আশ্চর্য এক উলটপুরাণ যেন লেগে আছে তাঁর চরিত্রে! মিষ্টি, নরম কৈশোর যাঁর লেখায় ‘হলদে পাখির পালক’ হয়ে খুশির উড়াল দিয়ে যায়, সেই তিনিই যে আবার কী করে ‘আমিও তাই’-এর মতো অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবির কথা লিখে যান— এমন অবলীলা লীলা মজুমদারের পক্ষেই সম্ভব! যে বাবার সঙ্গে নৈতিক সংঘাত ছিল আজীবন, সেই বাবাকে ঘিরেই তাঁর শৈশবের রোমন্থন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বনজঙ্গলের গল্পে। কিশোর বয়সকে তাঁর মতো করে কে কবে পড়তে পেরেছে! শিশুসাহিত্যিক বলতে তো আমরা চিরকাল বুঝে এলাম হয় ভূত-প্রেত রাক্ষস-খোক্কস, কিংবা যুদ্ধ-ডাকাত-লড়াই, অথবা কিম্ভূতকিমাকার অবিশ্বাস্য কিছু একটা। কিন্তু এই যে বাইরে থেকে গড়ে দেওয়া অসম্ভবের দুনিয়া, সে তো বড়দের। অথচ ছোটদের মনের একেবারে গহিন কন্দরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কম্পমান দুই প্রান্ত জুড়ে জেগে থাকা যে নিজস্ব কল্পনার জগৎ, তার খোঁজ লীলা মজুমদার যেভাবে পেয়েছিলেন, সেই অনুভূতির অনন্যতাই ছিল তাঁর বিশিষ্টতা। তিনি লেখেন, “ছোটোদের বই বড়োদের বই বলে কোনো দুটি আলাদা বিভাগ হয় না; ছোটোরা যে বইয়ের রস ও অর্থ গ্রহণ করতে পারে সে সব বইই ছোটোদের বই আর বই মাত্রই বড়োদের বই।” সেজন্যই তাঁর গল্পে যারা কাকের মতো, কিন্তু যেন কাক নয়, সেইসব ‘কাগ নয়’ পাখিদের ডিম লুকিয়ে চুরি করে আনলে তার গায়ে ভুল বানানে, অ্যাঁকাবাঁকা অক্ষরে সরু ফাট ধরার মতো ফুটে ওঠে— ডিমের ঠেলা ঠেলবি যখন বুঝবি তখন বুঝবি!
আরও পড়ুন-লস্ট, থ্রিলারের মোড়কে প্রেম প্যাশন আর অন্বেষণ
চোখে দেখা চারপাশের বাইরেও নতুন কিছু বারবার খুঁজে পেতে চাওয়ার, নতুন কিছু দেখে ফেলতে চাওয়ার আর নতুন কথা শুনে ফেলতে চাওয়ার যে বাড়বাড়ন্ত কৌতূহল পোষা থাকে পৃথিবীর সব ছোটদের বুকের ভেতর, তার খোঁজ ঠিক পৌঁছে যেত তাঁর কাছে ‘বাতাস বাড়ি’র পথ বেয়ে। তাই তাঁর গল্পে হারানো পায়রা মুনি ঠিক ফিরে আসে, শুধু নিজের কল্পনা দিয়ে বন্ধু বিশে আর নদীর ধারে আস্ত একটা গুপ্ত জায়গা পেরিস্তানকে বানিয়ে ফেলে ছোট্ট ছেলে চাঁদ, তাড়া খেয়ে লুকোতে গিয়ে আবিষ্কার হয়ে পড়ে কবেকার হাপিশ হয়ে যাওয়া পদিপিসির বর্মিবাক্স, সন্ধেবেলা একলা ছাদ থেকে কারা যেন নেমে এসে ফেরত দিয়ে যায় না-চাইতেও হারিয়ে ফেলা পেনসিল ল্যাবেঞ্চুশ খেলনা। তাঁর লেখার অদ্ভুত গুণ এই যে ‘বাল্যদৃষ্টি’, তার স্বীকৃতি মিলেছিল স্বয়ং রাজশেখর বসুর কাছেও। তবে, চিরকালীন ধারা যা, তাতে সাহিত্যের পাতায় শিশুসাহিত্যিকের স্থান একটু যেন খাটো, তাই সমালোচনাও তাঁকে কম শুনতে হয়নি। তাঁরই কথায়—“একদিন সুশোভন এসে বলেছেন, ‘তোমার বোধহয় ছোটোদের জন্য আজগুবি লেখা বন্ধ করতে হবে।’… গিরিজাবাবু বলেছিলেন ‘ভদ্রমহিলাকে কাগজ নষ্ট করতে বারণ করো।’”
আরও পড়ুন-মাধ্যমিক আজন্ম প্রতিবন্ধী সায়নদীপের
যদিও লীলা মজুমদার শুধু ছোটদের জন্য নিজে লিখেই থেমে থাকেননি, প্রচুর বিদেশি সাহিত্যও অনুবাদ করেছেন একাধারে। হ্যানস অ্যান্ডারসন এবং গ্রিম ভাইদের রূপকথার অনুবাদ, রেভারেন্ড লালবিহারী দে-এর ‘Folk Tales of Bengal’-এর অনুবাদ তাঁরই করা। এ-ছাড়াও ‘গ্রাম বাংলার উপকথা’ নামে তিনি অনুবাদ করেন ‘Bengal Peasants Life’। সাহিত্য আকাদেমি থেকে তাঁরই অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছিল জোনাথন সুইফট-এর ‘গালিভারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত’। পৃথিবীর সেরা বিদেশি শিকারিদের শিকারকাহিনি তাঁর অনুবাদে ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শ্রেষ্ঠ শিকার কাহিনি’ নামে। উপরন্তু, বিশ শতকের ছয়ের দশক থেকে ‘চিলড্রেন্স বুক ট্রাস্ট’-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায়, ছোটদের জন্য ইংরেজি ভাষাতেও কলম ধরেন লীলা মজুমদার। চিলড্রেন্স বুক ট্রাস্ট-এর প্রাণপুরুষ শংকর পিল্লাইয়ের অনুরোধে পরপর তিনটি বই লেখেন তিনি— ‘টাইগার টেলস’, ‘রিপ দ্য লেপার্ড’ আর ‘দি হাউস বাই দি ইড’। এর মধ্যে ‘টাইগার টেলস’ বইটিকে বাংলাতেও আর-একবার লিখে ফেলেন, যেটি তাঁর অতি বিখ্যাত ‘বাঘের বই’। জওহরলাল নেহরুর স্মৃতিতে ‘নেহরু বাল পুস্তকালয়’ কর্তৃক প্রকাশিত ১০০টি ছোটদের বইয়ের সিরিজে ভারতের নদ-নদী নিয়ে লিখেছিলেন ‘নদী কথা’, যেটি চোদ্দটি ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়। রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর শৈশবজীবন নিয়ে লেখেন ‘Jorasanko House’, তাঁর মেয়ে কমলা চট্টোপাধ্যায় এই বইটি অনুবাদ করেছিলেন ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’ নামে। লেখেন ‘Homecoming’ নামে অন্য একটি গ্রন্থও। এ-ছাড়া ছোটদের উপযোগী এনিড ব্লাইটনের দশটি রহস্য গল্প, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-র ‘The Old Man and the Sea’ এবং অস্কার ওয়াইল্ড-এর ‘The Importance of Being Earnest’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এমনকী বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের নজিরও তিনি রেখে গেছেন মহাশ্বেতা দেবীর ‘একবাড়ি স্বপ্ন’ বইটি অনুবাদ করে।
আরও পড়ুন-সস্ত্রীক দেখা করলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে, বিশ্বকাপে সাকিবদের চারে দেখছেন সৌরভ
শুধু শিশুতোষ গল্প বা মনোরঞ্জক উপাদানে ঠাসা লেখাই নয়, লীলা মজুমদারের অন্যতম বিশেষ অবদান রয়ে গেছে জীবনীগ্রন্থ রচনায়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে তিনি লেখেন অসামান্য একটি বই— ‘এই যা দেখা’। বাংলায় এত অপূর্ব, প্রাঞ্জল জীবনীগ্রন্থ খুব কমই হয়। এই ধারাতেই ফেলা যেতে পারে তাঁর লেখা ‘রামমোহন’, ‘অবনীন্দ্রনাথ’, ‘উপেন্দ্রকিশোর’ এবং ‘সুকুমার’ বইগুলিকে। ‘অবনীন্দ্রনাথ’ এবং ‘সুকুমার’ বই দুটিই অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতা সংকলন।
লেখালিখির এই ধারা কিন্তু শুরু হয়েছিল তাঁর বড়দা সুকুমার রায়ের হাত ধরেই, ১৯২২ সালে সুকুমারের অনুরোধেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লিখে ফেলেছিলেন তাঁর প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মী ছেলে’, তাঁর বয়স তখন মাত্র চোদ্দো। বিখ্যাত বই ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে।
আরও পড়ুন-কৃষকদের প্রশংসায় রাজ্যপাল
ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের প্রকাশনায় বেরোনো এই বইটিই লীলা মজুমদারের লেখা প্রথম বাংলা বই। এই বইয়ের ভূমিকায় ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ নিজে লীলা মজুমদার সম্পর্কে লিখছেন, “বাংলা শিশুসাহিত্যে শ্রীযুক্ত লীলা মজুমদারের আবির্ভাব একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অধুনালুপ্ত সুপ্রসিদ্ধ এই প্রতিভাশালিনী লেখিকা সম্বন্ধে সমালোচক মহলে সপ্রশংস বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়— এবং বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর পরবর্তী প্রত্যেকটি লেখায় যে ভাব অব্যাহত থাকে। লেখিকার গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা, অদ্ভুত অদ্ভুত পরিস্থিতি, সৃষ্টির কৌশল, সম্পূর্ণ নিজস্ব অতি-সরস বর্ণনাভঙ্গি এবং সর্বোপরি অনাবিল হাস্যরস সৃষ্টির অদ্ভুত শক্তি শুধু ছোটোদের নয়, বড়োদেরও রীতির কৌতূহলী করে তোলে।” এর পর কামাক্ষীপ্রসাদের অনুরোধে তাঁর ‘রংমশাল’ পত্রিকার জন্যই লেখা হয় তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় ‘পদীপিসীর বর্মি বাক্স’। ‘গুপির গুপ্তখাতা’ও গ্রন্থ হয়ে প্রকাশের আগে ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘রংমশাল’ পত্রিকাতেই, তখন অবশ্য এর নাম ছিল ‘ভয় যাদের পিছু নিয়েছে’। তাঁর আর-একটি বিখ্যাত লেখা ‘নাকু গামা’র প্রকাশবৃত্তান্তও অবশ্যই বেশ মজার, এই লেখায় লীলা মজুমদারের সঙ্গে হাত লাগিয়েছিলেন স্বয়ং প্রেমেন্দ্র মিত্র!
আরও পড়ুন-সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের হামলায় জখম ১১ তৃণমূল নেতা-কর্মী
১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন কেটেছিল বেতারে। সরকারি চাকরির আইনি জটিলতা তাঁকে বিরক্ত ও বিমুখ করে তুললেও তাঁর সাহিত্যজীবনে এই বেতার-পর্বটির আলাদা গুরুত্ব রয়ে গেছে। তাঁর প্রচুর লেখা এই সময়ে পড়া হয়েছে ‘গল্প দাদুর আসর’-এ। এমনকী, রেডিয়োর মতো একটি পারফরম্যান্স ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে কাজের অভিজ্ঞতাই যে তাঁকে এই সময়ে নাটক লিখতে প্রণোদিত করেছিল, সেকথা বললেও ভুল হয় না। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমার বেতার জীবন আমি ভারী উপভোগ করেছিলাম। আমার মনের বিস্তারও অনেক বেড়ে গেছিল। অজস্র ছোটো গল্প, প্রবন্ধ উপন্যাস লিখেছিলাম। সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকতাম আর মনটা চরকির মতো ঘুরত। ক্রমে প্রকাশকদের সঙ্গেও আলাপ হল। অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির। আর বিশেষ করে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটের পাবলিশিং কোম্পানি।… ছোটোদের জন্য আমার অনেকগুলো বই প্রশান্ত রায়ের আঁকা ওয়াশ দেওয়া ছবি হাফটোন ব্লকে ছাপিয়ে অনবদ্য চেহারা দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। তার মধ্যে বক-ধার্মিক, গুপির গুপ্ত খাতা, জয়ন্ত চৌধুরীর সহযোগিতায় লেখা টাকা গাছ, টং লিং, হলদে পাখির পালক-এর নাম করতে হয়।… আমার ওইসব ছোটোদের উপন্যাস গল্প দাদুর আসরে ধারাবাহিকভাবে পড়া হত। টাকা গাছ-ও তাই। হলদে পাখির পালক কাজের তাড়ার মধ্যে আমার মনে জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। আমি ৬ দিনের ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বসে বইটি আগাগোড়া লিখেছিলাম। ওর মধ্যে এখানকার বাতাস বয়, রোদ ওঠে। ফিরে গেলে প্রেমেনবাবু এর নামকরণ করেন। তারপর জয়ন্ত গল্প দাদুর আসরে পড়ল। বইটি অনেকের ভালো লাগে। বহু পুরস্কারও পেয়েছে।… কয়েকটি ছোটোদের উপযুক্ত সরস নাটকও লিখেছিলাম এই সময়ে। তার মধ্যে ছিল বক-বধ পালা। জয়ন্ত সেটি একবার রেডিও সপ্তাহে মঞ্চস্থ করে বলাকা প্রকাশনী থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশও করিয়ে দিয়েছিল। লঙ্কা-দহন লিখেছিলাম, ক্ষণস্থায়ী কনটেম্পোরারি পাবলিশার্স বই করেছিলেন ১৯৬৪ সালে, আমি রেডিও ছাড়বার ঠিক পরের বছর।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর ‘বক-বধ পালা’ নাটকটি সংগীত নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-মাধ্যমিক : সাবোতাজের চেষ্টা করেও মুখ পুড়ল বিজেপির
তাঁর আশ্চর্য আর-একটি বই ‘রান্নার বই’। লিখেছিলেন মেয়ে কমলা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এমন আশ্চর্য আদর আর সম্বোধনের নৈকট্যে ভরা রন্ধনপ্রণালীর বই বাংলায় কমই আছে। যে গভীর সম্পর্কের টানে বইয়ের পাঠককে তিনি বারবার ডাক দেন ‘তুমি’ বলে, তাঁর বই ভরে থাকে অন্তরঙ্গ টুকরো কথায়— “আমোদিনী বলত, কাঁচকলাটিকে ঘেন্না করনি।… এই দিয়েই দুঃখী মানুষ এক থালা ভাত খেয়ে ফেলে। কখনো তেলটুকুও জোটে না, তখন শুধু তেঁতুল গোলায় কাঁচালঙ্কা ছেড়ে শাঁসটি নেড়ে নেয়।… আর খোসাটার বাইরের শক্ত অংশটি ছাড়িয়ে ফেলে, চটকে নিয়ে, নুন, কাঁচালঙ্কা, একটুখানি চাল-বাটা দিয়ে এক পলা তেলে বড়া ভেজে তুলত আমোদিনী। কোনো জিনিস ফেলতে চাইত না।”
তাঁর আলোমাখা হাসিভরা লেখায় আলাদিনের যে দিয়াবাতিটুকু রেখে গেছেন লীলা মজুমদার, সে আগুন পোড়ায় না, নরম ওমে ভরে রাখে জ্বেলে দেওয়া আলোর উদ্ভাসে।