাজেডির গপ্পো। যে বৃদ্ধির গপ্পো হচ্ছে, তা আসলে কোনও আত্মতুষ্টির গপ্পো নয়, বরং পিছিয়ে থাকার গপ্পোই বলা চলে। এদিকে অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)র সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্ট মোতাবেক সংগঠিত অসংগঠিত দুই ক্ষেত্রের শ্রমিক মিলিয়ে কাজ হারিয়ে ফেলেছেন প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ । ফলে তার ঋণাত্মক প্রভাব দেখা যেতে পারে পরবর্তী ত্রৈমাসিকে। ফলে এই ত্রৈমাসিকে যে বাস্তবিক জিডিপি বাড়েনি, তা জলের মতো পরিষ্কার ।

আরও পড়ুন : কার্নালে কৃষকদের রুখতে জারি ১৪৪ ধারা, বন্ধ ইন্টারনেট

জুলাইয়ের তুলনায় অগাস্টে কর্মসংস্থান আরও কমেছে , জুলাই-এ যদি ৩৯.৯৩ কোটি থাকে, অগাস্টে তা কমে হয়েছে ৩৯,৭৭ কোটি । এর ফলে দেশে বেকারত্বের হার জুলাইয়ের ৬.৯৫ থেকে অগাস্টে হয়্বেছে ৮.৩২% হয়েছে , এই সময় গ্রামে বেকারের হার জুলাই-এর তুলনায় ১.৩% বেড়ে ৭.৬৪% হয়েছে। এই সংস্থার দাবি, জুলাই মাসে যেখানে ৩ কোটি মতো কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, অগাস্টে তা বেড়ে হয়েছে তা ৩.৬ কোটি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছে তখন বেকারত্বের হার বৃদ্ধি কোনও জাতীয় বৃদ্ধির হারের সহায়ক হতে পারে না। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আঁচ, গ্যাস-ডিজেল-পেট্রোল মিলে এই ত্র্যহস্পর্শে যে জিডিপি, তার ঊর্ধ্বমুখী আগুনে আসমুদ্রহিমাচল আজ জর্জরিত। দেশরক্ষার ভার আজ যাদের হাতে, তাদের নিরন্তর ছলচাতুরি দেশের পক্ষে যে অনুকূল নয়, তা সকলেই বেশ মালুম করতে পারছেন। অর্থ ব্যবস্থা ও সামগ্রিক দেশ পরিচালনার অদক্ষতা, এবং সেই অদক্ষতা অনুধাবন না করে নানা ছলনায় তা ঢেকে দেওয়ার অপচেষ্টা দেখতে দেখতে ভারতবাসী ক্লান্ত! তাঁরা বিকল্প চাইছেন। শাসক প্রধানের নানা গুলগপ্পের মতো এই হিসেব আর মানুষ প্লেটে নিচ্ছেন না। কোনও হিসেবই আর মিলছে না, হাতে পেন্সিল থেকেই যাচ্ছে! সব শো ফ্লপ শো হয়ে যাচ্ছে স্যার!

Latest article