আলতার মধ্যে একটা সেকেলে তকমা রয়েছে। সেই আলতার মর্ডানাইজেশনের ভাবনা এল কেন?
ছোট থেকেই দেখেছি ঘটিবাড়ির প্রথা অনুযায়ী প্রতি বৃহস্পতিবার নাপতিনি এসে সবাইকে আলতা পরাত। আমি নিজেও একটা সময় খুব আলতা পরতাম। এখন আর পরা হয় না। আলতার প্রতি ভাললাগা ছিল বরাবর। আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অঙ্গ আলতা। বাঙালি ছেলেরা শেরওয়ানি পরে বিয়ে করতে যায় দেখে খুব কষ্ট হয়, মনে হয় কেমন যেন একটু একটু করে আমাদের ঐতিহ্যগুলো সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি বিয়েতে মেহেন্দি নিয়েও মাতামাতি দেখছি বহুদিন ধরেই। কিন্তু মেহেন্দি পরলে প্রথম প্রথম যতটা সুন্দর লাগে উঠে যাওয়ার সময় ঠিক ততটাই খারাপ।
আরও পড়ুন-লোকাল ট্রেনে এক ভক্তের সঙ্গে আলাপ
কারণ মেহেন্দি তোলার পদ্ধতি সবাই জানে না। অবাঙালিরা মেহেন্দি তোলেন একটি বিশেষ পদ্ধতিতে। সেটা জানা না থাকলে মেহেন্দি যখন হালকা হতে শুরু করে দেখতে খারাপ লাগতে শুরু করে। এরপর ১৯৯৪ সালে আমি প্রথম আমার পার্লারে শুরু করি বডি পেন্টিং। প্যারিস থেকে শিখে এসে সেই আইডিয়াটাই কাজে লাগাই এখানে। প্রোডাক্টসও বাইরে থেকেই নিয়ে এসেছিলাম। সেই সব অরিজিনাল বডিপেন্টিং কালার ভীষণ দামি আর এখানকার বাজারে পাওয়াও বেশ মুশকিল। এটা করতে গিয়ে মনে হল মেহেন্দি কেন বডি পেন্টিংয়ের কাজটাই যদি হাতে করা শুরু করি মানে যদি হ্যান্ড পেন্টিং করি। কারণ বডি পেন্টিং কালার জল লাগলে নষ্ট হয় না কিন্তু জল দিয়ে একটু ভিজিয়ে রেখে স্ক্রাব করলেই সঙ্গে সঙ্গে উঠে যায়। ব্যস, শুরু করে দিলাম। খুব রেসপন্স পেলাম। এরপর একদিন হঠাৎ মনে হল আলতা নিয়েই বা কেন কিছু করব না। আলতা ছাড়া কোনওদিন বিয়ে হতে দেখিনি। তখন থেকেই হাত এবং বিশেষ করে পায়ে আলতার ডিজাইন করা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার শুরু। এর উদ্দেশ্য শুধুই হারিয়ে যেতে বসা এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনাই নয়, আজকের অনেক উঠতি তথাকথিত বিউটিশিয়ানরা পেডিকিওর করতে বা পায়ে হাত দিয়ে কাজ করতে সঙ্কোচ বোধ করেন এই ট্যাবুটাকে ভাঙতে চেয়েছিলাম। শরীরেরই অন্যতম একটা পার্ট পা তাই পায়ের সৌন্দর্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পায়ে হাত দিতে লজ্জার কিছু নেই।
আরও পড়ুন-সংবিধান বিরোধী বিলের প্রতিবাদে সরব তৃণমূল
আলতা তো ক্ষণস্থায়ী, জল পড়লেই উঠে যায়। আলতাকে স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসেবে হাজির করলেন কীভাবে?
প্রথমে আমার স্টুডেন্টদের, আমার পার্লারের মেয়েদের, বেশ কিছু মডেলদের নিয়ে ট্রায়াল দিলাম। দেখলাম বিষয়টা দারুণ হচ্ছে। ভাবলাম আলতার সঙ্গে বডি পেন্টিং-এর কালার যোগ করলে কেমন হয়। তখন আলতার সঙ্গে গোল্ড, সিলভার নানারকম বডি পেন্টিং-এর কালার কম্বিনেশন করতে শুরু করলাম। শুরুটা আলতা দিয়েই করেছিলাম তারপর কালার, স্টোন ইত্যাদি যোগ নানারকমভাবে পা-কে এবং পায়ের আঙুলগুলো সাজানো শুরু করলাম। প্রফেশনালি তখনও কাজটা শুরু করিনি। আরও খুঁটিনাটি রিসার্চ বাকি ছিল। কারণ এটা সত্যি আলতা জল লাগলে উঠে যাবেই।
আরও পড়ুন-জোড়া এলিয়েনের মৃতদেহ-বিতর্ক ভিনগ্রহী নিয়ে কী বলল নাসা?
শাড়িতেও রং লেগে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। তখন প্রথমদিকে যখন বিয়ের কনেকে ডিজাইনার আলতা পরাতাম, তাঁদের বলে দিতাম রাতে সাবান দিয়ে ধুয়ে পা-টা ফেলতে তাহলে প্রথম যে রংটা ওঠে সেটা শাড়িতে, বিছানার চাদরে বসার জায়গায় আর লাগবে না। শুধু জল দিয়ে ধুলেই কিন্তু মুশকিল আছে। আলতা কীভাবে অন্তত গোটা দিনটা স্থায়ী করবে সেটা বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁদের পাঠাতাম। কিন্তু নিজে হাল ছেড়ে দিইনি, খুঁজতে থাকলাম আলতাকে স্থায়ী করার উপায়। আমি এবং আমার বহু বছরের সহযোগী সজল গোস্বামী। শুরু থেকেই প্রতিটা কাজে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আমরা ভাবতে থাকলাম কী করা যায়, বিষয়টা সহজ ছিল না। অনেক রিসার্চের পর আমরা একটা স্কিন ফ্রেন্ডলি কোটিং তৈরি করলাম যেটা আলতার ডিজাইন করে নেওয়ার পর ওর ওপর লাগিয়ে দিলে পায়ে জল লাগলে কোনও সমস্যা হবে না। তবে সাবধানে করতে হবে সবটাই। এই কোটিংটা দেওয়ার পর থেকে আলতার লংজিবিটি বেড়ে গেল অনেকটা।
আরও পড়ুন-শিল্পপতিরা বললেন পাল্টে গিয়েছে বাংলা
ইনোভেশন আপনার কিন্তু সেটা ক্যারি করতে পারবে কতজন বলে মনে হয়? সফল না হওয়ার রিস্ক ছিল?
রিস্ক কিসে নেই! কিন্তু একটা কথা ভুললে চলবে না শাঁখার মতোই আলতাও এখন ট্রেন্ডি। সাধ আর ক্যারি করার সাধ্য একেবারেই মেলে না বেশির ভাগেরই। অবাঙালি মেয়েরা অনেকটাই ক্যারি করে ফেলে কারণ তারা বরাবর সব ধরনের পোশাক পরতে অভ্যস্ত। মাইক্রো মিনি না হলেও ট্রাউজার, জিনস সবই পরত। তবে বাঙালি মেয়ে বিশেষ করে মধ্যবয়সিরা কিন্তু সেটা পারে না।
আমি বহু বছর ধরে পার্সোনাল গ্রুমিং, পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট, সেল্ফ মেক আপ, টেবিল ম্যানার্স ইত্যাদির প্রশিক্ষণ দিই। বহু মেয়েকে তৈরি করছি। ফলে আলতা ক্যারি করার জন্য আমি নিজেই অনেক ক্লায়েন্টকে তৈরি করে নিতে পারি। এক্ষেত্রে প্রি-কনসাল্টেনসি মাস্ট। কী পোশাক পরবে, কেমন অকেশন, স্লিভ কেমন, সালোয়ার হলে তাঁর ঝুল কেমন, শাড়ি বা লেহেঙ্গা হলে কী পরছে জেনে নিই, পাশাপাশি আলতার সঙ্গে যে জুতোটা পরবে সেটার ডিজাইন কেমন হবে সবটাই বলে দিই। ডিজাইন করার সময় জুতোটা সবসময় আনতে বলি। কারণ জুতোর ওপরের অংশ উন্মুক্ত হলে ভাল হয়। অনেক সময় আমার ঠিক মনে না হলে পোশাক বা সাজ বদলেও দিই।
আরও পড়ুন-জোড়া এলিয়েনের মৃতদেহ-বিতর্ক ভিনগ্রহী নিয়ে কী বলল নাসা?
আলতা মানেই তো সেকেলে একটা ব্যাপার। ওয়েস্টার্ন আউটফিটের সঙ্গে আলতা! সম্ভব কি?
সবটাই ক্যারি করার ক্যারিশমা। আমি পাশ্চাত্য পোশাকের সঙ্গেও আলতা পরিয়েছি। এমন অনেকেই আসেন আমার কাছে যেমন এই তো কিছুদিন আগেই দু’জন অবাঙালি ক্লায়েন্ট এসেছিল একটা ককটেল পার্টিতে যাবে শর্টস আর স্নিকার্স পরে। ওরা বলেছিল, আলতা দিয়ে এমন একটা ডিজাইন করে দিন যাতে দেখলে মনে হয় আমরা একটা ডিজাইনার মোজা পরেছি। আমি পায়ের গোছ থেকে হাঁটু পর্যন্ত এমনভাবে ডিজাইন করেছিলাম আলতা দিয়ে যে মনে হচ্ছিল ফ্লোরাল মোজা। ওয়েস্টার্ন আউট ফিটের সঙ্গে আলতা পরার কথা সবাই ভাবতে পারেন না তবে সেটাও এখন পপুলার হচ্ছে দিনে দিনে। আসলে সবটাই একটার সঙ্গে আর একটা কানেক্টেড। আলতা পরার জন্য হঠাৎ কেউ এল, পরল, চলে গেল এমনটা কিন্তু হয় না।
আরও পড়ুন-বাংলায় ইস্পাত কারখানা করেছি আপনারাও লগ্নি করুন : সৌরভ
আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। কারণ পায়ের শেপ সবার আলাদা তাই আলতার ডিজাইন কেমন হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে পায়ের শেপের ওপর। কাজটা পার্সোনালাইজড এবং কাস্টমাইজড পুরোটা আমি নিজে করি।
আপনার এই প্রচেষ্টায় আলতা শিল্পটা কি আদৌ লাভবান হল? কতটা রেসপন্স এসেছে?
ডিজাইনার আলতা আসার পর নিশ্চয়ই আলতার ডিমান্ড বেড়েছে। একটা প্রচার তো পেয়েছেই। আশাতীত রেসপন্স পেয়েছি। খরচের কথা ভাবছেন না ক্লায়েন্টরা। বিয়েতে ডিজাইনার আলতার একটা চাহিদা তৈরি করতে পেরেছি আমি। ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে খরচ পড়ছে মোটামুটি তিন হাজারের ঊর্ধ্বে। এটা শুধু পায়ের উপর আর আঙুলের জন্য। পুরো পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত খরচ আরও বেশি। কিন্তু আলতা এতটাই ট্রেন্ডি যে আলাদা একটা বাজেট রাখছে এর জন্য সবাই।
আরও পড়ুন-দুই ভাষার ভিন্ন স্বাদের থ্রিলার
শাড়ি পরলে তো পা ঢাকা পড়ে যায়। তাহলে আলতা পরে কী লাভ ?
এখন বাঙালি বাড়িতে সব পুজো হয়। আমি নিজে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, বাড়িতে তিনবেলা নারায়ণের পুজো হয়। পুজো মানেই শাড়ির কুঁচি আর আঁচল কোমরে গুঁজে বাড়ির মেয়েরা কাজ করেন। সেখান থেকেই আমার মাথায় আইডিয়াটা আসে। বিয়ের কনের হোক বা পুজোয় উৎসবে আমি ঠিক ওইরকমভাবে শাড়ি ড্রেপিং করলাম। যাতে গোড়ালি পর্যন্ত পা-টা পুরো দেখা যায়। এই ধরনের ড্রেপিংয়ের সঙ্গে ট্র্যাডিশনের বাইরে নয় অথচ ভীষণই কন্টেম্পরারি একটা সফট লুক দিই। এর জন্য আগে একবার ট্রায়াল দিয়ে নিই। আগে দেখে দেখে নিই শাড়ি পরিয়ে পুরো বিষয়টা। এখন আলতা পরতে আসছেন বহু মেয়েই। যাঁরা নাচের পেশায় রয়েছেন যাঁরা, কেউ শুধু ফোটোশ্যুট করবে বলেও পরছেন। এইভাবে ডিজাইনার আলতার ট্রেন্ডি হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য ‘নির্দেশিকা’ জারি করল রাজ্য
আজকের মেয়েদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে এই নতুন আলতা শিল্প?
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সুচিত্রা-কন্যা মুনমুন বিকিনির সঙ্গে নাকছাবি পরেছিলেন। ভাইরাল হয়েছিল সেই ছবি। যেটা সে-সময় কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু আজকের যুগে শুধু শাড়ি নয়, যেকোনও পোশাকের সঙ্গে নোজ-পিন পরছে মেয়েরা। তাই কালের পরিবর্তনে অনেক কিছু বদল হয়েছে। আলতাও এখন আর ব্যাকডেটেড নয়। আলতা এখন একটা শিল্প— কাজেই এই নতুন নতুন ট্রেন্ডগুলো সবার কাছে দারুণভাবে গ্রহণযোগ্য।