বদলেছে ছবি
থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়। বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। অভিনয় বিশেষ পছন্দ ছিল তাঁর। নিয়মিত দেখতে যেতেন। বিশেষত গিরিশচন্দ্র ঘোষের পালা। গত দেড়শো বছর ধরে বাংলা রঙ্গমঞ্চ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। পেশাদারি থিয়েটারের জায়গা নিয়েছে গ্রুপ থিয়েটার। একটা সময় থিয়েটার আবদ্ধ ছিল মূলত কলকাতার মধ্যে। আজ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এই রাজ্যে প্রায় প্রতিটি জেলায় গড়ে উঠেছে একাধিক নাট্যদল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষ করছেন থিয়েটার চর্চা। চোখে পড়ছে নিষ্ঠা। দলগুলো ঘটাচ্ছে বিচিত্র ভাবনার প্রকাশ। কোথাও কোথাও আয়োজিত হচ্ছে নাট্যমেলা, উৎসব। আগে ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ। বর্তমানে মিলছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ২৩ বছর ধরে আয়োজিত হচ্ছে নাট্যমেলা। একটা সময় পর্যন্ত এই আয়োজন ছিল মহানগর কেন্দ্রিক। নাটক মঞ্চস্থ হত রবীন্দ্রসদন-সহ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে। তবে ২০১১-র পর বদলেছে ছবি। এখন নাট্যমেলা কলকাতার পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন জেলায়।
আরও পড়ুন-ছাঁচের সরস্বতীর বাজার তুঙ্গে, ব্যস্ত পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা
দুটি পর্যায়ে ২৪২ নাটক
এই মুহূর্তে কলকাতায় চলছে ত্রয়োবিংশ নাট্যমেলা। আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি। ৩ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রসদনে উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু, মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সভাপতি দেবশংকর হালদার, সংস্কৃতি অধিকর্তা কৌশিক বসাক, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সচিব দেবকুমার হাজরা প্রমুখ। প্রথম নাটক ছিল অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘দায়বদ্ধ’। প্রযোজনায় নৈহাটি ব্রাত্যজন নাট্যদল। রবীন্দ্রসদন, গিরিশ মঞ্চ, মধুসূদন মঞ্চ, শিশির মঞ্চ, বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টার, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়াম, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে মঞ্চস্থ হচ্ছে বিভিন্ন দলের নাটক। আয়োজন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সচিব দেবকুমার হাজরা জানান, এবারের নাট্যমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি পর্যায়ে। জেলা পর্যায় এবং কলকাতা পর্যায়। জেলা পর্যায়ের নাট্যমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১০টি জায়গায়। ৯টি জায়গায় ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। সেগুলো হল মালদহ, শিলিগুড়ি, দিনহাটা, রঘুনাথগঞ্জ, সিউড়ি, বর্ধমান, পুরুলিয়া, ঘাটাল, কৃষ্ণনগর। বাকি আছে ডায়মন্ডহারবার। অনুষ্ঠিত হবে ১৬-২০ ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে চলছে কলকাতা পর্যায়ের নাট্যমেলা। সবমিলিয়ে দুটি পর্যায়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে ২৪২টি নাটক। দারুণ সাড়া পাওয়া গেছে জেলায়। প্রায় প্রতিটি শো হাউসফুল। কলকাতাতেও দর্শক সমাগম হচ্ছে ভালই।
আরও পড়ুন-রাজ্য বাজেটে ঘোষিত নয়া প্রকল্পে বাংলায় খুশির হাওয়া, ব্যান পিরিয়ডে ধীবরদের সহায় সমুদ্রসাথী
শতবর্ষে আলোর কবি
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকসম্পাত শিল্পী তাপস সেন। আমৃত্যু তিনি তাঁর আলোর ছটায় শুধু বাংলা থিয়েটার বা ভারতীয় রঙ্গমঞ্চ নয়, বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ আলোকিত করেছেন। আলোক বিজ্ঞানকে নিয়ে গেছেন শিল্পের স্তরে। তিনি আসলে আলোর কবি। তাঁর আলোক প্রয়োগকুশলতায় স্মরণীয় হয়ে গেছে ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’, ‘রাজা’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘পুতুলখেলা’, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘দশচক্র’, ‘সেতু’, ‘আরোগ্য নিকেতন’ প্রভৃতি মঞ্চসফল নাটক। চলছে তাঁর জন্মশতবর্ষ। কলকাতা পর্যায়ের নাট্যমেলার প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছে তাঁকে স্মরণ করেই। গবেষণা এবং ডিজাইন করেছেন শোভন তরফদার। গগনেন্দ্র প্রদর্শনশালায় প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখছেন বহু মানুষ। জানাচ্ছেন ভাললাগার কথা।
আরও পড়ুন-মহাসরস্বতী
ঘটছে ভাবের আদানপ্রদান
কলকাতার দলগুলো যাচ্ছে জেলায়। জেলার দলগুলো আসছে কলকাতায়। গত কয়েক বছরে এইভাবেই এগোচ্ছে নাট্যমেলা। সেইমতো এবারের কলকাতা পর্যায়ে দর্শকরা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন মূলত বিভিন্ন জেলার নাটক। কয়েকটি প্রযোজনা রীতিমতো চমকে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, মহানগরের থেকে জেলা কিন্তু পিছিয়ে নেই। নাগরিক দর্শকরা ভিড় জমাচ্ছেন। অভিনন্দিত করছেন জেলার দলগুলোকে। কথা হচ্ছে নাটক নিয়ে। ঘটছে ভাবের আদানপ্রদান। রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হচ্ছে ১৭টি নাটক। ১৩টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের, ৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের। শিশির মঞ্চে মঞ্চস্থ হচ্ছে ৩৬টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক। মধুসূদন মঞ্চে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক ১৩টি, স্বল্প দৈর্ঘ্যের ৪টি। গিরিশ মঞ্চে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক ৯টি, স্বল্প দৈর্ঘ্যের ১৫টি। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়মে মঞ্চস্থ হচ্ছে ৩৬টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক। বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টারে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক ৬টি, স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক ১৮টি। তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে মঞ্চস্থ হচ্ছে ৩টি পুতুল নাটক, ২টি পথনাটক, ৪টি মূকাভিনয়, ১টি অন্তরঙ্গ নাটক। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের মধ্যে রবীন্দ্রসদনে মঞ্চস্থ হয়েছে দক্ষিণ দমদম সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রের ‘বাদাবন’। নির্দেশনায় পৃথ্বীশ রানা। নাটকটি উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। গিরিশ মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে গোবরডাঙা রূপান্তরের ‘কণিষ্ক’। পরিচালনায় ছিলেন অতনু পাল। দর্শক সমাগম ছিল ভালই। কল্যাণী উদয়ন নাট্যগোষ্ঠী মধুসূদন মঞ্চে মঞ্চস্থ করেছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক ‘সাজাহান’। নির্দেশনায় তীর্থঙ্কর চন্দ। সাজাহান চরিত্রে অভিনয় করেন কল্যাণী পুরসভার পুরপ্রধান নীলিমেশ রায়চৌধুরী। দেখেছেন বহু মানুষ। বেশ কয়েকটি দল প্রথমবার অংশ হল এই আয়োজনের। পুরনো দলগুলোর পাশাপাশি নতুন দলগুলোও প্রশংসা পাচ্ছে। দারুণভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে মেলাপ্রাঙ্গণ। পাওয়া যাচ্ছে নাটকের বই। সবমিলিয়ে জমে উঠেছে কলকাতা পর্যায়ের নাট্যমেলা। চলবে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।