বাল্যবিবাহ, পাচার রুখতে সচেতনতা শিবির মগরাহাট ২ ব্লকে

ডায়মন্ড হারবারের মহকুমাশাসক হিসেবে সম্প্রতি যোগ দেওয়া অঞ্জন ঘোষ মগরাহাট ব্লক প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধাবাদ জানান।

Must read

নাজির হোসেন লস্কর, মগরাহাট: বাল্যবিবাহ, মানব পাচার ও নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এক সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করল দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাট-২ ব্লক প্রশাসন৷ এ ধরনের সামাজিক সমস্যা মুক্ত করতে যাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য তাঁদেরই একাংশকে শপথবাক্য পাঠ করালেন সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় জন প্রতিনিধি, পুলিশ-প্রশাসন, মাস্টারমশাই, পড়ুয়া, অভিভাবক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পুরোহিত, ইমাম-সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা।

আরও পড়ুন-গণহত্যা নিয়ে বিশ্ববাসীর নিন্দার তোয়াক্কা না করেই হুমকি পুতিনের

মঙ্গলবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত এক নাটক পরিবেশন করেন কোরিওগ্রাফার রাখি দে ও তাঁর দল। দেখানো হয়, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দেওয়ার পর গার্হস্থ্য ঝামেলায় নিজেকে শেষ করে দেয় এক বধূ। আর এই নাট্যশৈলীর প্রশংসা করে সাংসদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই ঘটনার জন্য বেশিরভাগই মূল দায়ী হন অভিভাবক। তিনি মনে করেন প্রত্যেক অভিভাবক নিজেদের কন্যা সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত করালে সমাজ থেকে এ ধরনের ব্যাধি দূর করা সম্ভব হবে। পড়ুয়া ও অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে সাংসদ বলেন, আপনারা অনেকেই হয়তো দঙ্গল সিনেমাটি দেখেছেন। যেখানে বাবা-মা তাঁদের কন্যা সন্তান গীতা ও ববিতাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে পিছনে ফেলে কুস্তিতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে অভিভাবকরা অবশ্যই কন্যাসন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ। বাড়ির বাইরে যেতে চাইছে কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নিন। প্রয়োজনে পুরুষ বন্ধুকে বাড়িতে নিয়ে আসতে বলে আলাপ করুন। তাতে আপনার কন্যাকে পথে ঘাটে আড্ডা দিতে দেখা যাবে না।

আরও পড়ুন-শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে বিক্ষোভ বন্ধের আর্জি প্রধানমন্ত্রীর

অতিরিক্ত জেলাশাসক শঙ্খ সাঁতরা নারী শিক্ষায় অভিভাবকরা জোর দিলেই বাল্যবিবাহ অনেকটাই রুখে দেওয়া যাবে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, নারীরা এখন সব ক্ষেত্রে এগিয়ে। আগামী দিনে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মূল কাণ্ডরি হবেন মহিলারাই। বাল্যবিবাহ রুখতে ধর্মগুরুদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন জেলা শিশু সুরক্ষা কমিটির চেয়ারপারসন অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় টামটা। তাঁর কথায়, পুরোহিত, ইমাম, পাদরি ও অন্যান্য ধর্মগুরু যাঁরা ধার্মিক দিক থেকে বিবাহ দেন তাঁরা বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারেন। অভিভাবকদের পাশাপাশি এঁরা যদি অল্পবয়সীদের বিয়ে দিতে নাকচ করেন তাহলে এই সমস্যার সমাধান আমাদের চোখের সামনে।


মগরাহাটের বিধায়ক নমিতা সাহা বলেন, গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবারে পড়াশোনা যাতে আর্থিক দিক দিয়ে কঠিন না হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। এছাড়া প্রত্যেকের উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডও। সুতরাং পড়াশোনা করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় ঢুকলেই অল্প বয়সে বিয়ের সম্ভাবনা থাকছে না। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানদের প্রতি নজর রাখাটাই বেশি জরুরি, বলেন বিধায়ক নমিতা সাহা। সামাজিক চাপ থাকে পুরোহিত ও ইমামদের উপর। তাঁরা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন, বাল্যবিবাহ রুখতে প্রশাসনের কাছে খবর পৌঁছালে সেই ব্যক্তির নাম যেন গোপন রাখা হয়।

আরও পড়ুন-শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে বিক্ষোভ বন্ধের আর্জি প্রধানমন্ত্রীর

ডায়মন্ড হারবারের মহকুমাশাসক হিসেবে সম্প্রতি যোগ দেওয়া অঞ্জন ঘোষ মগরাহাট ব্লক প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধাবাদ জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের শিবির করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ভাব বিনিময় করে বাধ্যবিবাহ, মানব পাচার, নারী নিগ্রহ আটকানো খুব সহজেই সম্ভব। ডায়মন্ড হারবারের মহিলা থানার ওসি পিঙ্কি ঘোষও তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সম্প্রতি মহিলা নিখোঁজের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছিলেন হরিয়ানায়। বিজেপি শাসিত এই রাজ্যের ওই মহিলা উদ্ধার করতে গেলে আটকে স্থানীয়রা। তিনি বলেন, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবাংলায় কোনও নিখোঁজ মহিলা বা পাচার হয়ে গেছেন এমন কাউকে উদ্ধার করতে হলে বাধা পেতে হয় না। ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের দেখো, তোমরাও পারবে। আমাদের মতো অফিসার হয়ে নারী পাচার, নিগ্রহকে রুখে দিতে।

আরও পড়ুন-মোদির বারাণসীতেই মুখ থুবড়ে পড়ল বিজেপি

উপস্থিত ছিলেন জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক সঞ্জীব রক্ষিত, জেলা খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ হায়দার আলী মল্লিক, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রদীপকুমার হালদার, মগরাহাট থানার এসআই আরিফ আহমেদ, পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ কাশ্মীরা খাতুন, ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অয়ন ঘোষ, ইউনিসেফ ও আমেরিকান জেসিশ ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের মতো বিশ্বমানের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে মানব পাচার ও বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করা জেলা ও ব্লকভিত্তিক তথ্য সংগ্রহকারী পড়ুয়া রুবিনা খাতুন প্রমুখ। এ ধরনের এক সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে সচেতনতা শিবির আয়োজনের জন্য স্থানীয় বিডিও সেখ আবদুল্লাহকে প্রশংসা করেন সর্বস্তরের মানুষ। এ বিষয়ে সেখ আবদুল্লাহ বলেন, দু’বছর পর করোনা পরিস্থিতি সামলে সম্প্রতি স্কুল খুলেছে। সেখানে বহু ছাত্রী ‘ড্রপ আউট’ হয়েছে। জানা যাচ্ছে, অনেকেরই কম বয়সে বিয়ে গেছে। এছাড়া এই ব্লকে প্রি-ম্যারেজ প্রেগনেন্সিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা খানিকটা বেড়েছে। সে জন্য এই সচেতনতা শিবিরের আয়োজন। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, মানব পাচার ও নারী নিগ্রহ বিষয়ক অভিযোগ জানাতে ব্লক ও থানার তরফে যোগাযোগ নাম্বারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, যৌথ প্রচেষ্টাই সামাজিক এই সমস্যাকে দূর করা সম্ভব হবে।

Latest article