যুগপুরুষদের দাম্পত্যজীবন

তাঁরা যুগপুরুষ। মহামানব। দেশের কথা ভেবেছেন। নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন সমাজসেবায়। ডুবে থেকেছেন সৃষ্টি-সাধনায়। মহৎ কাজের জন্য বন্দিত হয়েছেন। দেশে-বিদেশে। তবে দাম্পত্য সঙ্গী হিসেবে তাঁদের অনেকেই থেকেছেন আশ্চর্য রকমের উদাসীন। ব্যর্থ হয়েছেন নারী-মনের অন্দরে প্রবেশ করতে। বহু মনীষীর সহধর্মিণীর দিন কেটেছে চোখের জলে, কষ্ট বুকে চেপে। এইসব অনেকটাই অনালোকিত, অনালোচিত। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। তার আগে মহাপুরুষদের দাম্পত্য-সঙ্গিনী ও দাম্পত্য-জীবনের উপর আলোকপাত করলেন উৎপল সিনহা

Must read

একশো শতাংশ খাঁটি হতে পারেন না কেউই। মহাপুরুষরাও নন। স্ববিরোধিতা দেখা গেছে প্রত্যেকের মধ্যেই। তাঁরা দেশ এবং সমাজের জন্য উৎসর্গ করেছেন নিজেদের জীবন। মেতেছেন সৃষ্টিতে। আলোড়ন তুলেছেন বহির্জগতে। অথচ তাঁদের অনেকেই নিজের ঘরের দিকে তাকানোর অবকাশ পাননি। বহু যুগপুরুষকেই (Yuga Purush ) এই ব্যাপারে আশ্চর্য রকমের উদাসীন থাকতে দেখা গেছে। তাঁরা প্রাপ্য সম্মান দেননি সহধর্মিণীকে। বোঝার চেষ্টা করেননি নারী-মনের গোপন কথা। কখনও কখনও থেকেছেন অতি-মাত্রায় নিষ্ঠুর। ফলে অন্দরমহলে বেড়েছে চাপা কষ্ট, ক্ষোভ। ঝরেছে চোখের জল। এইসব অনেকটাই অনালোকিত, অনালোচিত। কিন্তু এর কারণ কী? সহধর্মিণীরা তাঁদের উপযুক্ত ছিলেন না? তাঁরা কর্মক্ষেত্রে স্বামীদের প্রাণিত করতে ব্যর্থ? নাকি মানসিক দূরত্বই এর মূল কারণ? কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এখন দেখে নেওয়া যাক, কীরকম ছিল যুগপুরুষদের দাম্পত্যজীবন।

আরও পড়ুন: এসেছেন যখন তখন বলে যান আর কত বঞ্চিত হব আমরা?

দিনময়ী ও বিদ্যাসাগর
বীরসিংহ গ্রামের পাশেই ক্ষীরপাই গ্রাম। সেই গ্রামের মেয়ে দিনময়ী ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে হয় ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বালিকা বিদ্যালয়ে পড়া দিনময়ীর বয়স তখন মাত্র ৭ বছর। বিদ্যাসাগর রাত জেগে বই লেখেন। নবীনা স্ত্রী দিনময়ী থাকেন আধো ঘুমে আধো জাগরণে। একরাতে দিনময়ী জানতে চান, ‘তুমি কী লিখছো?’ বিদ্যাসাগর বলেন, ‘সীতার বনবাস।’
দিনময়ী বলেন, ‘তুমি সীতাকে বোঝো?’ বিদ্যাসাগর বলেন, ‘কেন বুঝব না!’
দিনময়ী বলেন, ‘ও পাড়ার চঞ্চলাকে দেখে আমার খুব হিংসে হয়।’ বিদ্যাসাগর বলেন, ‘সুন্দরী নাকি?’ দিনময়ী জানান, ‘সুন্দরী না হলেও তার ভাগ্য ভাল, তার স্বামী বিখ্যাত বিদ্যাসাগর নয়।’
এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে, বিখ্যাত মানুষদের স্ত্রীরা সামাজিক সম্মান পেলেও স্বামীর সান্নিধ্য লাভের ক্ষেত্রে প্রায়শই বঞ্চিত থেকে যান। বিহারীলাল সরকার তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পত্নী দিনময়ী দেবী প্রকৃত গৃহিণী ছিলেন। তিনি স্বহস্তে রন্ধন করিয়া লোকজনকে খাওয়াইতে বড় ভালবাসিতেন। দানধ্যানও ভালবাসিতেন। বর্জিত পুত্র (ত্যাজ্যপুত্র) নারায়ণের জন্য পতির সহিত তাঁহার বাদবিসংবাদ ঘটিত। তিনি গোপনে পুত্রকে অর্থসাহায্য করিতেন। এমনকি নিজের অলঙ্কার পর্যন্ত বন্ধক দিতেন।’
১৮৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে রক্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন দিনময়ী এবং ১৩ অগাস্ট মারা যান। পত্নীবিয়োগে কাতর হন বিদ্যাসাগর, তবে তাঁর নিঃসঙ্গতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় মাতৃভক্তির কথা কে না জানেন? কিন্তু স্ত্রী দিনময়ীর সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যজীবন কেমন ছিল?
বিয়ের সময় ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স ছিল ১৪ বছর। বিয়ের ১৬ বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান নারায়ণচন্দ্রের জন্ম হয়। বিদ্যাসাগর ও দিনময়ীর পাঁচ সন্তান। এক ছেলে ও চার মেয়ে। উদার, স্নেহময়ী, সামাজিক ও গৃহকর্মে পারদর্শী পতি-অন্তপ্রাণ দিনময়ীর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের দূরত্ব বাড়তে শুরু করে পুত্র নারায়ণকে কেন্দ্র করে। পুত্রের প্রতি স্নেহান্ধ দিনময়ী পুত্রের অন্যায়কেও সমর্থন করতেন। বিদ্যাসাগর এটা মেনে নিতে পারেননি। নারায়ণচন্দ্রকে তিনি ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন।
তারপর দীর্ঘ ১২ বছর স্ত্রীকে কোনও চিঠি পর্যন্ত লেখেননি বিদ্যাসাগর। তাঁদের মধ্যে বাক্যালাপও বন্ধ হয়ে যায়।
সারদামণি ও রামকৃষ্ণ
বিশ্ববন্দিত শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদামণি। পরমপুরুষ রামকৃষ্ণের গার্হস্থ্য নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়। একথা সর্বজনবিদিত যে, রামকৃষ্ণ দেবীজ্ঞানে তাঁর স্ত্রী সারদামণিকে পুজো করেছিলেন। কিন্তু এতে সারদামণির স্ত্রীসত্তা কতটা তৃপ্ত হয়েছিল তা জানা যায় না। একজন সাধারণ নারী হিসেবে বিবাহিত জীবনের সাধ-আহ্লাদ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি, নাকি বাধ্য হয়ে, এই প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়েছে কি?
রামকৃষ্ণ আন্দোলনের বিকাশ ও প্রসারে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য, সেই শ্রীশ্রী মা, যিনি রামকৃষ্ণদেবের পত্নী ও সাধনসঙ্গিনী এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী, তাঁর দাম্পত্যজীবন কেমন ছিল?
বাঁকুড়ার জয়রামবাটি গ্রামে সারদার জন্ম। তাঁর বিবাহপূর্ব নাম ছিল সারদামণি মুখোপাধ্যায়। বছর তেইশের গদাধরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। সামান্য এক গ্রাম্যনারীর জীবনের প্রায় শুরুতেই অবিচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্য অনুশীলনের বাধ্যতা নেমে আসে। ১৪ বছর বয়সে তিনি কামারপুকুরে স্বামীর সঙ্গে মাত্র তিন মাস কাটিয়েছিলেন। সেখানে রামকৃষ্ণ তাঁকে ধ্যান ও আধ্যাত্মিক জীবনের নিয়মকানুন অনুশীলন করান। দক্ষিণেশ্বরে সারদা নহবতের একটি ছোট ঘরে থাকতেন। যাকে বলে দাম্পত্য বা বিবাহিত জীবন, তা উপলব্ধি করার সুযোগ ছিল না পতিপরায়ণা এই নারীর। সারদার বয়স যখন ১৮, তখন গুজব রটে তাঁর স্বামী পাগল হয়ে গিয়েছেন। একথা শুনে সারদা তাঁর স্বামীকে দেখতে দক্ষিণেশ্বরে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং পায়ে হেঁটে এতটা পথ আসতে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন ১৮৭২ সাল। দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছে তাঁর সন্দেহের অবসান হয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী পাগল তো নয়ই বরং মহাজ্ঞানী। এরপর ১৮৮৫ সাল অবধি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নহবতের একতলার একটি ছোট্ট ঘরে তিনি বাস করেছিলেন। সারদামণিকেই মনে করা হয় রামকৃষ্ণের প্রথম শিষ্য। রামকৃষ্ণ সারদাকে দেবীর অবতার ভাবতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে সম্মানের একটি উচ্চাসনে বসালেও রামকৃষ্ণ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন জনসমক্ষে খুব কমই আসতেন সারদামণি। তিনি স্বামীর সেবা ও শিষ্যদের জন্য রান্না করার কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। রামকৃষ্ণ যখন গলার ক্যানসারে আক্রান্ত তখন সারদা দেবী দিনরাত স্বামীর সেবায় নিযুক্ত থাকতেন। কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য জীবনের শুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা সমাজ তথা বিশ্বের কাছে বন্দিত হলেও স্বামীর কাছে একজন সাধারণ স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তার কতটুকু পূরণ হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই গেছে।
বিষ্ণুপ্রিয়া ও শ্রীচৈতন্য
যুগপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রথম বিয়ে হয়েছিল লক্ষ্মী নামে একটি মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু প্রথম স্ত্রী বিয়ের মাত্র দু-বছরের মধ্যে অকালে মারা যান। তারপর সন্ন্যাস গ্রহণের বাসনা নিয়ে একজন সন্ন্যাসীর কাছে যান শ্রীচৈতন্য। সেই সন্ন্যাসী তাঁকে বলেন, ‘সংসার না বুঝে সন্ন্যাস নেওয়া যাবে না।’
এরপর বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে নিমাই-এর (শ্রীচৈতন্যদেব, যাঁর আসল নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র ওরফে নিমাই) দ্বিতীয় বিবাহ হয়। কিন্তু মাত্র ২৪ বছর বয়সে নিমাই সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিনি তো সন্ন্যাস জীবনে অসংখ্য ভক্ত ও অনুগামী পরিবৃত হয়ে থাকতেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার বাকি জীবন কীভাবে কেটেছিল?
তাঁর দীর্ঘ ত্যাগ ও তিতিক্ষার জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটুকু জানেন?
ষোড়শ শতাব্দীর নবদ্বীপ ধামের বিশিষ্ট বিদুষী নারী ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী। তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব সাধিকা। স্বামীসঙ্গ না পেয়ে দীর্ঘ বিরহ-যন্ত্রণায় কাতর এই নারী জীবনে অশেষ কষ্ট ভোগ করেন। ভগবানের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া অসংখ্য পতিত ও মূঢ়জনকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দান করার পবিত্র কর্তব্য পালন করেন। মাতৃভক্ত শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের পর মাত্র একবার তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তখন বিষ্ণুপ্রিয়া তাঁর স্বামীকে দেখার সুযোগ পান শেষবারের মতো। স্বামীকে নতজানু হয়ে প্রণাম করার পর মাথা তুলে দেখেন স্বামী আর সেখানে নেই। আদর্শ হিন্দু নারীদের মধ্যে মহীয়সী হিসেবে গণ্য হন বিষ্ণুপ্রিয়া। নিজের নিঃসঙ্গতা নিয়ে কোথাও কোনও অভিযোগ করে যাননি। নীরবে কৃতী স্বামীকে সমর্থন করে গেছেন অগাধ বিশ্বাসে ও ভালবাসায়। ঈশ্বর ও মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন অশ্রু গোপন রেখে। ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা বিসর্জন দিয়েছেন স্বামী-সান্নিধ্য হারানোর দিন থেকেই। একলা নারীর জীবনের স্বপ্নসাধ ও বাসনা নিয়ে ভাবনার অবকাশ পাননি, হয়তো ভাবতেও চাননি মহামানব শ্রীচৈতন্য। বহির্জগতের কষ্টলাঘবে সদাব্যস্ত মহাপ্রভু অন্দরমহলের একলা নারীটির শূন্য হৃদয়ের হাহাকার শোনার সময় পাননি। একদিন মধ্যরাত্রে ঘুমন্ত বিষ্ণুপ্রিয়ার কপালে ও গলায় অলকা-তিলকা এঁকে, সযত্নে ফুলের মালা পরিয়ে ঘরের দরজা খুলে নিঃশব্দে সেই যে বেরিয়ে গেলেন নদের নিমাই শ্রীগৌরাঙ্গ, আর কোনওদিন ফিরলেন না স্ত্রীর কাছে। প্রিয়ার জন্য রেখে গেলেন কান্নার অফুরন্ত অবকাশ। প্রদীপের নিচে রয়ে গেল অন্ধকার।
সারদাসুন্দরী দেবী ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
সারদাসুন্দরী দেবী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা। তাঁর অপর নাম শাকম্ভরী। তাঁর পিতা ছিলেন যশোর জেলার রামনারায়ণ চৌধুরী।
বিয়ের সময় সারদাসুন্দরীর বয়স ছিল মাত্র ছয়। সাংসারিক ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন হলেও স্বামী দেবেন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকলে নিজে রান্না করতেন সারদা। তাঁর শরীর কিছুটা স্থূল ছিল, তাই নড়াচড়ায় অসুবিধা হত। উপাসনার সময় তিনি মহর্ষির কাছে গিয়ে বসতেন। তাঁর পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা থেকে জানা যায় যে, বাবামশায় (মহর্ষি) বাড়িতে থাকলে সকলে শুয়ে পড়ার পর একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন সারদাকে। একটা ধোয়া সুতির শাড়ি পরে, গায়ে একটু আতর মেখে স্বামীর কাছে যেতেন উনি। নিজে ছিলেন ধর্মপ্রাণ মহিলা। তিনি স্বামীর পাশে বসে ব্রহ্মার আরাধনা করতেন, তাঁর ধর্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতেন। কখনও স্বামীর কোনও কাজের বিরোধিতা করেননি।
তবে বহুদিনের অভ্যাসের ফলে কখনও কখনও রমানাথ ঠাকুরের দুর্গোৎসবের পূজক কেনারাম শিরোমণির হাতে কালীঘাট ও তারকেশ্বরে পূজা পাঠাতেন স্বামীর অজ্ঞাতসারে। দেবেন্দ্রনাথ অধিকাংশ সময় বিদেশে কাটাতেন বলে সর্বদা উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত থাকতেন সারদা দেবী। বাড়ির পুজো ও অন্যান্য উৎসবে যোগ দিতেন না। নির্জন ঘরে বসে একা সময় কাটাতেন। স্বামীর নিরাপদ ভ্রমণ ও সুস্থতা প্রার্থনা করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর সন্তানের সংখ্যা ১৫। সারদা দেবী বেঁচে ছিলেন ৪৫ বছর। স্ত্রীর নামে প্রচুর সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু এত অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৫ জন সন্তানধারণ সারদা দেবীর স্বাস্থ্যবৈকল্য তথা অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠেছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ-প্রসঙ্গে মহর্ষির বিবেচনাবোধ নিয়েও প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
হেনরিয়েটা ও মধুকবি
হেনরিয়েটা ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সারা জীবনের সঙ্গিনী। কিন্তু তার আগেই মধুকবির প্রথম বিয়ে হয় রেবেকার সঙ্গে। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। উভয়ের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৮ বছর। তারপর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। রেবেকা ছিলেন অনাথ আশ্রমের ছাত্রী। আর হেনরিয়েটা সোফিয়া ছিলেন এক ফরাসি তরুণী। ইংরেজ আদব কায়দায় প্রভাবিত মধুসূদন ভাবতেন রূপে ও গুণে ইংরেজ মেয়েদের ধারেকাছে আসে না বাঙালি মেয়েরা। মধুর বয়স যখন ১৯, তখন এক বাঙালি পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে স্থির হয় তাঁর। কিন্তু বিয়ের মাত্র ১৫ দিন আগে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন মধূসূদন। ফলে তাঁর বিয়ে ভেঙে যায়। বাঙালি মেয়ে নয়, পশ্চিম দেশের কোনও নীলনয়নাকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার গোপন স্বপ্ন এবার বাস্তবায়নের পথে এগোতে থাকে। অচিরেই জীবনে আসেন প্রথম স্ত্রী রেবেকা। রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্যজীবনের মাঝেই রোম্যান্টিক কবির জীবনে প্রবেশ করেন হেনরিয়েটা। এটা জানাজানি হওয়ার পর প্রচণ্ড আঘাত পান রেবেকা। সমাজ, সংসার ও আত্মীয় পরিজনের সমস্ত বাধা তুচ্ছ করে শ্বেতাঙ্গ রেবেকা গভীর বিশ্বাস ও ভালবাসায় বরণ করেছিলেন অজ্ঞাতনামা কৃষ্ণাঙ্গ কবিকে। কিন্তু কবির এমন ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতায় রেবেকা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন তিনি। ঘটে যায় চিরবিচ্ছেদ। চার সন্তান ও স্ত্রী রেবেকাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে মধুসূদন চলে যান হেনরিয়েটার কাছে। তাঁকে বিয়েও করেন। হেনরিয়েটার গর্ভেও জন্ম নেয় মাইকেলের চার সন্তান। বেহিসেবি কবিকে বিয়ে করে ধনী ও অভিজাত পরিবারের মেয়ে হেনরিয়েটাকে সহ্য করতে হয় নিদারুণ অর্থকষ্ট। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মারা যান হেনরিয়েটা, যিনি নাকি ছিলেন মধুকবির প্রধান প্রেরণা।
বাসন্তী দেবী ও দেশবন্ধু
ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্নিকন্যা বীরাঙ্গনা বাসন্তী দেবী। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ কারাগারে কারারুদ্ধ প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী নারী। তাঁর দাম্পত্য-সঙ্গী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন বাসন্তী দেবী। তাঁকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর বাবার নাম বরদানাথ হালদার। পড়াশোনায় দারুণ মেধাবী ছিলেন বাসন্তী। ১৭ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে। ফলে তিনি আরও জড়িয়ে পড়েন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে।
স্বামী ও স্ত্রী একইসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের স্বাধীনতা তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায়, এমনটা খুব কমই ঘটে। এক্ষেত্রে এঁরা উভয়েই উভয়ের পরিপূরক ছিলেন। দু’জনের জীবনের অন্যতম প্রধান আনন্দ ছিল দেশের কাজ। বাসন্তী দেবী ছিলেন ভীষণ বুদ্ধিমতি ও প্রখর যুক্তিবাদী। তাঁর যুক্তির আলোয় আলোকিত হতেন দেশবন্ধু। তাঁদের ছিল তিন সন্তান। দুই কন্যা ও এক পুত্র। সাংসারিক, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে তাঁরা একে অপরের পরামর্শ নিতেন। ছিল পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদা। ছিল ভালবাসা ও গভীর আস্থা। এমন আদর্শ দম্পতি, বিশেষ করে স্বনামধন্য তথা খ্যাতনামাদের ক্ষেত্রে খুব কমই চোখে পড়ে।

Latest article