১৬ জানুয়ারি, ২০১৩ সাল। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত “রাশিয়া-বাংলাদেশ সহযোগিতার সমকালীন প্রেক্ষাপট” শীর্ষক এক বক্তৃতায় তিনি বললেন— “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে একটা জাতি কখনওই সত্যিকার উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা দেশের সমস্ত জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীদেরকে, বৈষম্যহীন ভাবে পুরুষের সাথে এক কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারে।” বক্তা মুজিবকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)। তিন বছর পর আর-এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আমি মনে করি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের অধিক হারে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ জরুরি।” ৮ মার্চ, ২০১৩। এপার বাংলায় হাসিনার ভগিনীসমা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) সরকারিভাবে নারী ক্ষমতায়নের এক সার্বজনীন স্বীকৃতি দিলেন। স্কুল-ছুট বন্ধ করা ও কম বয়সে বিবাহ বন্ধ করার লক্ষ্যে চালু করলেন “কন্যাশ্রী” প্রকল্প। সারা বিশ্বের নজরকাড়া এই প্রকল্পকে কুর্নিশ জানিয়েছে ইউনিসেফ ও ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল। অর্থের অভাবে যাতে মেয়েদের স্কুলের পডাশোনা বন্ধ না হয় আর ১৮ বছরের আগে যাতে বিয়ে না হয় তা সুনিশ্চিত করতেই এই প্রকল্প। ইতিমধ্যেই ৬৮ লক্ষেরও বেশি মেয়েকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। আগামীদিনে নারীদের অধিকার, ক্ষমতা ও যথোচিত সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করার প্রথম পদক্ষেপ কন্যাশ্রী প্রকল্প।
৯ জুন বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় বাজেট পেশের প্রাক্কালে ‘বাংলাদেশ ইকনমিক অ্যাসোসিয়েশন’ দেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে যে ‘‘বিকল্প বাজেট ২০২২-’২৩’’ পেশ করেছে তাতে নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় ও দেশের দরিদ্রতম নারীও যাতে সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত না হন তা সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে নারীদের সামাজিক ক্ষমতা বিস্তারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Sheikh Hasina- Mamata Banerjee) প্রায় একদশক ধরে চলা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের যেন একটা প্রতিভাস ফুটে উঠেছে ওপার বাংলার অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিকল্প বাজেট-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার মধ্যে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশুর বিকাশের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ওই বাজেট রিপোর্টে বলা হয়েছে— শিশুর বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভে, শিশুর বিকাশ নির্ভর করে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর। এ-লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের ওপর অর্থনীতিবিদরা গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এলাকায় বিধায়ক, প্রতি শনিবার বৈঠক
দেশজ উৎপাদনে নারীর অবদান কমপক্ষে ৪৮-৫০ শতাংশ, ২০-২৫ শতাংশ নয়— এ-কথার উল্লেখ করে প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেট ২০২২-’২৩–এ নারীর বহুমুখী ক্ষমতায়নের সর্বজনীনতাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে, দরিদ্র-বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত নারী যেহেতু সবচেয়ে ভঙ্গুর ও অরক্ষিত, সেহেতু এই গ্রুপে নারীর ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারযোগ্য ক্ষেত্র। এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং কিশোরী গর্ভধারণের হার কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। অর্থনীতিবিদদের সংগঠন এই দুটি খাতেই পৃথক বাজেট বরাদ্দের কথা বলেছেন। এই প্রস্তাব এপার বাংলার ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পেরই অনুসরণ। বাংলাদেশ অর্থনীতিবিদদের বিকল্প বাজেটে উল্লেখিত এইসব প্রস্তাবিত কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুরই বাস্তবায়ন দেখতে পাই এপার বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Sheikh Hasina- Mamata Banerjee) নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গে। কন্যাশ্রী প্রকল্পে যেখানে সরকার থেকে ২৫,০০০ টাকা চলে যায় স্বীকৃত স্কুলছাত্রীর পড়াশোনার জন্য সরাসরি তার নামে খোলা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। চালু হয়েছে ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প। আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল পরিবারের মেয়েদের বিয়ের জন্য এককালীন ২৫,০০০ টাকা পাবার সুযোগ রয়েছে এই প্রকল্পে। বিবাহে পণ নেবার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদের এই হোক এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে নারীরা যাতে খাদ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলিত না হন তার জন্য রেশন কার্ড ও স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পরিবারের সবচেয়ে বয়স্কা মহিলার নামে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ রাজ্য সরকার বহন করবে। এ-ছাড়াও আছে বিধবা ভাতা ও প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বার্ধক্য ভাতা। নারীর ক্ষমতায়ন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এ এক নিঃশব্দ বিপ্লব ।
একই লক্ষ্যে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা সরকারকে যেসব বাস্তব ও জরুরি পদক্ষেপ নেবার কথা বলেছেন তার মধ্যে আছে নারীদের শোভন কর্মসংস্থান, বৈষম্য দূর করে সমান কাজের জন্য সমান মজুরি নিশ্চিত করা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা, ন্যূনতম মজুরি আইন বাস্তবায়ন কৃষিকাজে নিযুক্ত নারীদের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘কৃষক কার্ড’ ইত্যদি। জোর দেওয়া হয়েছে চা-বাগানে নিযুক্ত নারী শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের। সরকারের কাছে পেশ করা বিকল্প বাজেটের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চা-বাগানের শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ এবং চায়ের পাতা সংগ্রহকারীদের ১০০ শতাংশই নারী। অর্থনীতিবিদদের মতে গ্রামের নারীদের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। চলতি আর্থিক বছরে এই খাতে আনুমানিক বরাদ্দ ৩৭ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যে পরিকল্পনার কথা ‘বিকল্প বাজেট’–এ তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যা়য়ের নেতৃত্বে কী ধরনের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে তার একটা ক্ষেত্র খুঁজে বের করার মধ্য দিয়েই সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব এবং সেটাই মূল লক্ষ্য হওয়া আজ সবচেয়ে জরুরি।
আজ থেকে চার বছর আগে ২০১৮ সালে দাভোস শীর্ষ সম্মেলন থেকে নারীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে ও নারীর ক্ষমতায়নকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এক বিশ্বমঞ্চ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পশ্চিমবঙ্গেও নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যের পাহাড় টপকে নারীদের এগিয়ে নিয়ে আসার কথা বারবার বলেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসিনা বলেন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬৬-’৬৯ সালের স্বায়ত্ত শাসনের দাবিতে এবং ১৯৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশের নারীদের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় আন্দোলনে— সিঙ্গুরে নন্দীগ্রামে তো বটেই, এমনকী ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রেও মমতার পাশে ছিলেন বাংলার মা-বোনেরা।
এ-ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা আসলে সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পৌঁছবার প্রথম ধাপ। ভুললে চলবে না, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-উন্নয়নে বিনিয়োগ একটি ভাল উদ্যোগ এবং তা শুধুমাত্র লৈঙ্গিক সমতার খাতিরেই নয় বরং মানব-উন্নয়ন আর টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্যও আবশ্যক।