তিন কন্যা
কন্যা -১ : পরপর আঠারোটা সিঁড়ি পার হতে হবে। তারপর ঢুকতে হবে কেরলের হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির শবরীমালাতে, কিন্তু এই মন্দিরে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় সমাজে নারীদের নানা বাধা পেতে হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দিয়েছেন। এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে শর্মিলা নায়ারকে। কুচির এই ডিজাইনার কালো রঙের শাড়ি ডিজাইন করে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত প্রথাকে নাড়া দিয়েছেন। তৈরি করেছেন এক নতুন ক্যাম্পেইন— এইটটিন শেডস অফ ব্ল্যাক, সংখ্যাটা আঠারো এই কারণে— শবরীমালা মন্দিরে ঢুকতে আঠারোটি সিঁড়ি পার হতে হয়। আর কালো রঙের অর্থ হল সবাইকে ওই মন্দিরে কালো পোশাক পরে ঢুকতে হয়। নারীর অধিকার আর ক্ষমতায়ন নিয়ে শর্মিলা ভাবেন— দেবীর অধিকার রক্ষার জন্যে যদি অনেক নারী লড়াই করতে পারে তাহলে নারীর অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ও শামিল হবেন অনেকে। চ্যালেঞ্জ করবে ধর্মীয় অনুশাসন এবং পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থাকে।
কন্যা-২ : চার বছর বয়সে রান্না ঘরে খেলতে গিয়ে চুলা ফেটে সে অগ্নিদগ্ধ হয়। শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশ পুড়ে যায়। চোদ্দোটির বেশি অপারেশন হয় কিন্তু তাতেও ভেঙে পড়েনি কর্নাটকের প্রেমাধন রাজ— ৭২ বছর বয়সি প্লাস্টিক সার্জন। তৈরি করেছেন অগ্নিরক্ষা নামে প্রতিষ্ঠান। পঁচিশ হাজার অগ্নিদগ্ধকে বিনা পয়সায় অপারেশন করেছেন। ইথিওপিয়ায় তৈরি করেছেন প্রথম বার্ন ইউনিট। প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কেনিয়া, তানজানিয়া, নরওয়ে এবং ইথিওপিয়ার ডাক্তারদের। চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রেমা নিজেই হয়ে উঠেছেন একটি প্রতিষ্ঠান।
কন্যা-৩ : কেউ বলেন— হাতি কি পরী। আবার কেউ বলেন— হাতির রানি। ভারতের প্রথম মহিলা হাতি মাহুত পার্বতী বড়ুয়া। ভেঙে দিয়েছেন প্রচলিত স্টিরিও টাইপ ভাবনাগুলো। ছোটবেলায় বাবার সাথে জঙ্গলে ঘুরতেন। দেখতেন বাবা কীভাবে হাতিদের প্রশিক্ষণ দেন। চোদ্দো বছর বয়সে নিজেই বন্য হাতিদের প্রতিপালন শুরু করেন। ষাট ঊর্ধ্ব বয়সে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের প্রয়োগের মাধ্যমে বন্য হাতি মোকাবিলা করেন। তিনটি রাজ্যকে সাহায্য করেন বন্য হাতির মোকাবিলায়।
মেয়েগুলো ছিল ভাল
আধুনিক ভারতে এই তিন কন্যার আখ্যান নারী ক্ষমতায়নের চিত্রনাট্যটা বদলে দিয়েছে। ঘরের ভিতরে থেকে প্রতি মুহূর্তে শ্রম, মেধার বিনিময়ে যাঁরা সংসারকে সুন্দর করে তুলছেন তাঁদের মূল্যায়ন এদেশে উপেক্ষিত। প্রতি মুহূর্তে পরিবার, সংসারের ব্যবস্থাপনায় এই দেশের প্রতিটি মহিলাই যেন দক্ষ ম্যানেজমেন্ট কর্মী। কম রিসোর্সেও অনায়াসে তরতরিয়ে চলছে সংসার। চলছে নারী ক্ষমতায়নের নীরব পাঠ। আজকের এই নারী ক্ষমতায়নের ছবিটা একদিনে অর্জিত হয়নি। দিনের পর দিন সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতে নারী হয়ে উঠেছে কঠোর, পরিশ্রমী, দক্ষ। একটা সময় এদেশে নারীকে মূল স্রোতে আনার ক্ষেত্রে সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিদ্যাসাগর আর বেথুনকেও শুনতে হয়েছিল নানা ব্যঙ্গ ও টিটকিরি। ঈশ্বর গুপ্ত কলম ধরেছিলেন— আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো/ ব্রত ধর্ম করতো সবে/ বেথুন এসে করলো সাবার আর কি তাদের তেমন পাবে/ যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে/ ওরা এ বি (AB) শিখে বিবি হয়ে বিলেতি বোল কবেই কবে/ আর কিছুদিন থাকলে বেঁচে, তোমরা দেখতে পাবেই পাবে/ ওরা ছুটিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে বগি গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।
আরও পড়ুন: যুগপুরুষদের দাম্পত্যজীবন
অনুপ্রেরণার কাব্য
সেদিনের গড়ের মাঠ থেকে এদিনের যুদ্ধক্ষেত্র— সবেতেই নারীর ভূমিকা পাল্টেছে। স্কোয়াড্রন লিডার ভাবনা কান্থ, কর্নেল পনুং ডোমিং এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার অন্নু প্রকাশ এঁরা এখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। অনায়াসে স্কোয়াড্রন লিডার ভাবনা কান্থ তাঁর প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আকাশে ওড়ার অনুপ্রেরণাকে বাস্তবায়িত করেন। তিনি প্রথম মহিলা ফাইটার পাইলট যিনি ২০২১-এর সাধারণতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অংশ নেন এবং ২০২৪ সাধারণতন্ত্র দিবসে ফ্লাই পাস্টেও অংশ নেন। আবার কর্নেল পনুং ডমিং পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে বর্ডার কাস্ক ফোর্সের নেতৃত্ব দেন। আর কমান্ডার অন্নু প্রকাশ সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং অপারেশনে তাঁর দক্ষতাকে সকলের সামনে নিয়ে আসেন। এঁদের জীবন আখ্যান তৈরি করে ভারতে নারীর ক্ষমতায়নে অনুপ্রেরণার কাব্য।
অর্ধেক তার রচিয়াছে নারী
এই পথচলা খুব একটা মসৃণ ছিল না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীর মর্যাদা, ক্ষমতা ওঠানামা করেছে। বৈদিক যুগে মেয়েরা নানান সম্মানিত পদে নিযুক্ত ছিলেন, ঋগ্বেদে শক্তিশালী দেবীদের উল্লেখ আছে। যা নারীশক্তি ও প্রজ্ঞাকে তুলে ধরে। নারী- পুরুষ ক্ষমতায় 50- 50 রবীন্দ্রনাথের কথায়, অর্ধেক তার রচিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। অর্থাৎ অর্ধাঙ্গিনীর ধারণা এই ঋগ্বেদের যুগেই প্রথম পাওয়া যায়। এখানে স্বামী-স্ত্রীর অংশীদারিত্বের উপর জোর দেওয়া হয় যা সামাজিক ভারসাম্য তৈরি করে আর মৌর্য যুগে রানি অশোক ও রানি ধর্মের মত ব্যতিক্রমী নারীদের শাসন এবং সামাজিক কল্যাণে অনায়াস যাতায়াত ছিল। রাজ দরবারের অন্দরমহল থেকে বাইরে এসে বৃহত্তর দায়িত্ব ও সেবা কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
প্রতিরোধের আগুন
মধ্যযুগে নারী অনুপ্রেরণার ছবিটা আবার অন্যরকম। রাজিয়া সুলতানা এবং রানি পদ্মিনীর মতো মহিলারা ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব দেখিয়েছিলেন আর ভক্তি ও সুফি আন্দোলনে প্রথম মহিলাদের আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁরা শিল্প সাহিত্য এবং সামাজিক সংস্কারে নিজেদের কাজের ছাপ রাখতে শুরু করেন। আর উপনিবেশের যুগে রানি লক্ষ্মীবাই, কিত্তুর চেন্নাম্মা এবং বেগম হজর মহলের মতো সাহসী নারীরা ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিহত করেছিলেন। তাঁদের সাহসিকতায় প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার চেতনাকে নিয়ে গিয়েছিল নতুন সকালের দিকে।
স্বাধীনতা পরবর্তী রেনেসাঁ সময় ইন্দিরা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু ও কল্পনা চাওলার মতো মহিলারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের দক্ষতার চিহ্ন রেখে গিয়েছেন। যা রাজনীতি, সাহিত্য ও মহাকাশ অনুসন্ধানে অনুপ্রেরণার পাঠক্রম তৈরি করেছে। আর সংবিধানের সমানাধিকারের স্বীকৃতি নারীর ক্ষমতায়নকে নিয়ে গিয়েছে বহু দূর। নারীরা প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে শিখেছে। অর্থনীতিতে কল্পনা মরপারিয়া থেকে শুরু করে বায়োটেকনোলজিতে কিরণ মজুমদার— তাঁদের সাফল্যের গল্প ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণাকে নাড়া দিয়েছে।
শিকল বাঁধা পথে
সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সংরক্ষণে নারী হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ঐতিহ্যের ধারা, স্বাক্ষর রাখছেন শিক্ষার অগ্রগতিতে। সাবিত্রী বাই ফুলে থেকে শুরু করে শ্যামমোহিনী দেবী, সুফিয়া কামাল সামাজিক রীতি-নীতি ভেঙে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। তবে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে নারীকে উৎসাহিত করতে সাহস ও উদ্দীপনার আগুন জ্বালিয়েছেন রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো সমাজ নেতারা।
ঐতিহ্যগত এবং আধুনিক উভয় প্রেক্ষাপটেই নারীরা যত্নশীল এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী। প্রথাগত নিরাময়কারী হিসাবে বা আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার হিসাবেই হোক না কেন, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের মঙ্গল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না। ভারতে নারীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করছে। উদ্ভাবন, গবেষণা এবং প্রযুক্তি-চালিত সেক্টরে তাদের অবদান আইটি, জৈবপ্রযুক্তি এবং মহাকাশ অনুসন্ধানের মতো ক্ষেত্রে জাতির ভবিষ্যৎ গঠন করছে।
ভারতে মহিলা ক্রীড়াবিদরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে, স্টেরিওটাইপগুলি ভেঙেছে এবং তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। খেলাধুলায় তাঁদের অর্জন ক্ষমতায়ন এবং সমতার বিস্তৃত বর্ণনায় অবদান রাখে।
অলস মস্তিষ্ক বুদ্ধির বাসা
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাল্টি -টাস্কিং এবং মেনে নেওয়ার ক্ষমতায় মহিলার মস্তিষ্কের গঠন তুলনামূলকভাবে ভাল। বিভিন্ন কাজ একসঙ্গে করার দক্ষতায় তাদের ধারে-কাছে কেউ নেই। ঘরের অন্দরমহল থেকে বাইরের জগৎ তাদের হাতের মুঠোয়। নেতৃত্ব, পরিবেশ, সহানুভূতি, এবং সহযোগিতায় তাদের সাবলীলতা ক্ষমতায়নের পাঠ তৈরি করতে সাহায্য করছে। সহানুভূতি এবং একসঙ্গে কাজ করার দক্ষতাকে এক ইতিবাচক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে মহিলারা। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে কাজের। ভালবাসা বাড়িয়েছে পরিবার দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতি। ক্যাটালিন কারিকো, অ্যান ল’হুইলিয়ার এবং ক্যারোলিন বার্তোজির মতো ব্যক্তিত্ব, যাঁরা নোবেল পুরস্কার জিতে বিজ্ঞানের কাচের ছাদ ভেঙে দিয়েছেন, তাঁরা দুর্দান্ত রোল মডেল হিসাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের যাত্রা, আরও অনেকের সঙ্গে, নেতৃত্বের ল্যান্ডস্কেপ পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম নারীদের নেতৃত্বের ক্ষমতার উদাহরণ দেয়।
প্ল্যানেট 50-50
জাতিসংঘের প্ল্যানেট 50-50 নারী ক্ষমতায়নের নতুন মানচিত্র তুলে ধরে। বিশ্বকে জানিয়ে দেয় সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। ক্ষমতায়ন এবং নারী ক্ষমতার প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত করতে হবে। ভেঙে ফেলতে হবে লিঙ্গবৈষম্য। গাল ভরা কথায় নয়, কাজে নতুন ভারতের স্বপ্ন লিখতে হবে। শুধু এই সাফল্যে থমকে গেলে নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। তিন তালাক বন্ধ হয়েছে, সুনিশ্চিত হয়েছে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ, গত দশকের উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ২৮ শতাংশ। সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজের দুনিয়ায় পা রেখেছে মহিলারা।
স্বপ্ন দেখব বলে
মহিলাদের ক্ষমতায়নে রূপ-রং বদলেছে। সাবেক আমলে ক্ষমতায়ন ছিল বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে, অন্দরমহলের চৌহদ্দিতে। বাইরের মানুষ জানতে পারত না সেই অন্দরমহলের ক্ষমতায়নের কথা। তাদের স্বীকৃতি ছিল না, ছিল না মান্যতা। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের এমন নানা গল্প রয়েছে যা আমরা জেনেছি অনেক পরে। গ্রাম আর শহরের এই অন্দরমহলের ক্ষমতায়নের স্বীকৃতির ছবিটা একেবারে আলাদা। বকখালির যে মহিলা সকালে উঠে তাঁর সন্তানকে পাঁচ মাইল দূরের স্কুলে নিয়ে যান সাইকেলে চাপিয়ে, আবার ফিরে আসেন বাড়ির সামনের পুকুরে সরকারি পয়সায় মাছের চাষ করার জন্য। একার সংসারের উপার্জন, সন্তান পালন, আর গ্রামের মহিলাদের পথ দেখানো এক মা (সিঙ্গল মাদার) সদাময়ীর প্রতিদিনের কাজ। তাঁর খবর আমরা ক’জন রাখি। পুরুলিয়ার মৌসুমী সরকার, যিনি ছৌনাচের সামাজিক সংস্কারকে ভেঙে দেন বা মেদিনীপুরের মীনাক্ষী মান্না মহিলাদের মাছ ধরার নতুন পাঠক্রম চালু করেন, তার খবর কি আমরা রাখি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের আরেকটু দায়িত্ব নিতে হবে সময় নিতে হবে। আজ শুধু ফিরে দেখার দিন, আজ শুধু ভাবনার দিন।