রাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রের সংযোগ এক বহু চর্চিত বিষয়। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসনের কথা বলেছিলেন। কারণ, এমন সমস্ত আবেগ ও অনুভূতিকে শিল্প-সাহিত্যে উজ্জ্বল করে দেখানো হয়, যার ফলে রাষ্ট্রবিধানের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে মানুষের মন। অবশ্য প্লেটোর এই কথা আদতে শিল্পের প্রভাববিস্তারী ক্ষমতা ও শক্তিকে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি ও সম্মানই প্রদান করে। যে কারণে ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৬-এ বলবৎ হয় ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’। আবার সময়ের অগ্রগতি ও মূল্যবোধের পরিবর্তনে শিল্প, সাহিত্য, নাটক বা চলচ্চিত্রের এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী স্বরূপেরও পরিবর্তন হয় ক্রমশ। পরিবর্তে দেখা যায়, এই মাধ্যমগুলিই কখনও-বা রাষ্ট্রের প্রচারে, তাদের মতের সম্প্রসারণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কখনও-বা জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে মানুষকে আবেগে বুঁদ করে রাখতে, কখনও-বা মানুষের চেতনাকে বিবশ করে রাখবার মাধ্যম হয়েছে মোহমুগ্ধকারী নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
১৯৩৫ সালে একটি ছবি বার্লিনের চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহগুলিতে মুক্তি পেল। যে ছবি আজও সভ্য সমাজে নিন্দিত ও ধিক্কৃত! সিনেমাটির নাম ছিল, ‘ট্রাম্ফ ওফ দ্য উইল’। যে সিনেমা জুড়ে ছিল কেবলই জার্মান নাৎসি পার্টি তথা অ্যাডলফ হিটলারের গুণকীর্তন। পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে সম্ভবত এটিই প্রথম ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ ছবি। হিটলারের মতো একনায়ক বুঝতে পেরে ছিলেন, যে সিনেমা এমন একটি মাধ্যম, যে মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে একসাথে অনেক মানুষের কাছে নিজেদের ভাবনাটাকে পৌঁছে দেওয়া যায়। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে হলিউডের সুপারহিট ‘র্যাম্বো’ সিরিজ। সিলভারস্টার স্ট্যালোন অভিনীত এই সিরিজের প্রথম সিনেমা রিলিজ করে ১৯৮২ সালে। যার কয়েক বছর আগেই, ভিয়েতনাম যুদ্ধ দেখেছে গোটা বিশ্ব। সারা পৃথিবী জুড়ে ভিয়েতনামে মার্কিন সেনার অমানবিক আচরণ নিয়ে নিন্দার ঝড় চলছে সর্বত্র। ঠিক তখনই হলিউড নিয়ে এল র্যাম্বোকে। র্যাম্বো, যিনি একজন মার্কিন সেনাবাহিনীর কর্মী। সারা বিশ্ব কেঁপে গেল ‘র্যাম্বো’-ঝড়ে। এও এক ধরনের ‘প্রোপাগান্ডা’। একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই নিদর্শনগুলির মতো একই উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের দেশেও নানা সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে এবং তা বর্তমানে এক নৈমিত্তিক রূপধারণ করেছে। ২০১৪ ইস্তক এই ধরনের বহু চলচ্চিত্রই আমরা দেখেছি। কোনও কোনও ছবি বেজায় হিট হয়েছে, আবার প্রধানমন্ত্রীর বায়োপিক বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু, এক শ্রেণির পেটোয়া চলচ্চিত্র নির্মাণকারীর প্রত্যক্ষ মদতে প্রোপাগান্ডিস্ট ছবি বানানো বন্ধ হয়নি। বরং এই ধরনের ছবিগুলিকে বিনোদন কর মুক্ত করে দিয়ে নির্মাণকারীদের দ্বিগুণ উৎসাহীই করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP)। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ একটি ছবি ‘সাভারকার’।
আদতে, বর্তমান ভারত, তার শাসক সর্বাত্মকভাবে প্রতিটি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে চলেছে স্বীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ তথা ধর্মীয় বিদ্বেষ বিষকে অতি দ্রুততার সঙ্গে সঞ্চারণের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রও তার থেকে বিরত থাকেনি। তাই ‘কাশ্মীর ফাইলস’, ‘দ্যা কেরালা স্টোরি’, ‘বেঙ্গল ফাইলস’-এর মতো ছবিতে কখনও সীমাহীন মিথ্যাচার, কখনও অর্ধসত্য অথবা সত্যের বিকৃতিকে প্রদর্শিত করা হয়েছে ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষকে ব্যবহার করে দেশের বহুত্ববাদকে ধ্বংস করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। অধুনা তার নবতর সংযোজন এই ‘স্বাধীনতা বীর সাভারকর’ ছবি। ভারতবর্ষের বহুযুগ-লালিত বহুত্ববাদী আদর্শকে বিনষ্ট করে সংকীর্ণতাবাদী হিন্দু রাষ্ট্রভাবনার তত্ত্বগত ভিত্তির প্রধান কারিগর এই সাভারকরকে নিয়ে বিজেপি-আরএসএসের (BJP- RSS) মধ্যবর্তিতায় যে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সিনেমার ট্রেলারের এক মিনিটের অংশেই স্পষ্ট যে, সেই মতাদর্শকে গ্রহণযোগ্য রূপ প্রদানের জন্যে বিশুদ্ধ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতারা। যেখানে বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে দেখানো হয়েছে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহৎপ্রাণ, দেশের জন্যে উৎসর্গীকৃত মহাত্মার ‘অনুপ্রেরণা’ হিসাবে! হ্যাঁ, সেই সাভারকার যে কিনা ‘ব্রিটিশের আজ্ঞাবহ দাস’ হওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বারংবার আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে গেছেন, যে কিনা আপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ২য় পর্যায় (১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে রত্নগিরি কারাগার থেকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তিপ্রাপ্তির পর) অতিবাহিত করেছেন দেশের স্বাধীনতায় নয়, ‘হিন্দুত্ব’র ব্যাখ্যা, প্রচারে এবং ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকার নাকি এই বীর সন্তানদের আদর্শ-স্থানীয়!
প্রসঙ্গত, এ-মিথ্যাচারের স্বরূপ সন্ধানে একবার ইতিহাসের জীর্ণপাতাকে একটু উল্টেপাল্টে দেখা যেতেই পারে। শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়েছিল ১৯০৮ সালে, মাত্র ১৮ বছর বয়সে। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ অবধি মূলত লন্ডন-নিবাসী এবং স্বদেশি প্রচারে ‘মিত্র মেলা’ বা ‘অভিনব ভারত’-এর মতো সীমিত ক্ষমতার সংগঠন গড়ে তোলা, প্রায় অপরিচিত মুখ সাভারকার কীভাবে হতে পারে শহিদ ক্ষুদিরামের ‘অনুপ্রেরণা’? ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে আছে এ-কথা? আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কি হিন্দুত্বের আদর্শের ‘অনুপ্রেরণা’তেই বলেছিলেন— ‘আমাদের আন্দোলনের ভিত্তি হল জাতীয়তাবাদ, এর চরিত্র রাজনৈতিক। এর সঙ্গে কখনও ধর্মকে মিশিয়ে ফেলবে না। ধর্মের নামে যদি একতার চেষ্টা করো, তবে ধর্মের নামে বিভেদ ডেকে আনাও হবে সহজ। আমরা সকলে ভারতীয়, সেটাই আমাদের পরিচয়।’ …আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলা ভ্রান্ত নীতি। ‘বর্তমান ভারতে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা এই কথাগুলি সাভারকার প্রবর্তিত বিতর্কিত চিন্তার ১০০% বিপরীতে অবস্থান করে। তাই প্রশ্ন ওঠে, এ কেমন ‘অনুপ্রেরণা’?
আরও পড়ুন-বৃষ্টি-বন্যা-ধসে হিমাচল ও উত্তরাখণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ৮১, চলছে উদ্ধারকাজ