গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটাই বদলে দিল ওরা

নোয়াম চমস্কি থেকে অমর্ত্য সেন, সবাই ক্ষুব্ধ বর্তমান ভারতের গণতন্ত্রের হাল-হকিকত নিয়ে। কেন এই মন্তব্য? গণতন্ত্রের অর্থ আসলে কী? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ভাস্কর ভট্টাচার্য

Must read

১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আব্রাহাম লিঙ্কন পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেওয়া একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণের সময় ছিল মাত্র ২ মিনিট। সেই দু’মিনিটের ২৭২ শব্দের ভাষণে তিনি ইতিহাসের স্মরণীয় সেই বক্তব্যটি পেশ করেছিলেন, যা হল ‘ডেমোক্রেসি ইজ অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল’। অর্থাৎ জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য এবং জনগণের হয়ে। এই বাক্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর একটা দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় জনগণের দ্বারাই। জনগণের দেওয়া ভোট থেকেই নির্বাচিত যে সরকার গঠিত হয় সেই পদ্ধতিকেই বলে গণতন্ত্র (Democracy)। গণতন্ত্রে কোনও সাদা-কালো নেই। গণতন্ত্র কোনও উচ্চনীচ ভেদ করে না। আর তারই ভিত্তিতে মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট সেদিন দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁরই পথানুসারী অনুরক্ত কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ডেমোক্রেসির (Democracy) বার্তা দিতে লিখেছিলেন— ‘ও ক্যাপটেন, মাই ক্যাপটেন’-এর মতো কবিতা। হুইটম্যানকে বলা হয় ‘পোয়েটস অব ডেমোক্রেসি’, ‘মিস্টিক পোয়েট, মডার্ন পোয়েট’ নামেও তিনি পরিচিত। কবি বলেছিলেন, ডেমোক্রেসির জয় একদিন হবেই। ডেমোক্রেসিই একমাত্র জনগণের জয়বার্তা বহন করে আনে। যেখানে আদর্শ, গণতন্ত্র নিয়ে আসে সর্বজনীন স্বাধীনতা, বৈষম্যহীন এক সমাজ। মূল কথা, যেখানে কোনও উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ নেই। সবার অধিকার সমান। সবার কণ্ঠস্বর সমান। সমাজে সকলকে সমান মর্যাদা দেবার কথাই বলেছে গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই ইতিহাসে বারবার স্মরণীয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ঘটনার নিরিখে। আজও যার থামা নেই।

আর এই গণতন্ত্রকেই (Democracy) সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা ও সর্বজনীন করে তুলতেই তৈরি হয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি ডে’ বা ‘বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস’। যার প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। নানা পথ পেরিয়ে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ ১৫ সেপ্টেম্বর দিনটিকে গণতন্ত্র দিবস রূপে মর্যাদা দিয়েছে। যেখানে বিশ্বের ১৬২টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে এই দিনটিকে সর্বসম্মত ভাবে ‍‘গণতন্ত্র দিবস’ পালনের সম্মতি দিয়েছিল।

গণতন্ত্রের (Democracy) কোনও একটি নির্দিষ্ট মডেল নেই। এবং গণতন্ত্র কোনও দেশকাল গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। গণতন্ত্র হল জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইচ্ছা বা মত প্রকাশের অধিকার। ১৯৯৭ সালে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন বা আইপিইউ ঘোষণা করে এবং গণতন্ত্রে একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো তৈরি করে। আইপিইউএর মত ও পরামর্শ অনুযায়ী ১৫ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যেখানে জনগণকে মূলত সরকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে। এবং সেই থেকে প্রতি বছর এই দিনটি নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণকে সজাগ ও সচেতন করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ১৯৯৮ সালে দীর্ঘ ২০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন সি অ্যাকিনোর উদ্যোগে ফার্দিনান্দ মার্কোসকে পরাজিত করে। ‍‘পিপল পাওয়ার রেভোলিউশন’ সরকার সাংসদ ও নাগরিক সমাজের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছিল।

আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আজ শপথ

২০০৮ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর আইপিইউ জেনেভার হাউস অফ পার্লামেন্টস বিশেষ অনুষ্ঠান করে। ২০১৩ সালে আইপিইউ বিশ্বের ১৬২টি দেশের সদস্যদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের প্রচার করে। যেখানে স্লোগান ছিল‍‘স্ট্রেনথিং ভয়েজেস ফর ডেমোক্রেসি’। ২০১৪ সালে ‘গণতন্ত্র যুবকদের সংযুক্ত করে’।

বছর বছর নানান সচেতনার বার্তা দিলেও বর্তমান বিশ্বে নানা ঘটনায় গণতন্ত্রের ধ্বস্ত চেহারা আমাদের চোখের সামনে উঠে আসছে। যা গণতন্ত্রেরই লজ্জা। এই তো সেদিন ইউ এস ওপেনে মেয়েদের সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নাওমি ওসামা। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী ২২ বছরের ওসাকার মা জাপানের, বাবা হাইতি-র। তিন বছর থেকে মার্কিন প্রবাসী এই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী সামনে দেখেছেন বর্ণবিদ্বেষের মতো অগণতান্ত্রিক অমানবিকতা। যার ফলে প্রতি ম্যাচে প্রতিবাদী হিসেবে তিনি মুখে মাস্ক পরে বর্ণবিদ্বেষের শিকার কোনও–না-কোনও ব্যক্তির নাম লিখে মাঠে নেমেছেন। একটু খুঁজলেই আমরা গোটা বিশ্বেই গণতন্ত্রের ভয়ঙ্করতম কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাব। সাহিত্য অকাদেমি-প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী কন্নড় লেখক কালবুর্গি, কিংবা লঙ্কেশ পত্রিকার সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকরের মতো মানুষ গণতান্ত্রিকভাবে নিজস্ব মত প্রকাশ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী একদল মানুষের হাতেই। শুধু এই দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই একদিকে ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে সোচ্চার সজাগ বার্তা দেওয়া হলেও প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও গণতন্ত্রের ধ্বস্ত ভয়ঙ্কর রূপ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে আধুনিক প্রযুক্তির সংবাদের মাধ্যমে। তা সে ডাইনি অপবাদে হত্যাই হোক, বর্ণবিদ্বেষের কারণেই হোক বা দেশের গণতন্ত্র রক্ষার কারণেই হোক।
এই সোস্যাল মিডিয়ার যুগে গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যে ভয়ঙ্করতর রূপটি আমাদের সামনে উঠে এসেছে তা যে কত ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুরতার বার্তাবহ সম্প্রতি নূপুর শর্মা ও তার পরবর্তী ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শুধু কয়েকটা মৃত্যু নয়, গোটা বিশ্বের একটা বড় অংশ ভারতের সাম্প্রতিক এই ঘটনাটির নিন্দায় সরব হয়েছে। আরব দুনিয়ার দেশগুলি ভারতবর্ষের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করতে চেয়ে বার্তা দিয়েছে। এ-দেশেও সরব কংগ্রেস, বামপন্থী দলগুলি-সহ সমস্ত বিরোধীই। সরব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন-সহ, বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি-র ‘অগণতান্ত্রিকতায়’ মুখর হয়ে দলবব্ধ হতে চাইছেন।

গণতন্ত্র রক্ষার চিৎকার বিশ্বজুড়েই। বর্তমান ভারত যে সেই গণতান্ত্রিক ভারত নেই এই আক্ষেপ জানিয়ে সরব হয়েছেন আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতনামা দার্শনিক নোয়াম চমস্কি। তিনি সোচ্চার হয়েছেন ভারতের জেলে অন্যায়ভাবে বন্দি করে রাখা মেধাবী গবেষক উমর খালিদের অবিলম্বে মুক্তি চেয়ে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র উমরের মুক্তির দাবিতে তিনি সরব হয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের শেষে এবং ২০২০ সালের গোড়ায় মোদি সরকারের বৈষম্যমূলক ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে’র বিরোধিতায় জোরালো নেতৃত্ব দানকারীদের অন্যতম একজন উমর খালিদ। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি। দিন দিন হিন্দুত্ববাদী ধর্মের আগ্রাসী চেহারা ফুটে উঠছে গোটা ভারতময়। বর্তমান ভারতের নানা অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন থেকে অনেক বুদ্ধিজীবীও। কলকাতায় এসে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের একটি বক্তৃতায় তো অমর্ত্য সেন ঘোষণাই করেছেন‍‘‘বর্তমান ভারতে গণতন্ত্রের বদলে চলছে‍‘ভাঙনতন্ত্র’’। প্রশ্ন ওঠে আজকের ভারত কি সত্যিই গণতান্ত্রিক ভারতে ফিরতে পারবে? নাকি গণতন্ত্র ‘ভাঙনতন্ত্র’র রূপেই বিরাজ করবে?

Latest article