দেবলোকে নারীবাদ

পুরুষপ্রধান সমাজ। দেবলোকও তার ব্যতিক্রম নয়। তার মধ্যেও কয়েকজন দেবী ঘটিয়েছেন নারীশক্তির প্রকাশ। কেউ কেউ সমকক্ষ হয়ে উঠেছেন পুরুষ দেবতাদের। কেউ কেউ আবার ছাপিয়েও গিয়েছেন। দেবলোকের নারীবাদী দেবীদের কথায় অংশুমান চক্রবর্তী 

Must read

সতী
ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ। মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। সেখানে সকল দেবতা আমন্ত্রিত। বাদ শুধু শিব এবং সতী। সতী দক্ষের কন্যা। রূপে গুণে অতুলনীয়া। শৈশব থেকেই শিবের প্রতি তাঁর অনুরাগ। নারীত্বে উপনীত হওয়ার পর শিবের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম জন্মায়। যত বীর এবং রাজার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে, সতী তত বেশি আকাঙ্ক্ষা করেছেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। শিবের প্রতি ভক্তি ছিল ব্রহ্মার। তিনি দক্ষের কাছে সবিস্তারে পাত্রের বর্ণনা দেন। সমস্ত শুনে বিস্মিত হন দক্ষ। বলেন, ‘আমি রাজা আর আমার জামাই ভিখারি? এ অসম্ভব।’ পিতার বিরুদ্ধে যান সতী। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। নারীবাদ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। দক্ষরাজ যদি পুরুষশাসিত সমাজের উদাহরণ হন, তাহলে সতীর এই বিরোধিতা এবং নিজের মত প্রতিষ্ঠা করা নারীবাদের উদাহরণ। ব্রহ্মার কথায় দক্ষ বাধ্য হন নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। বিবাহ হয় শিব এবং সতীর। অসবর্ণ বিবাহ। শিব অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিনিধি এবং জাতভিখারি। অন্যদিকে সতী উচ্চবর্গীয়, রাজকন্যা। সেটা সম্ভব হয়েছিল সতীর দৃঢ়তায়। অটল ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে। ঠান্ডা মাথায় পূরণ করেছিলেন অভিষ্ট লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রতিবাদী সত্তাও দেখা গিয়েছে। পিতা যজ্ঞ করছেন শুনে তিনি পিতৃগৃহে যেতে চান। শিব আপত্তি করলে সতী রুষ্ট হয়ে নিজের দশমহাবিদ্যা রূপ দেখান। শিব সেই রূপ দেখে ভয় পান এবং সতীকে পিতৃগৃহে যাওয়ার অনুমতি দেন। এই ক্ষেত্রেও দেখা যায় নারীবাদের (Feminism ) জয়। সতী গেলেন। তাঁকে অপমান করলেন দক্ষ। বর্ষণ করতে লাগলেন শিবের নিন্দা। নিজের কানে পতি নিন্দা শুনে সতী মহারুষ্ট হলেন। পিতাকে তীব্র ভৎর্সনা করার পর যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করলেন। এইভাবেই তিনি প্রতিবাদ লিখে গেলেন জগৎ সংসারে। এই প্রতিবাদও কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধেই। এর মধ্যে দিয়েই রচিত হয়েছে নারীবাদের জয়।

দুর্গা
পরবর্তী সময়ে সতীর জন্ম হয়েছে দুর্গা রূপে। হিমালয়ের ঔরসে। মেনকার গর্ভে। হিমালয় পর্বতের কন্যা। তাই দুর্গাকে পার্বতী নামেও ডাকা হয়। তাঁর আরেক নাম উমা। তিনিই অসুরদলনী। নারীশক্তির প্রতীক। মার্কেণ্ডয় পুরাণ মতে, মহিষাসুরকে পরাস্ত করতে না পেরে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে যান। তখন বিষ্ণুর পরামর্শে দেবতারা নিজ নিজ তেজ দিয়ে সৃষ্টি করেন মাতৃরূপী দেবী দুর্গাকে। দেবতারা তাঁদের অস্ত্রও দুর্গাকে দিয়েছিলেন। দেবীকে সাজিয়ে তুলেছিলেন অসুর বধের জন্য। তারপর দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করেন। আসলে যেখানে পুরুষ শক্তির শেষ, সেখানেই নারীশক্তির শুরু। দুর্গা আবার মহাদেবকেই স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য তপস্যা শুরু করেন। তাঁর এই চাওয়ার মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে সুপ্ত নারীবাদ (Feminism)। তিনি নির্বাচন করেছিলেন ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষটিকে। তপস্যায় সন্তুষ্ট মহাদেব তাঁকে বিবাহ করেন। ক্রমে দুর্গা সংসারধর্ম পালন করতে থাকেন। এই গার্হস্থ্য জীবন দুর্গা বেছেছিলেন স্বেচ্ছায়। এইভাবেই দুর্গা গেয়েছেন নারীশক্তির জয়। আজ জগৎ জুড়ে তাঁর সমাদর পুরুষ দেবতার থেকে কোনও অংশে কম নয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশিই।

আরও পড়ুন: এসেছেন যখন তখন বলে যান আর কত বঞ্চিত হব আমরা?

অন্নপূর্ণা

দেবী দুর্গার আরেক রূপ অন্নপূর্ণা। তিনি সন্তানের ক্ষুধা নিবারণ করেন। পুরাণ মতে, মহেশ্বরকে ভিক্ষা দিতেই অন্নপূর্ণা রূপে আবির্ভাব হয় দুর্গার। লোককাহিনি অনুসারে, শিব যোগীরাজ হলেও, আদতে একজন ভিক্ষুক। অন্য দেবতাদের তুলনায় তাঁর ঐশ্বর্য্য সামান্য। ভাঁড়ার শূন্য। এই নিয়ে শিব-দুর্গার নিত্য কলহ। একদিন প্রবল বিবাদের জেরে দুর্গা জগতের সব অন্ন হরণ করে কাশীতে আশ্রয় নিলেন। জগতে কারও ঘরে অন্ন নেই। দেখা দেয় খাদ্যাভাব। শিব ভিক্ষা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত। খিদের চোটেও নাকাল। দেবী লক্ষ্মী তাঁকে কাশীধামে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সেখানে শিব দেবী অন্নপূর্ণার দর্শন পেলেন। ভিক্ষার পাত্র হাতে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। অন্নপূর্ণার কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে শিব পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করলেন। তারপর থেকে পৃথিবীতে কখনও খাদ্য ও জলের অভাব হয়নি। স্বয়ং মহাকাল যার কাছে ভিক্ষা গ্রহণ করেন, ত্রিভুবনের সকলে তো তাঁর কাছেই মাথা নত করবেই। এইভাবেই প্রকাশ পায় অন্নপূর্ণার মহিমা। শুধুমাত্র অন্ন নয়, তিনি শিবের মাধ্যমে জগৎকে ভরসা দানও করেছেন। এইভাবেই আরও একবার জয় হয়েছে নারীশক্তির।

জগদ্ধাত্রী

দেবী জগদ্ধাত্রী দুর্গারই ভিন্ন রূপ। তিনিও ত্রিনয়না। সিংহবাহিনী। তবে, দুর্গার মতো দশভুজা নন, চতুর্ভুজা। কথিত আছে তিনি করী বা হস্তিরূপী অসুর করীন্দ্রাসুরকে বধ করেছিলেন। সেই কারণে তাঁকে বলা হয় করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। নানা রূপের মধ্যে মহিষাসুর করী বা হাতির রূপও ধারণ করেছিল। সেই সময় মহিষাসুরকে শায়েস্তা করতে দেবী দুর্গা চতুর্ভুজা রূপে আবির্ভূতা হন। চক্র দিয়ে হাতির শুঁড় কেটে দেন। দেবীর সেই রূপকেই বলা হয় জগদ্ধাত্রী। তিনি জগৎকে ধারণ করেন। তাঁর মধ্যে দিয়েও সূচিত হয়েছে নারীশক্তির জয়। মহিষাসুর করীকে বধ করে তিনি জগতে শান্তি এনেছিলেন।

কালী

দেবী দুর্গার আরেক রূপ কালী। তিনি ভয়ঙ্করী। সৃষ্টি করেন, আবার সংহারও করেন। ঘটনাক্রমে দেবাদিদেব মহাদেবকে পদতলে রাখেন। কালীকে কেবলমাত্র নারী ভাবলে ভুল হবে। তিনি নারীর অধিক। কখনও কখনও পুরুষ। তিনি অব্যক্ত জগদকারণ প্রকৃতি, বোঝার সুবিধার জন্য মা ডাকা হয়। তিনি নারীবাদী (Feminism ) আইকন। নারী শক্তির মূর্ত প্রতীক।

সরস্বতী

বিদ্যার দেবী সরস্বতী। তিনি আপাত শান্ত। তবে তাঁর অন্য রূপও দেখা গিয়েছে। পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা। সরস্বতী তাঁকে বিশ্বকে কীভাবে আরও সুন্দর করে তোলা যায়, সেই পরামর্শ দেন। পুরাণের কাহিনি অনুসারে, একবার কোনও একটি অনুষ্ঠানে ব্রহ্মার পাশে সময়মতো উপস্থিত হতে পারেননি সরস্বতী। সেই কারণে ব্রহ্মা গায়ত্রী নামে নিজের আরও এক স্ত্রীর সৃষ্টি করেন। সেটা জানতে পেরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন সরস্বতী। তিনি ব্রহ্মাকে অভিশাপ দেন যে, ত্রিদেবের অন্যতম হলেও মর্ত্যলোকে ব্রহ্মার পুজো করা হবে না। সেই কারণে শিব ও বিষ্ণু পূজিত হলেও, ব্রহ্মার মন্দির সেভাবে কোথাও দেখা যায় না। সরস্বতী ছিলেন অতি বুদ্ধিমতী। দেবরাজ ইন্দ্রের দরবারে উপস্থিত হয়ে তিনি ঋষিদের উপদেশ দিতেন। নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন শিবকেও। দেবলোকে এই দেবীর যথেষ্ট গুরুত্ব। তাঁর প্রতি পুরুষ দেবতাদের ছিল দারুণ ভরসা।

লক্ষ্মী

ধনসম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী। স্কন্দ পুরাণে বলা আছে, বিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তিনি সমুদ্রে গিয়ে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। অন্যান্য দেবতারা বিষ্ণুর ছদ্মবেশে তাঁর কাছে যান। লক্ষ্মী জানতেন, একমাত্র বিষ্ণুই পারেন বিশ্বরূপ দেখাতে। তিনি বিশ্বরূপ দেখানোর জন্য দেবতাদের অনুরোধ করেন। তাঁরা পারেন না। অবশেষে লক্ষ্মীর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাঁর কাছে উপস্থিত হন। বিশ্বরূপ দর্শন করান। তাঁদের বিবাহ হয়। এই ঘটনা লক্ষ্মীর বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। একবার দুর্বাসা মুনির অভিশাপে তিনি স্বর্গরাজ্য ছেড়ে চলে যান। দেবতারা হারান ধনসম্পত্তি। অসুররা স্বর্গরাজ্য দখল করে। দেবতারা পড়েন মহা সমস্যায়। বিষ্ণুর পরামর্শে করা হয় সমুদ্র মন্থন। অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে ধন্বন্তরী ওঠেন। সমুদ্র থেকে বেরিয়ে আসেন লক্ষ্মী। ঠাঁই নেন বিষ্ণুর বুকে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিষ্ণু পরামর্শ করতেন লক্ষ্মীর সঙ্গে। দেবতাদের কাছে দেবীর গুরুত্ব ছিল।

মনসা

সর্পদেবী মনসা। পুরাণ মতে, তিনি লৌকিক দেবী। তথাকথিত নিকৃষ্ট জীবের দেবী হিসাবে বর্ণিত হন। স্বর্গে স্থান পাওয়া নিয়ে তাঁর লড়াই। বলা হয়, শিবের স্ত্রী চণ্ডী মনসাকে ঘৃণা করতেন। তাঁদের বিভেদ রচিত হয়েছে বারবার। মনসার চোখ অন্ধের কারণও নাকি এই বিবাদ। মনসার বিচরণে সর্বত্র উঠে এসেছে চরম উপেক্ষা, অবহেলার প্রসঙ্গ। অবহেলা থেকেই ক্ষোভ। শিবের অন্য কন্যাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও মনসার ক্ষেত্রে সমস্যা ঘটে। মনসার বন্ধু হয়েছেন সমাজের নিম্নস্তরের কেউ। একাধিক বার প্রতিহিংসাপরায়ণ নারী হিসেবেই বর্ণিত হয়েছেন তিনি। ফুঁসে উঠেছেন। ছিনিয়ে নিতে চেয়েছেন গুরুত্ব, নিজের প্রাপ্য। চাঁদ সওদাগরের বাম হাতের পুজো পেয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই লড়েছেন। তার জন্য যতটা সম্ভব নেমেছেন নীচে। হাল ছাড়েননি। অবশেষে উচ্চবর্গীয় সমাজে নিজের প্রতিষ্ঠা আদায় করে নিয়েছেন। এই অদম্য এবং অসামান্য লড়াই দেখে আদর্শ নারীবাদী (Feminism ) হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যায়।

Latest article