দোম্মারাজু গুকেশের জয় কোনও ‘ফ্লুক’ নয়

‘টরেন্টোতে ভারতীয় ভূমিকম্প’। ক্যান্ডিডেটস দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন দোম্মারাজু গুকেশ। এই ভারতীয় কিশোরের বয়স মোটে ১৭ বছর। তাঁকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে ‘ভূমিকম্প’র প্রসঙ্গ টেনেছেন গ্যারি কাসপারভ। যিনি নিজে প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও দাবার দুনিয়ায় কিংবদন্তি। এই কাসপারভের ৪ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন গুকেশ। বর্তমানে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ক্যান্ডিডেটস। ১৮৯৪-তে যখন কাসপারভ ক্যান্ডিডেস চ্যাম্পিয়ন হন তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর, গুকেশের থেকে পাঁচ বছর বেশি। এই ঐতিহাসিক সাফল্যের ছবিটা কোনও আচমকা লব্ধ জয়গৌরব যে নয়, সেটা বোঝাচ্ছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

গ্যারি কাসপারভ (garry kasparov) উচ্ছ্বসিত। লিখেছেন, ‘অভিনন্দন! টরেন্টোয় ভারতীয় ভূকম্পজনিত টেকটোনিক প্লেটের পরিবর্তন ১৭ বছরের গুকেশের সৌজন্যে। সে-ই এখন সর্বোচ্চ খেতাবের জন্য চিনের ডিং লিরেনের মুখোমুখি হবে।’

প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের এই উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। ১৪টি খেলায় ৯ পয়েন্ট পেয়ে গ্র্যান্ড মাস্টার ডি গুকেশের এই সাফল্য প্রবাদপ্রতিমই বটে। ১৭ বছর বয়সেই এই কিশোর বেশ কয়েকজন বিশ্বের প্রথম সারির দাবাড়ুকে পর্যুদস্ত করেছেন। তিনিই এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ক্যান্ডিডেটস। এই ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট চালু হয়েছিল ১৯৫০-এ। এখনও অবধি ২৫ জন ক্যান্ডিডেটস হয়েছেন বা এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর শিরোপা অর্জন করেছেন। গুকেশ ছাড়া আরও দু’জন ভারতীয় এই টুর্নামেন্টে এবার উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছেন। একজন হলেন চেন্নাইয়ের আর এক কিশোর (উল্লেখ্য, গুকেশও চেন্নাইয়ের ছেলে) আর প্রজ্ঞানন্দ এবং বিদিত গুজরাটি। প্রজ্ঞানন্দ এবং গুজরাটি যথাক্রমে ৭ ও ৬ পয়েন্ট পেয়েছেন। দুজনই ভারতীয় মেয়েদের বিভাগে এবার দাপট দেখিয়েছেন। তাঁরা হলেন কোনেরু হাম্পি ও আর বৈশালী। মেয়েদের বিভাগে তাঁরা তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিশ্বনাথ আনন্দের পর গুকেশই প্রথম ভারতীয় যিনি ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টে জিতলেন। ২০১৪-তে বিশ্বনাথন আনন্দ এই টুর্নামেন্টে জেতার সুবাদে ম্যাগনাস কার্লসেনের বিরুদ্ধে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে লড়াই করার যোগ্যতা অর্জন করেন। সেই শেষবার, তারপর এবার, এই ২০২৪-এ গুকেশের সুবাদে।

মূলত যে-কথা বলার জন্য এই নিবন্ধের অবতারণা সেটা হল, টুর্নামেন্টে গুকেশ সব ক’টি পর্যায়ে জয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। কোনও হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়, ধারাবাহিকতা সাফল্যের সূত্রে তিনি শীর্ষস্থান দখল করেছেন, ১৪টি রাউন্ডে তাঁর নিখুঁত চালের গড় ৯৩.৬ শতাংশ, এই তথ্য চেস.কম সূত্রে প্রাপ্ত। এই টুর্নামেন্টে পাঁচবার সরাসরি জিতেছেন গুকেশ। হেরেছেন মোটে একবার, সেটাও শেষ পাঁচ মিনিটের ভুলে, আলিরেজা ফুরৌজার বিরুদ্ধে। গুকেশ এই টুর্নামেন্টে দু-দুবার হারিয়েছেন নিজত আবাসোভকে। নিজত এই প্রতিযোগিতায় সর্বনিম্ন রেটিংয়ের দাবাড়ু ছিলেন। প্রজ্ঞানন্দ ও গুজরাটিকেও একবার করে হারান গুকেশ আর ফিরৌজার কাছে হারের মধুর প্রতিশোধ নেন শেষ রাউন্ডের আগের রাউন্ডে। ফ্যাবিয়ানো কাবুয়ানা, ইয়ান নেপোমনিয়াচচি আর হিকারু নাকামুরার মতো উচ্চ রোটিং সম্পন্ন দাবাড়ুদেরও হারান গুকেশ। এই তিনজনই গুকেশের চেয়ে আধ পয়েন্ট পিছনে থেকে টুর্নামেন্টে শেষ করেন।

গুকেশ এখন ভারতের সর্বোচ্চ রেটিং সম্পন্ন দাবাড়ু। তাঁর পয়েন্ট ২৭৬৩.৬। বিশ্বের প্রথম পাঁচ দাবাড়ুর মধ্যে গুকেশ ছাড়া রয়েছেন আরও তিনজন— অর্জুন এরিগাইসি, বিশ্বনাথন আনন্দ, প্রজ্ঞানন্দ এবং গুজরাটি। বর্তমানে বিশ্বে দাবাড়ুদের রেটিংয়ের নিরিখে গুকেশের স্থান ৬ নম্বরে। তাঁর আগে রয়েছেন যে পাঁচজন তাঁরা হলেন কার্লসেন, কারুয়ানা, নাকামুরা এবং নডিরবেক আবদুসাত্তারোঙ। এই শেষোক্ত নডিরবেকের পয়েন্ট ২৭৬৫ এবং তিনিও বয়সে কিশোর। এ বছর নভেম্বর মাসে চিনের ডিং লিরেনের বিপক্ষে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য লড়তে নামবেন গুকেশ। ডিং কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব তালিকায় গুকেশের নিচে। তাঁর স্থান সপ্তম। পয়েন্টও গুকেশের থেকে ২ কম, ২৭৬২।

উল্টোদিকে, মহিলাদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পুরোদস্তুর চিনা খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। তান ঝোংগি এবং জু ওয়েনজুন সেখানে দুজন বিশ্বজয়ী মহিলা দাবাড়ু হওয়ার দাবিদার। ২০২৩-এ পুরুষ ও নারী উভয় বিভাগেই সেরা দাবাড়ু হয়েছিলেন চিনা দাবাড়ুরা। এবার সেই ছবিটা বদলাতে পারে গুকেশের সৌজন্যেই।
পরিশেষে একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার। গুকেশ যে এই শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন, তা কোনও আকস্মিক সাফল্য নয়। দীর্ঘ সময় ব্যাপী তাঁর রেটিং পয়েন্টের দিকে চোখ রাখলেই সেটা বোঝা যাবে। তাঁর অগ্রগমন আরও তিনজন কিশোর প্রতিভা— কার্লসেন, আনীশ গিরি এবং ফিরৌরজার সঙ্গে সমান তালে সংঘটিত হয়েছে।
২০২৩-এর অক্টোবর-ডিসেম্বরে গুকেশের ইএলও রেটিং ৪০ পয়েন্ট নেমে গিয়েছিল। ২৭৫৮ থেকে ২৭২০-তে পৌঁছেছিল। কিন্তু ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের শেষে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি অনেকটা শুধরে নিয়েছেন গুকেশ। ফের পৌঁছে গিয়েছেন ২৭৬৩-তে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শেষে রেকর্ডবুকটা নতুনভাবে লিখতেই হবে।

Latest article