ক্যালেন্ডারের শুরু কবে, তা নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনও মত নেই। মনে করা হয়, মিশর নামক এক দেশে চাঁদের হিসেব দিয়ে বছরের দিন গোনা আরম্ভ হয়েছিল। ফিলিস্তিনের ইনকারা বছরের হিসেব করতেন ফসল ওঠার সময়কে সামনে রেখে।
কেউ কেউ বলেন, মায়ান ক্যালেন্ডার পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্যালেন্ডার কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতেও আমেরিকার কলম্বিয়ানদের পূর্বমানুষদের মধ্যে এই ক্যালেন্ডার চালু ছিল। এই মত বেশ বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য যে, মেয়েরাই ক্যালেন্ডারের উদ্ভাবক, তাঁদের ঋতুচক্রের হিসেব অনুযায়ী এই ক্যালেন্ডার তৈরি হয়।
আরও পড়ুন-বাংলার মানচিত্রের বিবর্তন
আমাদের দেশে, বিশেষ করে মহাভারতে দেখা যায়, বছর শুরু হত বসন্তকালে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেন, সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন দিয়ে বছর গণনা এই দেশে করা হত এক কালে। সূর্যের চেয়ে চাঁদের হিসেবে ক্যালেন্ডার কিংবা পঞ্জিকার হিসেব তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। ঋগ্বেদের সময় থেকে দেখা যায়, মাসের নাম বোঝানো হত নক্ষত্রের নাম দিয়ে, আর দিনের নাম বিভিন্ন দেবতা বা ঋষির নাম দিয়ে। অনেক পরে ভারতে মহামতি আকবরের সময়ে প্রবর্তিত হয় হিজরি ক্যালেন্ডার। ইসলাম-ধর্মাবলম্বীরা হিজরি ক্যালেন্ডার মেনে ধর্মীয়-অনুষ্ঠান পালন করেন। তখনকার ৯৬৩ হিজরি সালকে ধরেই বাংলা ক্যালেন্ডারের শুরু হয়, যাকে আমরা বঙ্গাব্দ বলে থাকি।
এই বঙ্গাব্দের প্রচলন নিয়ে অবশ্য বেশ বিতর্ক আছে।
আরও পড়ুন-পয়লা পার্বণ ও বাবুবিলাস
বৈশাখের প্রথম দিনে নববর্ষ পালনের সবচেয়ে পুরনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কৌলীয় সম্রাট অঞ্জনের সময়কালে, খ্রিস্টপূর্ব ৬৯১ সালে। মানে, গৌতম বুদ্ধেরও বহু পূর্বে। অঞ্জন বুদ্ধদেবের মাতুল বংশের লোক।
আর একটি মতের প্রবর্তক ফরাসি পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভি। তিনি লিখছেন, রাজা স্রং সনের পুত্র স্রং সন গাম্পোর জন্ম নাকি ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি পুত্রের জন্মকে স্মরণীয় করে রাখতে এই অব্দের প্রচলন করেন। রাজা স্রং সন মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করেন। সিলভ্যাঁ লেভির অনুগামী কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিত— ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পঞ্চানন মণ্ডলরাও এই মতকে সমর্থন করেন।
আরও পড়ুন-বাঙালির নিজস্বতা
বঙ্গাব্দ নিয়ে এই দুটি মতই বেশ দুর্বল। প্রথম মতটির সপক্ষে তেমন ঐতিহাসিক দলিল নেই, বরং রয়েছে মিথ। দ্বিতীয় মতটি সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, স্রং সনের পুত্র গাম্পোর জন্ম ৫৯৩ সালে নয়; বেশির ভাগ ঐতিহাসিক বলছেন, গাম্পো জন্মান সপ্তম শতকের শুরুতে।
ইদানীংকালে বঙ্গাব্দ নিয়ে একটি মত খুব জোরালো ভাবে উঠে আসছে, সেটি হল—এই সন চালু করেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। ঐতিহাসিক সুশীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল থেকে বঙ্গাব্দ গণনার শুরু, ওই দিন শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তাঁর অভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করার জন্য বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়। কিন্তু শশাঙ্ক যে ৫৯৩ সালে সিংহাসনে বসেন, তার পক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ী, শশাঙ্ক সপ্তম শতকের শুরুতে গৌড়ের রাজা হন। আর একটা কথা মাথায় রাখা দরকার, গৌড় আর বঙ্গ তখন একই জায়গা ছিল না। এ-ছাড়া, শশাঙ্কের অধীনস্থ কর্মচারীরা কেউ বঙ্গাব্দ ব্যবহার করেননি, বদলে গুপ্তাব্দ ব্যবহার করেছেন।
আরও পড়ুন-নববর্ষে বর্ধমান মহাজনটুলি কথা
চতুর্থ আর একটি মত আছে। ঐতিহাসিক যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ এই মতের সমর্থক। তাঁদের দাবি, সুলতান হোসেন শাহ বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। তাঁর আমলে ‘ফসলি সন’ শব্দবন্ধটি রাষ্ট্রের অনুমোদন পায় এবং ক্যালেন্ডারে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ইতিহাস দেখলে বঙ্গাব্দ-র কোনও উদাহরণ হোসেন শাহ-র আমলে পাওয়া যায় না। পরিবর্তে মেলে হিজরি, শকাব্দ ইত্যাদির ব্যবহার। কেউ কেউ আবার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁকে বঙ্গাব্দের জনক হিসাবে মর্যাদা দিতে চান। নবাব পুণ্যাহ উৎসব (খাজনা আদায় করার জন্য একটা উৎসবের দিন) শুরু করেন বঙ্গাব্দ চালু করে। পুণ্যাহ হল খাজনা আদায়ের উৎসব। কিন্তু এই দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ মেলে না।
আরও পড়ুন-রাজ্যের ন্যায্য প্রাপ্য ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা ফেরত দিন, আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব: শাহকে বিঁধে অভিষেক
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হল, সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দ চালু করেন। এই মতের পক্ষে আছেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রমুখ ব্যক্তি। তাঁরা সকলেই এই মতকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। ১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ড. মেঘনাদ সাহা অঙ্ক কষে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক।
অমর্ত্য সেন তাঁর ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থে জানান কীভাবে আকবরের বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহ ও অনুরাগ তাঁকে বিভিন্ন ধর্মের ক্যালেন্ডারে মনোনিবেশ করতে পরিচালিত করেছিল। এর ফলে একটি সম্মিলিত ক্যালেন্ডার তৈরি হয়। তারিখ-ই-ইলাহি নামের ওই ক্যালেন্ডার ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত হয়। অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে ধর্মতত্ত্বের প্রতি আগ্রহের জন্য নয় বরং আরও উচ্চক্ষমতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে আকবর এই ক্যালেন্ডার বেছে নিয়েছিলেন আর তা হল কর বা ট্যাক্স।
আরও পড়ুন-এবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে তলব সিবিআইয়ের
আকবরের পূর্বে মুঘল সাম্রাজ্য ইসলামি হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করার কারণে ভূমি রাজস্ব সংগ্রহে বেশ সমস্যায় পড়েছিল। ইসলামি ক্যালেন্ডার চান্দ্র হওয়ার জন্য এটি বাংলা ঋতুর সঙ্গে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হিজরি সালের হিসাব বাংলার কর-ব্যবস্থাকে বহু বিভ্রান্তির দিকে পরিচালিত করেছিল কারণ এই কর ছিল ঋতুমাফিক ফসল তোলার উপর নির্ভরশীল। তাই আকবর তাঁর রাজসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ শিরাজিকে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করতে বলেছিলেন যা হবে ইসলামি ক্যালেন্ডার ও ঐতিহাসিক বাংলা ক্যালেন্ডার (সংস্কৃত জ্যোতির্বিদ্যার উপর ভিত্তি করে বানানো বা সূর্য সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে তৈরি) এবং আকবরের নিজের রাজ্যাভিষেকের তারিখকে একত্রিত করে। রাজ্যাভিষেক ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিকরা জানেন মুঘল-ই-আজম আকবর বেশ অহংসর্বস্ব ছিলেন।
আরও পড়ুন-এবার ৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি ট্রাম্প
নতুন যে ক্যালেন্ডারটি তৈরি করা হল তা বেশ জটিল। ফতেউল্লাহ শিরাজি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বরকে নতুন অব্দ গণনার শুরু হিসেবে ধরেন। নতুন বছর গণনা-পদ্ধতির নাম দিলেন তারিখ-ই-ইলাহি বা ইলাহি সন। সেই সময় এই অব্দকে ‘ফসলি সন’ বলা হত। ফসল ওঠার পর খাজনা আদায়ের জন্য মুঘলরা সুবে বাংলায় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইলাহি সন বা ফসলি সন চালু করে। তারিখ-ই-ইলাহি এর আগে বাঙালি শকাব্দ অনুযায়ী তারিখ গণনা করত, যা বর্তমান ভারতের জাতীয় সন। শকাব্দের প্রথম মাস হল চৈত্র আর দ্বিতীয় মাস হল বৈশাখ। ৯৬৩ হিজরির প্রথম মাস মহরমের সময়ে শকাব্দ সনের মাস ছিল বৈশাখ। হিজরি সনের সঙ্গে মিল করে তারিখ-ই-ইলাহির প্রথম মাস বৈশাখ ধরে গণনা করা হয়। অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরির ১ মহরম তারিখ ছিল ৯৬৩ বাংলা সনের ১ বৈশাখ। হিজরি ৯৬৩ সনকে ইলাহি সনের প্রথম বৎসর ধরা হয় এবং এর পরবর্তী বছর থেকে সৌর বছর হিসাবে গণনা শুরু হয়। বাংলার জন্য উদ্ভাবিত বলে এটি পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। মনে রাখতে হবে, শূন্য থেকে বাংলা সন গণনা করা হয়নি। ৯৬৩ বছর বয়স নিয়েই বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রথমাংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ বৎসর, সম্পূর্ণরূপে হিজরি সনভিত্তিক তথা চান্দ্র সন। পরবর্তী অংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ থেকে আজ পর্যন্ত সৌরভিত্তিক।
আরও পড়ুন-এগিয়ে থেকেও জয় অধরা ইস্টবেঙ্গলের
বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরুর পর থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টীয় অব্দের মতো বাংলা সনে লিপইয়ার বা অধিবর্ষ ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বঙ্গাব্দ সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি চার বছর পরপর চৈত্র মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করার পরামর্শ দেয়। বাংলা মাস গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন হিসেবে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত ৩০ দিন পরিগণিত হবে। ওপার বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সেই মতো বঙ্গাব্দের হিসাব করা হয়, এপার বাংলায় অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গে তা হয় না।
আরও পড়ুন-রাহুল মামলায় রায়দান স্থগিত
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, সম্রাট আকবরকে সুনিশ্চিতভাবে কি বঙ্গাব্দের জনক বলা যায়? ইতিহাসবিদ নীতীশকুমার সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, আকবরের কয়েক শতাব্দী পূর্বে নির্মিত দুটো শিবমন্দিরের গায়ে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি আকবরেরও পূর্বে বাংলা সনের অস্তিত্ব ছিল?