এমনটা হয়েছিল ২০১৭য়। ‘বাহুবলী টু : দ্য কনক্লুশন’ ছবিতে। চোখে যথার্থই ঝিলমিল লেগে গিয়েছিল। ২০১৫-র ‘বাহুবলী : দ্য বিগিনিং’কে ছাপিয়ে তাঁর সিনেম্যাটিক ক্যানভাসকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন পরিচালক রাজামৌলি। এবার প্রতীক্ষা ছিল রাজার সেই আসন ধরে রাখতে পারবেন কি না। ‘আর আর আর’ রিলিজের প্রথম ক’দিনেই উত্তর পেয়ে গেছেন সিনেমামোদী দর্শক। আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ‘বাহুবলী’ ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়েই, ‘আর আর আর’-এ দেশের গণ্ডিও ছাপিয়ে সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন রাজামৌলি। এবার পুরোটাই কল্প-কাহিনি নয়, দেশভক্তি, জাতীয়তাবাদের চিরকালীন আবেগকে দৃঢ় করতে আশ্রয় নিয়েছেন ‘রিয়েল লাইফ’ হিরোদের জীবনীর। যার মধ্যে দক্ষিণী অস্মিতার জোরালো প্রভাব থাকলেও মূল সুর ছুঁয়ে যায় আপামর দেশকে। এর সঙ্গে মিশিয়েছেন নিজের ব্যাখ্যাতীত সিনেম্যাটিক ভিশনকে, নিয়েছেন গুচ্ছের সিনেম্যাটিক লাইসেন্স। কিন্তু কী বা এসে-যায় তাতে। হল-এ ঢুকে প্রথম দৃশ্য থেকেই তো দর্শক হিপনোটাইজড! আর এমনটা যে হবে তা যেন জানতেন তিনি। ছবির প্রচারে দুই নায়ককে নিয়ে কলকাতা ঘুরে যাওয়ার সময়েও সেই আত্মপ্রত্যয় ছিল চোখে-মুখে। অতিমারি ও তৎসংক্রান্ত বিধি-নিষেধ যে তাঁর ছবির জন্য বাধা হবে না সেই বিশ্বাস ছিল কথায়। দেশের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি এখন অবশ্যই এস এস রাজামৌলি (S S Rajamouli)!
নামকরণের নেপথ্যে
‘আর আর আর’ এই নামের পিছনে এক মজার কাহিনি জানিয়েছেন রাজামৌলি (S S Rajamouli) নিজেই। ছবি শুরুর সময় ওয়ার্কিং টাইটেল হিসেবে ‘আর আর আর’ ব্যবহার করেছিলেন, দুই নায়ক আর নিজের নামের আদ্য অক্ষর দিয়ে। রাজামৌলি, রামচরণ আর রামা রাও(জুনিয়র)। হ্যাশট্যাগ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সে খবর দেওয়ার পর মুহূর্তে ভাইরাল হয় ছবির কথা। শেষ অবধি দর্শক আবেগকে মর্যাদা দিতেই টাইটেলে রেখে দেন ‘আর আর আর’। পরবর্তীতে কাহিনির সঙ্গে একটা জুতসই সামঞ্জস্যও খুঁজে পাওয়া যায় বলে ‘আর আর আর’-এর ব্যাখ্যা হিসেবে পোস্টারে জুড়ে দেন ‘রাইজ, রোর, রিভোল্ট’!
কাহিনির নেপথ্যে
‘আর আর আর’-এর মূল কাহিনি দুই দক্ষিণী দেশনায়ক কোমারাম ভীম এবং আল্লুরি সীতারামা রাজু’র বীরগাথা নিয়ে। আল্লুরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাম চরণ ও ভীমের চরিত্রে জুনিয়র এন টি রামা রাও। দুই বিপ্লবীই লড়েছিলেন মূলত আদিবাসীদের বনের অধিকার দিয়ে। যে অঞ্চলগুলির জন্য তাঁরা লড়েছিলেন সেগুলি এখন তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যে পড়ে। দুই রাজ্যেই দুই বিপ্লবীর স্মরণে নামাঙ্কিত আছে দুটি জেলা। এখনও সেখানে মূলত আদিবাসীদেরই বাস। রাজু নিজে আদিবাসী না হলেও পরিচিত ছিলেন ‘ম্যানাম বীরদু’ অর্থাৎ জঙ্গলের বীর নামে। ১৯২২-২৪-এ ‘রাম্পা বিদ্রোহ’-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশ, বন ও রাজস্ব আদায়কারী আধিকারিকদের বিরুদ্ধে। তাঁর নেতৃত্বে আদিবাসীরা এক অসম লড়াই লড়েছিলেন এমনকী থানাতেও আক্রমণ করেছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশকে ঘোল খাইয়ে দেওয়া রাজুর মাথার দাম ঘোষণা করেছিলেন সরকার পক্ষ।
আর কোমারাম ভীম ছিলেন গোন্ড সম্প্রদায়ের জননেতা। শৈশব থেকেই দেখেছিলেন নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর পুলিশ, নিজামের অত্যাচার। তাঁর বাবাকেও খুন হতে হয়েছিল এঁদের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের হাতে। বাইরের জগৎ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতেন না ভীম। প্রথাগত শিক্ষাও কিছু ছিল না। শুধু স্লোগান তুলেছিলেন, ‘জল, জঙ্গল, জমিন’। নিজামের এক কর্তাকে খুন করে গা-ঢাকা দিতে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন অসমে। নিজেকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে ফের স্বভূমিতে ফিরে স্বাধীন গোন্ড রাজ্যের দাবিতে ভীম গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন নিজামের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সমকালীন এই দুই বীরের যাত্রাকে কাল্পনিক বন্ধুত্বের সুতোয় গেঁথে রাজামৌলি তাঁর নিজস্ব বীরগাথা তৈরি করেছেন বক্স অফিসের জন্যে!
আরও পড়ুন: সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা, বন্ধ গণপরিবহণ
দুই ইন্ডাস্ট্রির মেলবন্ধন
খুব পরিকল্পিত ও সচেতন ভাবনায় রাজামৌলি বলিউডের দুই জনপ্রিয় অভিনেতাকে তাঁর এই অভিযানের অংশীদার করেছেন। অজয় দেবগণ ও আলিয়া ভাট। এমন নয় যে ওই দুই চরিত্রের অভিনেতার অভাব দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে, এমনও নয়, দুই অভিনেতার স্ক্রিন টাইম মারাত্মক। তিন ঘণ্টার ছবিতে আলিয়া আছেন মেরেকেটে কুড়ি মিনিট আর অজয় দেবগণ সামান্য বেশি। কিন্তু যেভাবে দক্ষিণের প্রথম সারির অভিনেতারা বলিউডে এতকাল অভিনয় করে গেছেন কেরিয়ারের মধ্য গগনে থাকাকালীন তেমনই বলিউডের টপ অ্যাক্টরদের নিজের ছবিতে ডেকে নেওয়ার কারণ দুই ইন্ডাস্ট্রির একত্রে সিনেমা ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। করণ জোহর অবধি তাঁর ট্যুইটে রাজামৌলির বিশালত্বের কথা নির্দ্বিধায় মেনে লিখেছেন, ‘দেয়ার আর ফিল্মমেকারস অ্যান্ড দেয়ার ইজ রাজামৌলি স্যর!’
বক্স অফিসের রাজা
বাহুবলী টু-এর রেকর্ড ভেঙে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ‘আর আর আর’ প্রথম দিন ব্যবসা করেছে ২২৩ কোটি। ট্রেড অ্যানালিস্ট তরণ আদর্শ জানিয়েছেন, ‘আর আর আর’ আগামী দিনে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেবে নিশ্চিত। পশ্চিমবাংলায় মোট ১৯০টি হলে মুক্তি পেয়েছে ‘আর আর আর’ এবং ডিস্ট্রিবিউটর, হল মালিক প্রত্যেকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দেশ জুড়ে অতিমারিধস্ত বক্স অফিসকে চাঙ্গা করে শুধু রাজা নয়, নিজেকে প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন এস এস রাজামৌলি!