“শ্রীমন্দিরে তোমার পাতা মধুপুরীর সিংহাসন, / উদ্বেল উদ্দণ্ডলীলায় সিন্ধু তোমার বৃন্দাবন। / মানব তোমার চামর ঢুলায়, দানব দুলায় ঝঞ্ঝাবাত, / দারুব্রহ্ম, বারিব্রহ্ম, তোমায় নমি জগন্নাথ।”
—কবিশেখর কালিদাস রায়
রথ শব্দটি বলতেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার (Rath Yatra 2023) ছবি। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ ও ‘পদ্মপুরাণে’ও এই রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে যে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠান শুরু করে শুক্লা একাদশীর দিন পূর্ণযাত্রা বা উল্টোরথ অনুষ্ঠিত হবার কথা। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রাও প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যদিও আষাঢ় মাসের পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম। কিন্তু প্রতি বছর তো আর পুষ্যানক্ষত্রের সঙ্গে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথির যোগ হয় না, তাই কেবল ওই শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই রথযাত্রা শুরু হয়ে থাকে। তবে কখনও এই তিথির সঙ্গে পুষ্যানক্ষত্রের যোগ হলে সেটি হয় একটি বিশেষ যোগ-সম্পন্ন রথযাত্রা।
শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার মতোই বাংলার নিজস্ব রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রচলিত কথায় বলে, জগন্নাথ যান মাসির বাড়ি। কিন্তু এই মাসির বাড়ি আসলে জগন্নাথের বান্ধবী ‘পৌর্ণমাসি’র বাড়ি। সেখানে সাত দিন কাটিয়ে যখন জগন্নাথ মন্দিরে ফেরেন তখন তাঁর অভিমানী স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী তাঁকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন না। পরে অবশ্য জগন্নাথ স্ত্রীর মানভঞ্জন করেন রসগোল্লা পাঠিয়ে। তার পরে মেলে তাঁর মন্দিরে প্রবেশাধিকার। সে-কাল থেকে এ-কাল রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে মানুষের উৎসাহ এতটুকুও কমেনি।
১৭১৯ সালে বড়িশা গ্রামে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রথযাত্রা শুরু করেছিলেন রায় কৃষ্ণদেব মজুমদার চৌধুরী। সেকালে ন’টি চূড়াবিশিষ্ট রথে শালগ্রামশিলা নিয়ে যাওয়া হত বেনাকি বাড়িতে। পরে ১৯১১-এ বড়বাড়িতে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহ ও একটি ত্রিতল রথ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৪ থেকে বিগ্রহগুলিকে রথের সময় হীরালাল বসুর বাড়িতে (মাসির বাড়ি) নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে সর্বজনীন সহযোগিতায় পুরী থেকে কারিগর এনে নতুন রথ তৈরি করা হয়। তবে পুরনো রথের কাঠামো ও লোহার চাকাগুলি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে।
আরও পড়ুন- রথযাত্রাতেও বাতিল ২০ ট্রেন
প্রায় ১২৪ বছর আগে বউবাজার অঞ্চলে গোবিন্দ সেন লেনে জগন্নাথ বিগ্রহ ও রথ (Rath Yatra 2023) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চুনিমণি দাসী। পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল এই রথে সাবেক শিল্পরীতির নমুনা দেখা যায়। রথের চার দিকে আছে চারটি পুতুল এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর ছবিও। শোনা যায়, একবার পুরীর নব কলেবরের সময় অবশিষ্ট একখণ্ড নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পরিবারের নিমকাঠের জগন্নাথ বিগ্রহটি। এই বিগ্রহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আছেন শালগ্রাম শিলা।
প্রায় দুশো বছর ধরে দর্জিপাড়ায় রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে হয়ে আসছে কূলদেবতা রাজরাজেশ্বরের রথযাত্রা। বাড়ির সকলে এ দিন চামর দিয়ে বাতাস করতে করতে তিন বার রথকে প্রদক্ষিণ করেন। পুজোয় করবী ফুল দিয়ে হোম করা হয়। এই উপলক্ষে দেওয়া হয় হরির লুঠ। রথের আর এক ঐতিহ্য ইলিশবরণ। নোড়ার উপর জোড়া ইলিশ রেখে ছোট মাছটির মাথায় সিঁদুর দেওয়া হয়। পরে ধানদূর্বা দিয়ে মাছ দু’টিকে বরণ করা হয়।
তবে শুধু কলকাতায় নয়, মফসসলে এবং বিভিন্ন জেলাতেও পালিত হয় প্রাচীন রথযাত্রা। হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অনেকে গুপ্তিপাড়াকে গুপ্তবৃন্দাবন মনে করেন। এখানেই রয়েছেন শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। বৃন্দাবন জিউর মন্দিরেই থাকেন জগন্নাথ। শোনা যায়, স্বপ্নাদেশ পেয়ে ১৭৮৪-এ জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী মধুসূদনানন্দ। ৬০০ বছরেরও বেশি পুরনো শ্রীরামপুরের মাহেশের রথ। ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানি’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।
নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা বিজয় রাধাবল্লভ জিউর রথযাত্রা আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। বসে মেলাও। রথযাত্রার শুরু ১৮৬২ থেকে। সূচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন তমলুকের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
সেদিন ছিল উল্টোরথ। নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের গৃহদেবতা রাধাবল্লভের পূর্ণযাত্রা। ন’দিন ব্যাপী উৎসবের শেষ দিন। সকাল থেকেই ভক্তদের ভিড়। বিকেলে অর্জুনা পুকুর থেকে পূর্ণযাত্রা শুরু হল। শোভাযাত্রায় ছিলেন গৃহকর্তা রায়বাহাদুর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কাঁসর-ঘণ্টা, ঢাক, জগঝম্প আর সঙ্কীর্তনের মাঝেই ধীরগতিতে এগিয়ে চলল রথ। হঠাৎই যাদবচন্দ্রের সেজ ছেলে বঙ্কিমচন্দ্র লোক মারফত বলে পাঠালেন, ‘রথ যেন আর টানা না হয়!’ এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলে হতবাক। সেসময় বঙ্কিমচন্দ্র বারাসত মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাই তাঁর আদেশ অমান্য করে কে? ভাটপাড়ার পণ্ডিত-অধ্যাপক এবং ভক্তরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এর কারণ জানতে চাইলেন যাদবচন্দ্রের কাছে। উত্তরে তিনি হাসিমুখে বলেছিলেন, আমার বঙ্কিমের হুকুম!
এর মধ্যে হঠাৎই দেখা গেল, রথের ন’টি চাকার মধ্যে একটি বেঁকে গিয়েছে। আরও দু’টি বাঁকার উপক্রম। সেজন্যই রথ টানার সময় বারবার ঘর্ষণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। উৎসবের কোলাহলে সেদিকে কেউ গুরুত্ব না দিলেও খবরটা কোনও ভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের কানে পৌঁছেছিল। আর তাই দুর্ঘটনা এড়াতেই তিনি রথটানা অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই বন্ধ করতে বলেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র সেদিন বাড়িতেই ছিলেন। যদিও রথটানে উপস্থিত ছিলেন না। এই ঘটনাটির উল্লেখ মেলে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাইপো জ্যোতিষচন্দ্রের লেখায়।