নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন যশোরের নন্দী পরিবারের বিশেষ পরিবারিক বন্ধু। সেই পরিবারের কর্তা অক্ষয় নন্দী নামী স্বর্ণব্যবসায়ী। মেয়ে অমলা নন্দী। সালটা ১৯৩১। প্যারিসে আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে ভারতীয় কারুকর্মের প্রতিনিধিত্ব করতে আমন্ত্রণ পেলেন অক্ষয় নন্দী। সেই সফরে সঙ্গী হলেন তাঁর ১১ বছরের মেয়ে অমলা। অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে প্যারিসে রওনা দিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় উদয়শঙ্করের পরিবারের। তখন বছর তিরিশ বয়স উদয়শঙ্করের। অমলা তখন ফ্রক পরেন।
উদয়শঙ্করের ইতিমধ্যেই বেশ নামডাক হয়েছে নাচের জগতে। মুম্বইয়ের ‘জে জে স্কুল অব আর্টে’ পড়া শেষ করে তিনি ‘রয়্যাল কলেজ অব আর্টে’ চিত্রকলা নিয়ে পড়ার জন্য ততদিনে লন্ডনে। সেখানে ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং ‘একটি হিন্দু বিবাহ’ নামের দুটি ব্যালাডের নির্দেশনা দেন। এমনই এক অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনা পাভলভার নজরে পড়েন যান উদয়শঙ্কর। এরপর আনার সঙ্গে তাঁর নৃত্যাভিনয় শুরু। তাঁদের যুগলবন্দি মুগ্ধ করে গোটা পশ্চিমি দুনিয়াকে।
আরও পড়ুন-ভাল নেই বিশ্বের বিধবারা
নাচের হাতেখড়ি
১৯৩১ সালে মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়েই ফ্রান্সে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন উদয়শঙ্কর। সঙ্গে ছিলেন আরও দুই ভাই। সেখানেই অমলাকে নিয়ে উপস্থিত অক্ষয় নন্দী। অমলাকে দেখেই পছন্দ হয় হেমাঙ্গিনী দেবীর। তিনি ছোট্ট অমলাকে নিজের শাড়ি পরিয়ে দিতেন। ওই সময় অমলার খেলার সঙ্গী ছিলেন উদয়ের ভাই রবি। তখন রবিশঙ্কর দাদা উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে নাচতেন। একদিন উদয় অমলাকে নাচের কয়েকটি মুদ্রা চেষ্টা করে দেখতে বললেন। উদয় ঠিক যেমনটা বলেছিলেন, ছোট্ট অমলা হুবহু তা করে দেখান। অমলার সেই নাচ দেখে মুগ্ধ হন উদয়। মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে তিনি বলেন অমলার বাবাকে অনুরোধ করতে যাতে তিনি ২ মাসের জন্য ইউরোপে মেয়েকে নাচের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেন। ১৯৩১-এর ২৯ ডিসেম্বর— শুরু হল তাঁর ইউরোপ-যাত্রা, সেই সঙ্গে অমলার নৃত্যজীবনের যাত্রাও। অমলা প্রথমবার স্টেজে পারফর্ম করেন ওই বছরই বেলজিয়ামে৷ ‘কালীয় দমন’-এ ‘কালীয়’র চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে নৃত্য পরিবেশন করেন তিনি।
আরও পড়ুন-বাবাকে খুশি করতেই টাইটানে উঠেছিলেন সুলেমান
যশোরের মেয়ে অমলা
১৯১৯ সালের ২৭ জুন তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার বাটাজোড় গ্রামে অমলার জন্ম। তিনি খুলনা ও কলকাতায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৪১ সালে অমলা নন্দী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। অমলার প্রতিভার বিকাশ ঘটে গিয়েছিল তার আগেই প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল এগজিবিশনে।
নৃত্যের তালিম
ইউরোপ সফর শেষে অমলা কলকাতায় ফেরেন। রবীন্দ্রনাথ উদয়শঙ্করকে নৃত্যচর্চার একটি কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বললেন। ১৯৩৮ সালে উদয়ের হাতেই ‘উদয়শঙ্কর সেন্টার ফর ডান্স’-এর জন্ম হয়। পারিবারিক বন্ধু হবার সুবাদে নেতাজিই অমলার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন মেয়েকে যেন উদয়শঙ্করের নৃত্যচর্চা কেন্দ্রে পাঠান তিনি। নেতাজির কথা ফেলতে পারেননি অক্ষয় নন্দী! অমলা আসেন সেন্টারে। শেখা শুরু হয় তাঁর।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতের প্রচারে কাল কোচবিহারে মুখ্যমন্ত্রী
এই সময় তিনি উদয়শঙ্কর ও কথাকলির নৃত্যগুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রির কাছে নাচের তালিম নিতে থাকেন। আলমোড়ায় ইন্ডিয়ান কালচার সেন্টার তৈরি হলে অমলা সেখানে যোগদান করেন। এখানে তাঁর নৃত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি চিত্রকলার প্রশিক্ষণও নেন। শিক্ষা শেষ হবার পর অমলাশঙ্কর উদয়শঙ্করের ডান্স ট্রুপের সঙ্গে পাড়ি দেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়।
এর মাঝেই বিয়ে
বিদেশে থাকার সময়েই একদিন রাতে হঠাৎই তাঁর ঘরে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেন উদয়শঙ্কর এবং সেই কথার আকস্মিকতায় কেঁদে ফেলেছিলেন ১৯ বছরের তরুণী অমলা। উদয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ১৯৪২ সালে। দুজনে জুটি বেঁধে অজস্র শো করেন। পেলেন অগণিত মানুষের ভালবাসা। তাঁদের দুই সন্তান— পুত্র আনন্দশঙ্কর ও কন্যা মমতাশঙ্কর।
আরও পড়ুন-বাহিনী দিতে ব্যর্থ কেন্দ্র, বিজেপির নাটক, কোর্টে ধাক্কা
‘কল্পনা’র অমলা
১৯৪৩-এর শুরু। উদয়শঙ্কর এবং অমলাশঙ্কর আলমোড়ায় গেছেন শো করতে। তখন তাঁরা বিবাহিত। সেই ট্যুরে সঙ্গী ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা গুরু দত্তও! ওখানেই ‘কল্পনা’র পথ চলা শুরু। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। কিছু দিনের মধ্যেই নানা কারণে আলমোড়ার সেন্টারটা বন্ধ হয়ে গেল। উদয়শঙ্করের মনপ্রাণ জুড়ে তখন ‘কল্পনা’। একটি মাত্র চলচ্চিত্র যা তাঁদের সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিল।
১৯৪৮ সালে নির্মিত হল সেই হিন্দি ছবি ‘কল্পনা’। যা মূলত ডান্স-ড্রামা। একজন তরুণ নৃত্যশিল্পীর জার্নি দিয়ে সাজানো এই ছবির গল্প। ১৭ বছর বয়সে অমলা অভিনয় করেন এই ছবিতে। ছবিটি রচনা, সহ-প্রযোজনা, পরিচালনা করেছিলেন উদয়শঙ্কর, যিনি নিজেও ছিলেন ছবিটিতে। ‘কল্পনা’য় উমার চরিত্রে অমলার নৃত্যাভিনয় দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়। কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় সেটি। সেইসময় কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়া কনিষ্ঠতম তারকা ছিলেন অমলাশঙ্কর। তাঁর ৮১ বছর পর ২০১২ সালে ফের কান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেন তিনি।
আরও পড়ুন-কংগ্রেস ও আপের মাঝে হস্তক্ষেপ নেত্রীর
একক অমলাও অনন্য
বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছিলেন তিনি। তৈরি করেছিলেন নাচের সম্পূর্ণ অন্যরকম এক শৈল্পিক ভাষা। ভারতনাট্যম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হোক বা পার্বতীর কথাকলিভিত্তিক অনন্য ধারার ‘কার্তিকেয়’র শুরুর দৃশ্যে ধ্রুপদী ও লোকায়ত নৃত্যের অসামান্য সংমিশ্রণে অনবদ্য তিনি। স্বামী উদয়শঙ্করের সঙ্গে সেরা জুটি হিসেবেই নয়, একক শিল্পী হিসেবেও চিরকাল সমুজ্জ্বল থেকেছেন
নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর। শিল্পকর্মে খাঁটি ধ্রুপদী ঘরানার সঙ্গে আধুনিক ভাবধারার মিশেলে অমলাশঙ্করের নৃত্যকে কালজয়ী করেছে। সাতটি ধ্রুপদী নৃত্যধারার সঙ্গে ভারতের লোকনৃত্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নৃত্যশিল্পকে এক ভিন্নমাত্রায় উপস্থিত করেছেন।
আরও পড়ুন-রক্ত যাক, দেশের জন্যে লড়ব: বৈঠকের পর বার্তা তৃণমূল নেত্রীর
চিত্রশিল্পী অমলা
নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করের আর একটি বিশেষ শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর অঙ্কিত চিত্রকলার মাধ্যমে। বিশেষ করে কলকাতা ইডেন গার্ডেনের উন্মুক্ত মঞ্চে উদয়শঙ্করের ‘লর্ডবুদ্ধ’ রঙিন ছায়ানৃত্যে তাঁর অঙ্কিত স্লাইডগুলো দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিল এবং পরবর্তীতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ নৃত্যনাট্যেও তাঁর আঁকা স্লাইডগুলোও প্রশংসিত হয়। ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’-এ নৃত্য পরিচালনার মাধ্যমে নৃত্যকলার প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন স্ত্রী অমলা। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান প্রদান করে। সারাজীবনে পেয়েছেন বহু সম্মান ও স্বীকৃতি।