অথ রাজ্যপাল কথা

Must read

এ রাজ্যের সাংবিধানিক পদে আসীন এমন এক জন যিনি নিজের এক্তিয়ার না বুঝে নির্বাচিত সরকারের অহেতুক সমালোচনায় মুখর। এতে যেমন নিজের পদমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে তেমনই রাজ্য প্রশাসনে অহেতুক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। লিখছেন
মইনুল হাসান

 

রাজভবন। সাদা বড় বাড়িটির সামনে দিয়ে বহুবার যাতায়াত করেছি। শীর্ষে শোভা পাচ্ছে দেশের আত্মসম্মানের প্রতীক ত্রি বর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা। স্বাধীনতার পর একের পর এক স্বনামধন্য ব্যক্তিরা এই বাড়ির বাসিন্দা হয়েছেন। হরেন মুখোপাধ্যায়, পদ্মজা নাইডু, নূরুল হাসান, গোপালকৃষ্ণ গান্ধি – যাঁদের নাম শুনলে মাথা নত হয়। যাঁদের প্রজ্ঞা ও সাংবিধানিক চৈতন্যবোধ শিক্ষনীয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা, সর্বোপরি জনগণ সম্পর্কে তাঁদের অপরিশীম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্পর্ক প্রবাদপ্রতিম।

আরও পড়ুন-অভিষেকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিল: “কিসের এত ভয়?” বিপ্লবকে তোপ তৃণমূলের

হঠাৎ করে ছন্দপতন হয়েছে। হঠাৎই বা বলবো কেন? বিজেপি’র যে সমস্ত উচ্চাভিলাষী নেতাদের সাংসদ বা মন্ত্রী করতে পারেনি তাঁদের বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যপাল করে পাঠিয়েছে। আর কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তার সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হবে এই ফন্দি এঁটে কাউকে কাউকে কোনও কোনও রাজ্যে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়েছে। এইগুলির মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ।

রাজ্যপালের পদ সম্পর্কে অনেক বিতর্ক আছে। সারকারিয়া কমিশনের কাছে অনেকেই দাবি তুলেছিলেন এমন “ সাদা হাতি ” রাখার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে। সংবিধানে বলা আছে রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শে চলবেন রাজ্যপাল। দু’টি স্বাধীন কাজ তিনি করতে পারেন। প্রথমতঃ নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরে রিপোর্ট পাঠাতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ রাজ্যে সরকার গঠনের সময় যাদের বেশি বিধায়ক তাদের সরকার গড়তে সুযোগ দেবেন। আর একটি বিষয় পরিষ্কার যে, রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। ফলে সবসময়ই “ মাই গভর্নমেন্ট ” বলে রাজ্য সরকারকে সম্বোধন করবেন।

আরও পড়ুন-যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ব না: চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে পুজো দিয়ে বললেন অভিষেক

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এমনই কপাল যে এই রাজ্যে এমন এক রাজ্যপাল জুটেছেন যিনি সাংবিধানিক নিয়মকানুনের কোনও তোয়াক্কা করছেন না। প্রতিনিয়ত রাজ্য সরকারের সঙ্গে প্রায় পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাচ্ছেন। সাংবিধানিক ধারা উপধারার যা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তাতে দীর্ঘদিনের সুব্যাখ্যাগুলি যেন গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুভাষ কাশ্যপ প্রমুখেরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন-এই মুহূর্তে ভারতই টেস্টের এক নম্বর দল, বললেন মর্কেল

আজ পর্যন্ত এমন কোনও রাজ্যপালকে দেখা যায়নি যিনি নিজের সরকারের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন রাজভবনে। ইনি সেটাই একাধিকবার করে রেকর্ড গড়েছেন। তাঁকে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়মিত জানাবেন মুখ্যমন্ত্রী। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তাছাড়া রাজ্যপাল রাজ্যের শীর্ষ আমলাদের ডেকে যে কোনও বিষয়ে জানতে পারেন। কিন্তু তিনি লম্বা লম্বা চিঠি দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রীকে। সে চিঠি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছাবার আগেই সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এমন জঘন্য মনোভাব সাংবিধানিক পদে আসীন কোনও ব্যক্তি যে দেখাতে পারেন তা আমজনতা বিশ্বাস করত না। এখন বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে করছে ।

আরও পড়ুন-ব্রাত্য গেইল

কয়েকটি বিষয় খুবই হাস্যকর মনে হয়। ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায় তখন শিক্ষা মন্ত্রী। কোনও কারনে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করলেন। মিটিং শেষ হল। রাজ্যপাল শিক্ষামন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তখন সকাল বেলা। বেলা গড়াতে না গড়াতে শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে ট্যুইট করলেন। ভাষা অতি জঘন্য। শুধু শিক্ষামন্ত্রী নয় অনেক মন্ত্রীর সঙ্গেই এমন ব্যবহার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বাড়িতে ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান হয়। তিনি সকলের দিদি। বাড়িতে অনেককেই আসতে বলেন ফোঁটা নেওয়ার জন্য। তাঁরা কেউ দলীয় কর্মী, মন্ত্রী বা স্বজন হারানো মানুষ। হঠাৎ রাজ্যপাল বললেন, তিনি ফোঁটা নিবেন। এভাবে যে এটা হয় না সেটা কে বোঝাবে? মুখ্যমন্ত্রী অগত্যা তাঁকে কালীপুজোর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছেন। এমন ভারসাম্যহীন মানুষ এরকম উচ্চপদে থাকাটা কিন্তু বিপদজনক ব্যাপার। কিন্তু বিজেপি’র জমানায় চারদিকে ভারসাম্যহীনদেরই রমরমা। সবই হতে পারে – তাই হচ্ছে।

আরও পড়ুন-স্কুলেই টিকা সোমবার থেকে

তিনি বড় আশাতে ছিলেন বি জে পি পশ্চিমবাংলায় সরকার গড়বে। উৎফুল্ল হয়ে বিজেপির মুরলীধর লেনের অফিস বা হেস্টিংসের অফিস তুলে দিয়ে রাজভবনে নতুন বসতি দিলেন। বিজেপি নেতারা সেখানেই ক্যাম্প খাটিয়ে ফেললেন। রাজভবনের বাইরে সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্বাচন পরিচালনা করতে লাগলেন। কিন্তু এই রাজ্যের মানুষ তা মানবে কেন? সব আশার অবসান হল। তাঁর এত মন খারাপ যে কয়েকদিন মুখ দিয়ে বাক্য সরলো না। কিন্তু চুপ করে থাকার পাত্র তিনি নন। দেখলেন, বিরোধী দলনেতা কোনও কাজের লোক নন। স্ব ইচ্ছায় বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। তাঁর এখন অনেক দায়িত্ব। বি জে পি’র মুখপাত্র, বিরোধী দলনেতা, সর্বোপরি অফিস সম্পাদক। এমন দুর্ভোগ পশ্চিমবাংলায় আর কোনো রাজ্যপালের কোনওদিন হয়নি।

আরও পড়ুন-বজবজের বাজিমাত, আগুন ঝরল এমপি কাপের গ্র্যান্ড ফিনালেতে

সরকারি কাজে নাক ও হাত দুই-ই গলাচ্ছেন। সম্প্রতি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাই দেখা গেল। হাওড়া কর্পোরেশনের নির্বাচন করা যাচ্ছে না তাঁর জন্য। পাস হওয়া বিলে সই করছেন না। কূটকাচালি করছেন। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলছেন। তিনি ভুলে গেছেন বিল আটকাবার অধিকার তাঁর নেই। সরকার দ্বিতীয়বার বিল যে অবস্থাতেই পাঠাক তাঁকে সই করতে হবে। শিক্ষা দপ্তরের বহু ফাইল তাঁর কাছে আটকে আছে। সরকার জবাবদিহি করতে রাজ্যপালের কাছে বাধ্য নয়। জবাবদিহি করবে মানুষের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী জননেত্রী। মানুষের পালস বোঝেন। মানুষ তাঁকে চায়। আর ইনি ক্রমাগত সেই মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করে যাচ্ছেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর গোয়া সফরকে নিয়ে কটাক্ষ করে বলেছেন, “এসব না করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করুন।” কবে থেকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি ঠিক করা দায়িত্ব নিয়েছেন আমরা জানিনা। তবে তিনি যে সব সীমা অতিক্রম করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক বর্ষীয়ান নেতাকে মেসেজ পাঠিয়ে বলছেন – মুখ্যমন্ত্রীর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছেন না। ইংরেজিতে “ মেগালো মানিয়াক” বলে একটা কথা আছে। বাংলার মানুষ এটার বাংলা অর্থ জানেন। তাই বাংলা অর্থটি আর দিলাম না। শুধু বলছি, এই ব্যাক্তিটি তাই।

আরও পড়ুন-টি-২০ বিশ্বকাপে ব্যর্থতা নিয়ে শাস্ত্রীর বোমা

যে ব্যক্তি সামান্য হেলিকপ্টার না পাওয়া নিয়ে ঝগড়া করতে পারে; যে ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে গদগদ আচরণ করে পরক্ষনেই কুৎসিত ভাষায় ট্যুইট করতে পারে, তাঁর মানসিক স্থিরতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ঐতিহ্যবাহী রাজভবনের সম্মানকে তিনি ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ঝগড়ায় নেমে পড়েছেন।
এরকম ব্যক্তি সাংবিধানিক পদে থাকার যোগ্য কি না তা অবিলম্বে ভেবে দেখা আবশ্যক।

 

Latest article