লেখক হিসেবে অবলা বসু ১৩০২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ ও পৌষ এই দুই সংখ্যা জুড়ে ‘মুকুল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল একটি ভ্রমণ কাহিনি ‘কাশ্মীর’। লেখাটির সঙ্গে ছাপা হয়েছিল বেশ কিছু ছবি। লেখকের নাম অবলা বসু। তখন পত্রিকাটি নবীন, মাত্রই চার মাস হল প্রকাশ পেতে শুরু করেছে অথচ কিশোরপাঠ্য পত্রিকা হিসেবে ততদিনেই ‘মুকুল’ বেশ প্রতিষ্ঠিত। আর এই লেখাটি দিয়েই সূচনা ঘটল অবলা বসুর ভ্রমণ-কাহিনি লেখার।
এইসময় ‘মুকুল’-এর সম্পাদক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। বছর কয়েক পরে ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (অর্থাৎ ১৯১৮ সাল) অগ্রহায়ণ মাসে এই পত্রিকার শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। ‘মুকুল’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মতো তখনকার প্রতিষ্ঠিত এবং প্রকাশনা-দক্ষ মানুষজন। শিবনাথবাবুর সম্পাদনার যে পাঁচটি বছর, ওই সময়টাকে পত্রিকার স্বর্ণযুগ বলা চলে। কারা লিখতেন না? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে যোগীন্দ্রনাথ সরকার, কুসুমকুমারী দাশ, দীনেন্দ্রকুমার রায়, কামিনী রায়, জলধর সেন-এর পাশাপাশি এই পত্রিকায় লিখেছেন জগদীশচন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও। পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ পেত ব্রাহ্মসমাজের আলোকপ্রাপ্ত নারীদের লেখাও। যাঁদের অন্যতম লাবণ্যপ্রভা বসু এবং অবলা বসু। সম্পর্কে যাঁরা ননদ-বউদি।
সে আমলের নিরিখে যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত অবলা বসু বহুবিধ সামাজিক কাজকর্মের পাশাপাশি কখনওই অবহেলা করেননি কলমের প্রতি। আর তাঁর বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকায়। দীর্ঘ কুড়ি বছর সময়কালে অবলা বসুর উনিশটি গদ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘মুকুল’-এ। যেগুলির মধ্যে ‘বন্দীর মুক্তি’ গল্প, বাকিগুলি ভ্রমণ-কাহিনি। আর প্রায় প্রত্যেকটি রচনার সঙ্গেই ছিল ছবি, অর্থাৎ সচিত্র। এছাড়াও ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় অবলা বসুর দুটি রচনা প্রকাশিত হয়, ভাদ্র ১৩২৯ সংখ্যায় ‘বিদ্যাসাগর বাণী-ভবন’ এবং বৈশাখ ১৩৩২ সংখ্যায় ‘বাঙ্গালী মহিলার পৃথিবী ভ্রমণ’। দ্বিতীয় লেখাটি থেকে বেশ কিছু অংশ বহু জায়গায় উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে একাধিকবার।
এ ছাড়া নারীশিক্ষা বা নারী স্বাধীনতার নানা দিক নিয়ে তাঁর একাধিক ইংরেজি লেখা প্রকাশ পেয়েছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মডার্ন রিভিউ’তে। তাঁকে অনেকেই যে উনিশ শতকের ফেমিনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, সে অভিধা মোটেই অতিরঞ্জিত নয়।
খ৷ ভ্রমণপিপাসু বসু-দম্পতি
অধ্যাপনার চাকরি এবং বিবাহ, জীবনপথে এই দুই বিশিষ্ট চিহ্ন জগদীশচন্দ্রের যাপনে এনে দিয়েছিল অবশ্যম্ভাবী কিছু সফরযতি। বৈজ্ঞানিক সফরে বিদেশযাত্রাগুলির পাশাপাশি প্রতি বছরই দু’বার অন্তত বসুদম্পতি বেরিয়ে পড়তেন দেশের নানা প্রান্তে, নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই। আবার কখনও দু’জনের সঙ্গী হতেন চেনাপরিচিত অনেকেই, ভগিনী নিবেদিতা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবধি যার বিস্তার।
জগদীশ-অবলার ভ্রমণের সূত্রপাত সাঁচি স্তূপ দিয়ে। বুদ্ধের দেহাবশেষের ওপর রাজা অশোক নির্মিত এবং তাঁর স্ত্রী দেবীর তত্ত্বাবধানে চালিত এই স্তূপটি দেখতে আসেন জগদীশ-অবলা। ঐতিহাসিক স্থান দেখবার প্রতি তাঁদের আগ্রহের প্রথম নিবৃত্তি এই সফর। যা এরপরে চলবে তাঁদের দাম্পত্যজীবনের প্রায় পুরো পর্ব জুড়েই। যেমন পরবর্তী একটি সফরে তাঁরা গিয়েছিলেন চিতোরের দুর্গ দেখতে।
প্রতিটা ভ্রমণেই জগদীশচন্দ্র নিজেই ক্যামেরায় তুলতেন একাধিক ছবি। এমনিতে যন্ত্রপাতির প্রতি তাঁর আগ্রহ আবাল্যকালের, সেই আগ্রহেরই একটি অন্যতর নমুনা তাঁর ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ। তাই প্রতিটি ভ্রমণের সময় নিজস্ব ক্যামেরা নিতে ভুলতেন না জগদীশচন্দ্র। দিবাকর সেনের লেখায় দেখি— ‘বেড়ানোর সময় জগদীশচন্দ্র ১০×১২ প্লেটের ক্যামেরা নিয়ে যেতেন আর ফটো ডেভেলাপ করা, এনলার্জ করা, প্রিন্ট করা সবই জগদীশচন্দ্র ও অবলাদেবী একসঙ্গে করতেন।’
আরও পড়ুন : উলভসকে হারিয়ে শীর্ষে ম্যান সিটি
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, তাঁদের ভ্রমণের সময়ে তোলা এরকম কিছু ছবি দেখা গেলেও আজ আর পাওয়া যায় না অধিকাংশ ছবিই, বা কোনও ছবির নেগেটিভই। আর সে ক্যামেরাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে কবেই! কোথায় কোথায় ঘুরতেন তাঁরা? জগদীশচন্দ্রের ভাগনে দেবেন্দ্রমোহন বসুর একটি স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় কোন কোন এলাকা স্থান পেয়েছিল তাঁদের সফরসূচিতে, তার একটি তালিকা— অজন্তা, ইলোরা, সারনাথ, বুদ্ধগয়া, পাটলিপুত্র, নালন্দা, তক্ষশীলা, বদরিনাথ, কেদারনাথ, পুরীর মন্দির, ভুবনেশ্বর, কোনারক, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু মন্দির, লখনউ, নৈনিতাল, পাঞ্জাব ইত্যাদি অজস্র স্থানে তাঁরা যৌথভ্রমণ সম্পন্ন করেছিলেন। তাঁদের ভ্রমণের প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের জগদীশচন্দ্রকে লেখা একটি চিঠিতেও। সফরগুলির মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করা দরকার ১৯০৪ সালের রাজগীর-বুদ্ধগয়া ভ্রমণটিকে, কারণ সেই ভ্রমণের নানা দিক পরবর্তীতে নিজেদের স্মৃতিচারণে তুলে এনেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা যদুনাথ সরকারের মতো সফরসঙ্গীরা। ১৯০৯ সালে তাঁদের অজন্তা বেড়াবার স্মৃতি রয়েছে চিত্রশিল্পী অসিত হালদারের লেখায়।
জগদীশচন্দ্রের বিদেশে বৈজ্ঞানিক অভিযান বা সফর শুরু হয় ১৮৯৬ সাল থেকে। ততদিনে তাঁদের দাম্পত্যজীবন নয় বছর পূর্ণ করেছে। আর এর পর থেকে যতবার বিদেশে এরকম সফরে গিয়েছেন জগদীশচন্দ্র, প্রতিবারই সঙ্গে নিয়েছেন অবলা বসুকে। তাঁরা একত্রে ঘুরেছেন লন্ডন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, আফ্রিকা, আমেরিকা, মিশর, জাপান ইত্যাদি বহু দেশের প্রচুর শহরে। জগদীশচন্দ্র সেসব ভ্রমণের কথা নিজের লেখায় প্রায় তুলেই আনেননি, সে খামতি কিছুটা পূরণ করবার চেষ্টা করেছেন অবলা বসু। অবলা বসুর বিদেশ সফর আমরা পরবর্তী একটি অনুচ্ছেদে আলোচনা করব।
তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করবার, অবলা বসুর সব ভ্রমণই স্বামী জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে, অথচ একমাত্র ‘আগ্নেয়গিরি দর্শন’ লেখাটিতে দু’বার ‘সাথী’ শব্দটা ছাড়া অন্য কোথাও তিনি স্বামীর কথা লেখেনইনি। তবে তিনি যে প্রতি ক্ষেত্রেই স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে থাকবার কাজটি করে গিয়েছেন জীবনভর, এতে কোনও সন্দেহ দেখি না।
আরও একটা কথা এখানে বলে নেওয়া যাক, পত্রিকার পাতায় অবলা বসুর প্রথম প্রকাশিত ভ্রমণকাহিনি ‘কাশ্মীর’ হলেও কাশ্মীরের আগে তিনি আরও একাধিক জায়গায় ভ্রমণ যে করেছিলেন সেটা তাঁর এই লেখার মধ্যে থেকেই জানা যায়।
গ৷ উনিশ শতকের বাঙালি মহিলাদের ভ্রমণকথায় অবলা বসুর স্থান
‘প্রবন্ধাবলী’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে, প্রকাশক ছিলেন শকুন্তলা শাস্ত্রী। এই বইটিতে যে গদ্যগুলি ছিল, কোনওটিতেই আলাদা করে ছিল না লেখক কে, জগদীশচন্দ্র নাকি অবলা বসু। আর তখন থেকেই সমস্যার সূচনা। এরপরে জগদীশচন্দ্রের একাধিক রচনা সংকলনে ঠাঁই পেয়ে যেতে শুরু করে এই বইয়ের একাধিক গদ্য। অথচ সেগুলির বেশিরভাগই ছিল অবলা বসুর লেখা। তাছাড়া এই লেখাগুলি কবে কোথায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, বইটিতে ছিল না সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও।
খুবই আশ্চর্যের যে, এত বড় একজন মহীয়সী মহিলার নিজস্ব একক কোনও বই এতকাল প্রকাশ করবার কথা ভাবেননি কেউই। সেই অসম্পূর্ণতা কিছুটা পূরণ হয় বছর ২০১৫ সালে। ‘অবলা বসুর ভ্রমণকথা’ নামে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ পায় সে বছর পরশপাথর প্রকাশন থেকে। উপলক্ষ যদিও তাঁর জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী পালন, তবু এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশের জন্য কোনো উপলক্ষ-চিহ্নের প্রয়োজন পড়ে, এমনটা আমরা মনে করি না। জগদীশচন্দ্রের বিদূষী স্ত্রীর অন্য নানাবিধ পরিচয় আমরা এতদিন পেয়ে থাকলেও তাঁর লেখবার হাতটিও যে মোটেই অবহেলার যোগ্য নয়, সে কথা প্রকাশ পায়নি বড়। এই সংকলন সেই পরিচয়কে প্রকাশ্যে এনেছে।
তাঁর ভ্রমণকথা লিখবার মূল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি প্রথম প্রকাশিত লেখাটির শুরুর বক্তব্য থেকেই— ‘ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশের বালক-বালিকাগণ বাল্যকাল হইতেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়িতে ভালবাসে, তাহার সুফল এই হয় যে, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা নূতন দেশ আবিষ্কারের জন্য প্রাণ পর্য্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হয়।
আমাদের এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাঠ করিয়া এতটা না হইলেও আশা করি তোমাদের মধ্যে অনেকের মনে নানাস্থান ভ্রমণ করিয়া প্রকৃতির শোভা দেখিবার আগ্রহ জন্মিবে।’
মূলত শিশুকিশোরদের মতো করে লিখেছিলেন বলেই হয়তো তাঁর লেখা দেখি যথেষ্ট সহজ সরল। আর সেগুলির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছিল সাদাকালো ছবিগুলি। সে আমলের অন্য মহিলা লেখকদের মতো অবলা বসু তাঁর ভ্রমণ-লেখায় নারী স্বাধীনতা বা নারীদের অধিকার বুঝে নেওয়ার মতো বিষয়গুলিকে রাখেননি প্রায়। সেসব আমরা দেখব তাঁর শিক্ষাবিষয়ক অন্য গদ্যগুলিতে।
আরও পড়ুন : আজাজের রূপকথার নেপথ্যে প্রাক্তন ভারতীয়
এমনিতে উনিশ শতকের বাংলা ভ্রমণ-কাহিনি বললেই মনে পড়ে একটি বাক্য ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। হ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পালামৌ ভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা-বর্ণনা আজও স্মৃতির কোণে জমিয়ে রেখেছে বাঙালি। কিন্তু বাঙালি মহিলার ভ্রমণ-কাহিনি? এ আমলে এই ক্ষেত্রটিতে নবনীতা দেবসেন সোনা ফলিয়ে গেলেও উনিশ শতকে ব্যাপারটা সুলভ ছিল না মোটেই। ভ্রমণ-কাহিনি লেখা বা প্রকাশ করা তো দূরের কথা, সেই সময় বাঙালি মহিলাদের ভ্রমণে বেরোনোটাও তো আজকের মতো জলভাত ছিল না। হাতেগোনা যে কয়েকজন সৌভাগ্যবতী পেয়েছিলেন সেই সুযোগ, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথমেই নাম করা দরকার ঠাকুরবাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী হওয়ার সুবাদে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন বিভিন্ন রাজ্যে বাস করবার, এমনকী বিলেতে যাওয়ারও। ছোট ছোট দুটি শিশুপুত্র-কন্যাকে নিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উনিশ শতকের শেষ দিকে একলা জাহাজে পর্যন্ত চেপে বসেছিলেন বিলেত যাত্রার উদ্দেশ্যে, এ ইতিহাস আজকের দিনেও আমাদের রোমাঞ্চিত করে। যদিও তিনি নিজে তাঁর এই ভ্রমণের কোনও অভিজ্ঞতা লিখে রেখে যাননি।
প্রায় একই সময়ে ভ্রমণ কাহিনি লিখেছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী বা প্রিয়ম্বদা দেবীও। স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২। অবলা দেবীর চেয়ে ছ-বছরের বড়) সম্পাদনা সূত্রে জড়িত ছিলেন ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব পত্রিকা ‘ভারতী’র সঙ্গে, তাই তাঁর লেখাগুলিও প্রকাশিত হত এই পত্রিকাতেই। ১৮৮৫-৮৬ থেকে ১৯১২-১৩ অবধি দীর্ঘ সাতাশ-আঠাশ বছরে তাঁর প্রায় সাত-আটটি লেখা প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে নাম করা যেতে পারে প্রয়াগ, দার্জিলিং, সোলাপুর, উটি, বা পুরীর ভ্রমণ-কাহিনির কথা।
প্রসন্নময়ী দেবীর (১৮৫৭-১৯৩৯) কথা খুব বেশি জানা না গেলেও তিনি যে সে আমলের একজন পরিচিত কবি ছিলেন, এবং তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল, জানা যায় তা। তাঁর লেখা ভ্রমণ কাহিনি ‘আর্য্যাবর্ত্ত’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৮ সালে।
বাঙালি মহিলাদের মধ্যে প্রথম বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লেখেন যিনি, তাঁর নাম কৃষ্ণভাবিনী দাস। তাঁর লেখাটির নাম ‘ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা’। ১৮৮২ সালে তিনি বিলেত যাত্রা করেছিলেন এবং সেখানে আটটি বছর কাটিয়ে দেশে ফেরেন। তাঁর বিলেতবাসের প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে, জে এন ব্যানার্জি অ্যান্ড সন্স থেকে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, বইটিতে কোথাও লেখক হিসেবে কারও নাম ছিল না। সমাজের রক্ষণশীলতার ধ্বজাধারীদের আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতেই কি এই আড়াল? যদিও পরে এই বইটি বাঙালি মহিলার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ-কাহিনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইউরোপের বাইরের কোনও দেশের ভ্রমণ-কথা পাওয়া গেল কিছু বছর পরে, বিশ শতকে এসে। জাপানে ভ্রমণ বা দিনযাপনের অভিজ্ঞতা ধরা পড়ল ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হরিপ্রভা তাকেদার লেখা ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ বইয়ে। হরিপ্রভার সঙ্গে জাপানি যুবক তাকেদার বিয়ে হয় ১৯০৭ সালে। এরপর ১৯১২ সালে হরিপ্রভা জাপান যাত্রা করেন। আর এরই তিন বছর পরে ১৯১৫ সালের এপ্রিলে অবলা বসু জাপান ঘুরে আসেন। তাঁর সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মুকুল-এ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। পরবর্তীতে তাঁর এই জাপান ভ্রমণে নিজের চোখে দেখা সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার হাল তুলনা হিসেবে তুলে এনেছিলেন তাঁর ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ নামে একটি লেখায়। অবলা বসু আরও একটি দিক থেকে এগিয়ে, মেয়েদের মধ্যে ইউরোপ ছাড়া অন্য কোনও দেশ ভ্রমণের কাহিনি তিনিই প্রথম লেখেন বাংলায়। ১৮৯৮ সালে তাঁর ইতালি ভ্রমণ নিয়ে দুটি লেখা প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ পত্রিকায়। এরই কিছু পরে ১৯০৮ সালে আমেরিকা ভ্রমণ নিয়ে তাঁর ‘আমেরিকার বালকবালিকার কথা’ লেখাটি প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’-এ। এটাকেই বাঙালি কোনও মহিলার লেখা আমেরিকা ঘোরবার ইতিবিবরণ বলে চিহ্নিত করেছেন ভ্রমণসাহিত্য গবেষক দময়ন্তী দাশগুপ্ত।
বিদেশ-ভ্রমণের ব্যাপারে আর একজনের কথা উল্লেখ না করা খুবই অনুচিত হবে। তাঁর নাম জগৎমোহিনী চৌধুরী। তিনিই প্রথম, যিনি একাকী কোনও পুরুষসঙ্গী ছাড়াই বিলেত যাত্রা করেন ১৮৯৪ সালে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে, আর লেখাটির নাম ‘ইংলন্ডে সাত মাস’। বিশ শতকের প্রথম দিকে এরপর একে একে দেখি বাঙালি মহিলারা বেরিয়ে পড়ছেন বিদেশের বিভিন্ন দেশে। বাঙালি মহিলাদের কাছে তখন থেকে বিদেশ অনতিগম্য নেই আর।
[কৃতজ্ঞতা : দময়ন্তী দাশগুপ্ত]