মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান

যাঁদের নিয়ে দর্শকদের কৌতূহল, আনন্দ-আহ্লাদ সীমাহীন। নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তিময় জীবন যাঁদের, সেই চিত্রতারকারা দিনের শেষে আম-আদমিই। তাই মানসিক অবসাদ আসা তাঁদের জীবনে অমূলক নয়। টলিউডের এমন বেশ কিছু চিত্রতারকা আছেন যাঁদের জীবন কোনও এক অজানা কারণে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল, আবার কেউ মৃত্যুকে জয় করে ফিরে এসেছিলেন নতুন জীবনের টানে। কেন এমনটা হয়েছিল? উত্তর খুঁজলেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

টিভির অভিনেত্রীদের আত্মহত্যার ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রায় নিয়মিত। একটু পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাব এমন বহু ঘটনা ঘটেছে সিনেমার জগতেও। যে দুঃখজনক ঘটনায় কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউবা ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। সব আত্মহত্যার ঘটনাই যে আচমকা ঘটেছে এমনটা নয়। কেউ তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছেন নিজেকে। কেউ আগের মুহূর্তেও জানতেন না যে কী করতে চলেছেন।

আরও পড়ুন-ফের বিরোধী দলনেতাকে গো ব্যাক

কেয়া চক্রবর্তীর কথা
দিনটা ছিল ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চ। শনিবারের বারবেলায় বিকেল সওয়া তিনটে হবে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘জীবন যেরকম’ ছবির শুটিং হচ্ছিল গঙ্গাবক্ষে সাঁকরাইলের কাছে জলদূত নামের একটি লঞ্চে। পরিচালক ছিলেন স্বদেশ সরকার। প্রায় ৮০-৯০ জন লোক ছিলেন শুটিংয়ের স্পটে। ছবির অন্যতম নায়িকা জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়বেন, এমন কোনও দৃশ্য ছিল না। দূর থেকে  ডুবে যাওয়া নায়িকার শাড়ির কিছু অংশ জলের উপর দেখা যাবে, এইটুকু দেখানোর জন্য একজন নির্বাচিত ডামি প্রস্তুত ছিল। এই শটটা নেবার কথা একেবারে শেষের দিকে। এমন সময় ক্যামেরায় একটা যান্ত্রিক গোলোযোগ দেখা দেওয়ায় সেটা ঠিক করা হচ্ছিল। ওই সময় পরিচালক লাঞ্চ ব্রেক ঘোষণা করেন। সকলেই খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত। এমন সময় একটা চিৎকার শোনা গেল ‘পড়ে গেল পড়ে গেল’। সবাই তাকিয়ে দেখেন অন্যতম নায়িকা জলে পড়ে গেলেন। ছবির প্রযোজকের ছোট ভাই অশোক নন্দী জলে ঝাঁপ দিলেন। সহ-নায়িকাকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দিলেন নির্বাচিত ডামি এবং আরও কয়েকজন। কয়েকটি লাইফ বেল্ট ফেলে দেওয়া হয়। তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না।  প্রায় দেড় ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরেও যখন তাঁকে পাওয়া গেল না, তখন পরিচালক-প্রযোজক স্টিমারের সারেং ও  মাস্টারকে নিয়ে একটি জিয়ার ডাবলু লঞ্চ ডেকে নিয়ে সাঁকরাইল থানায় গিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা রিপোর্ট করেন। যে সহ-নায়িকার এমন ঘটনাটি ঘটেছিল তিনি হলেন বিখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী এবং সিনেমার অভিনেত্রীও বটে— কেয়া চক্রবর্তী।


পরের দিন রবিবার দুপুরে  হিরাপুরের কাছে জলপুলিশের অন্বেষণকারী লঞ্চের নজরে পড়ে কেয়া চক্রবর্তীর মৃতদেহটি। কেয়ার মৃতদেহের ময়নাতদন্তের যে রিপোর্ট পুলিশের হাতে এসেছিল তাতে বলা হয়েছে, কেয়া জলে ডুবে মারা গেছেন। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে কেয়া নিজেই জলে ঝাঁপ দিয়েছেন কিনা— তা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই আত্মহত্যার কারণটাই বা কী? কিংবা কেউ কেয়াকে জলে ফেলে দিয়েছিলেন কিনা অর্থাৎ এটি পৈশাচিক হত্যার ঘটনা কিনা, সত্যি হলে এর পেছনে আছেন কারা, উদ্দেশ্যটাই বা কী? অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে যা হয়, এখানে তেমনটি হয়েছে। ১৯৭৭ সালে ঘটে-যাওয়া ঘটনার কোনও কারণ বা সমাধান জানা যায়নি। মৃত্যুর পূর্বে কেয়া বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করছিলেন। জীবন যে রকমের পাশাপাশি ‘প্রণয় পাশা’, ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ ইত্যাদি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন।

আরও পড়ুন-আজ চা-বলয়ে মহাসম্মেলন

মহুয়া রায়চৌধুরির কথা
কেয়া চক্রবর্তীর মতোই ভয়াবহ মৃত্যু প্রখ্যাত নায়িকা মহুয়া রায়চৌধুরির।
গায়ে আগুন লেগেছিল মহুয়ার। মহুয়ার ফ্ল্যাট ছিল অজন্তা সিনেমার বিপরীত দিকের রাস্তায়। নিজেদের বাড়ি তৈরি হচ্ছিল টালিগঞ্জের করুণাময়ীতে। আগুন লেগেছিল মহুয়ার শাড়িতে। দেহের ৭০ শতাংশ পুড়ে যায়। বেশ কয়েকদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর মৃত্যু ঘটে মহুয়ার। এখন প্রশ্ন উঠেছে এতটাই কি অসতর্ক ছিলেন মহুয়া যে স্টোভটা বাস্ট করল? নাকি তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল? আসলে অল্পবয়সে প্রচুর টাকার মুখ দেখেছিলেন মহুয়া। অসংযমী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সন্ধ্যার পর মহুয়ার অন্যরূপ। আকণ্ঠ মদের নেশায় ডুবে থাকতেন। পুরুষের সঙ্গ অনিবার্য। পারিবারিক বিরোধ তখন নিত্যকার ঘটনা। এসবের থেকে তিনি কি নিজেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন নাকি তাঁর এই আচরণের জন্য কেউ তাঁকে পৃথিবী থেকে সরানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন? দুর্ঘটনাজনিত এই মৃত্যুর জন্য অনেকেই মহুয়ার স্বামী তিলক চক্রবর্তীকে চিহ্নিত করেছিলেন। পরে অবশ্য সব ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই সময় মহুয়ার হাতে একরাশ ছবির কন্ট্রাক্ট ছিল। মহুয়ার মৃত্যুদিনটি হল ১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই। তখন মিডিয়ার কোনও দাপাদাপি ছিল না। নতুবা ব্রেকিং নিউজের ঠেলায় টিভি সরগরম থাকত।

আরও পড়ুন-সুইসাইড পয়েন্ট

কাজরি গুহের কথা
দীপ জ্বেলে যাই, হারানো সুর, সাথীহারা-সহ বেশ কিছু ছবিতে সহ-নায়িকা হিসেবে দর্শকদের চোখে পড়েছিলেন কাজরি গুহ। দীপ জ্বেলে যাই ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আর যেন নেই কোনো ভাবনা’ গানটিতে দারুণ লিপ দিয়েছিলেন তিনি। যখন তাঁর উপরে ওঠার সময়, তখন আত্মহননের মধ্য দিয়ে কাজরি চলে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। একরাশ ঘুমের ওষুধের মধ্যে দিয়ে জীবনের সমাপ্তি টেনেছিলেন কাজরি গুহ।


সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের কথা
ড্রাগে আসক্ত হয়ে ছিলেন বিখ্যাত নায়িকা সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ইত্যাদি ছবির সফল নায়িকা সুমিত্রা। সাংসারিক জীবনে অশান্তির কারণেই মাদকাসক্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। এই আসক্ত হওয়ার ফলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই সময় তিনি ড্রাগ ছাড়া কাটাতেই পারতেন না। এ তো আত্মহত্যার শামিল। সুমিত্রার দ্বিতীয় স্বামী আর এন মালহোত্রা এবং চিকিৎসকের টানা প্রচেষ্টায় আস্তে আস্তে সুস্থ জীবনে ফিরে আসেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। আবার ছবিতে অভিনয় করতে যান। তখন কয়েকদিনের শুটিংয়ে দেখা গেছে  ডায়লগ পর্যন্ত ভুলে গেছেন। শিল্পীদের সহযোগিতায় তিনি ভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠেন। পরে অবশ্য তিনি দীর্ঘদিন আর বাঁচেননি।

আরও পড়ুন-বাগুইআটি জোড়া খুন কাণ্ড: মাস্টার-মাইন্ডের ফাঁসি চাইল অতনুর মা

সাধনা বসুর কথা
মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন স্বর্ণযুগের স্মরণীয় নায়িকা সাধনা বসু। ‘আলিবাবা’ ছবির মর্জিনা তিনি। স্বামী বিখ্যাত পরিচালক মধু বসু। বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। নিঃসন্তান ছিলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তাঁর নিঃসঙ্গ  জীবনের একাকীত্ব ঘোচাতে মদের আশ্রয় নিয়েছিলেন। যখন মদ কেনার পয়সা  নেই তখন এমন জনশ্রুতি আছে যে,

মল্লিক বাজার থেকে বেকবাগান পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করেছেন। ভিক্ষার পয়সায় মদ কিনেছেন। এভাবেই জীবনের ইতি টেনে ছিলেন রবীন্দ্র-স্নেহধন্যা সাধনা ১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর।

আরও পড়ুন-জুয়ানের সঙ্গে কথা বলবেন কর্তারা

মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কথা
মাধবী মুখোপাধ্যায়ও মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছিলেন। তখন মাধবী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মহানগর, চারুলতা, জোড়াদিঘির চৌধুরী পরিবার, সুবর্ণরেখা-সহ বহু ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে তিনি জনমানসে দাগ কেটেছিলেন। সেই মাধবী কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যা-ই হোক সে-যাত্রায় তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন চিকিৎসকদের প্রাণপণ চেষ্টায়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে তিনি আবার ছবির জগতের সঙ্গে যুক্ত হলেন। অসংখ্য ছবিতে কাজ করেছেন।  পেশাদারি মঞ্চে, টিভি সিরিয়ালে কাজ করেছেন। মাধবী দেখিয়েছেন জীবনকে কীভাবে এই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে হয়।
তখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’

আরও পড়ুন-পুজোয় হাজির বৌদি canteen

রাজেশ্বরী রায়চৌধুরির কথা
মানুষ মদ খায়, কখনও কখনও দেখা গেছে মদই মানুষকে খেয়েছে। এমন অবস্থা বাংলা ছবির আরেক বিখ্যাত নায়িকা রাজেশ্বরী রায়চৌধুরির। স্ত্রীর পত্র, জব চার্নকের বিবি ইত্যাদি ছবির মধ্য দিয়ে যাঁর আত্মপ্রকাশ, যিনি পরে অজস্র ছবিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কবিতা সিংহের মেয়ে রাজেশ্বরী মৃত্যুর আগের দুটি বছরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন মদে। অভিষেক চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে যখন তাঁর সম্পর্ক চুকে যায় তখন থেকেই শুরু হয় রাজেশ্বরীর মদ্যপান। মদ খেয়ে খেয়ে জীবনের ইতি টানলেন রাজেশ্বরী।

আরও পড়ুন-বিজেপির প্ররোচনায় মিলছে না বকেয়া টাকা

অপর্ণা দেবীর কথা
চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন অপর্ণা দেবী। ছবির ঝুলিতে রয়েছে পথের পাঁচালী, শ্যামলী, এখানে পিঞ্জর, জীবন-মৃত্যু, অগ্নিপরীক্ষা, স্মৃতিটুকু থাক, বাঘিনী-সহ অসংখ্য ছবি। তিনি তাঁর অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন ছবিগুলিতে। ১৯৬৩ সালে অপর্ণা দেবীর কন্যার স্টোভ ফেটে মৃত্যু হয়। সে-বেদনা তাঁকে সারাজীবন বইতে হয়েছিল। ১৯৫০ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত স্টার থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৭ সালেই আর্থ্রারাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে অভিনয় জীবন থেকে অবসর নেন। টাকা ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে চলছিল। পরে অর্ধাহার অনাহার নিত্যসঙ্গী ছিল। অভাব-অনটনের জ্বালা সইতে না পেরে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন অপর্ণা দেবী। দিনটি ছিল ১৯৮২ সালের ১১ জানুয়ারি।

Latest article