ঢাকে কাঠি পড়ার সময় এল বলে। আর মাত্র চারটে সপ্তাহ। নীল শরতের সোনাভরা আকাশ। চারিদিক ম-ম করে শিউলির গন্ধ!
শিউলি বলতে গেলেই এখন এসে যাচ্ছে অচিন্ত্য শিউলির নাম। দেউলপুরের অখ্যাত ভারোত্তোলকের এখন দেশজোড়া নাম। কমনওয়েলথ গেমসের একটা সোনা জীবন বদলে দিয়েছে বছর একুশের তরুণের। কিন্তু পিছনের অনেকগুলো বছরের সেই পরিশ্রম কি তাতে ঢাকা পড়বে? টাকা নেই। এমন কঠিন খেলার সঙ্গে মানানসই খাদ্য-সংস্থান নেই। পরিকাঠামো নেই। তার মধ্যেই দাদা অলোক এবং কোচকে নিয়ে সোনার লড়াই লড়েছেন অচিন্ত্য।
আরও পড়ুন-বদলে যাক এতদিনের চেনা ছবি
বার্মিংহাম থেকে সোনার মেডেল নিয়ে এসে বঙ্গসন্তান সংবর্ধনায় ভেসেছেন। কিন্তু তারমধ্যেও জনে জনে এটাই বলেছেন, তাঁর পাড়ার ক্লাবের পরিকাঠামো ভাল করার জন্য। পাশে দাঁড়াতে বলেছেন নিজের কোচের। বড্ড পরিশ্রম করেছেন এই ভদ্রলোক তাঁর ছাত্রের জন্য। অচিন্ত্যর মা পূর্ণিমা বলেছেন, একটা সময় তাঁর ছেলের দশ টাকার সামোসা কেনার পয়সা থাকত না। ১২ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন সোনাজয়ী ভারোত্তোলক। কিন্তু জেদ আর অধ্যবসায় আজ তাঁকে এই জায়গায় এনে দিয়েছে।
আরও পড়ুন-ক্রীড়াবিদদের কলমে জাতীয় ক্রীড়াদিবস
এভাবেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর চ্যাম্পিয়নরা উঠে আসেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন। কোথাও মীরাবাই চানু, কোথাও হাই জাম্পার তেজস্বী শঙ্কর। আরও একটা স্পোর্টস ডে। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের জন্মদিনে আজ দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে জাতীয় ক্রীড়াদিবস। কিন্তু আজ যাঁরা সম্মানিত হচ্ছেন, তাঁদের লড়াইয়ের দিনে পাশে ক’জন ছিলেন! দেশের মানুষের জীবনে খেলাধুলোর গুরুত্ব বাড়াতেই এমন উদ্যোগ। ২০১৮ থেকে এরসঙ্গে জুড়ে গিয়েছে খেলো ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন। বার্তা খুব স্পষ্ট। জীবনে খেলাধুলোর গুরুত্ব বাড়াও। এমন দিনে ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন, অর্জুন পুরস্কার, দ্রোণাচার্য খেতাব, সবই হাতে ওঠে খেলোয়াড়, কোচেদের। কিন্তু এতসবের পরও অচিন্ত্যদের মতো প্রতিভাবানদের কেন নিজের তাগিদেই উঠে আসতে হবে, সেই প্রশ্ন কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন-সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে এ কী অবস্থান ! সিপিএম নেতাদের নামে মামলা
চানুর উঠে আসার দিনগুলি ছিল ভয়ানক কষ্টের। প্রতিভা থাকলেও সেই প্রতিভাকে জায়গামতো পৌঁছে দেওয়া আমাদের মতো দেশে চ্যালেঞ্জ। ইম্ফল থেকে দুশো কিলোমিটার দুরে চানুর বাড়ি। চানু উঠে আসার দিনগুলিতে বারবেলও পাননি। তাই বাঁশকেই বারবেল বানিয়ে নিয়েছিলেন। রোজ ২০ কিলোমিটার যাত্রা করে প্র্যাকটিস করতে যেতেন চানু। বাবা নির্মাণকর্মী ছিলেন। মা রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালাতেন। এহেন পরিবারে ভারোত্তোলকের খাবার জোটাই তো ছিল চ্যালেঞ্জ।
আরও পড়ুন-আলোর কাজে উঠে আসবে ইতিহাস, পুরাণ
২০২২-২৩-এর জাতীয় ক্রীড়া বাজেটের পরিমাণ এবার ৩০৬২.৬০ কোটি টাকা। আগেরবার এই পরিমাণ ছিল ২৭৫৭.০২ কোটি টাকা। পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট যে এক বছরে ক্রীড়া বাজেটের পরিমাণ বেড়েছে ৩০৫.৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু তাতে ছবিটা কতটা বদলেছে প্রশ্ন উঠতে পারে। বার্মিংহামে ৬১টি পদক জিতেছেন ভারতীয় প্রতিযোগীরা। টোকিও অলিম্পিকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে দেশের জন্য প্রথম সোনা এনেছেন নীরজ চোপড়া। বিশাল সাফল্য সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সাফল্যের পিছনে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত উদ্যোগ-অধ্যবসায় কতবড় ভূমিকা নিয়েছিল, সেটা মাপবেন কে। কেন প্রস্তুতির জন্য বাইরে যেতে চেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হবে খেলোয়াড়দের।
সোনার ছেলে নীরজের কথাই ধরা যাক। বাবা রোজ তিরিশ টাকা করে হাতে দিতেন। সেই টাকা সম্বল করে গ্রাম থেকে পানিপথ স্টেডিয়ামে যেতেন প্র্যাকটিস করতে। যাতায়াতেই সব শেষ হয়ে যেত। ক্লান্ত শরীরকে এক গ্লাস জুস কিনে দেওয়ারও সামর্থ্য থাকত না। তবু লড়েছেন হরিয়ানার তরুণ। পাশে পেয়েছেন নিজের কাকাকে। তারপর হাতের জ্যাভলিনকে হাতিয়ার করে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উড়িয়ে দেশকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে প্রথম সোনা এনে দিয়েছেন সোনার ছেলে।
আরও পড়ুন-করোনা টিকার মেধাস্বত্ব চুরির অভিযোগে ফাইজারের বিরুদ্ধে মামলা মডার্নার
চানুরা কেউ বারবেলের বদলে বাঁশ নিয়েই প্রস্তুতি সারছেন। কেউ ট্র্যাক ড্রাইভারের সৌজন্যে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রোজকার প্রস্তুতি সারছেন। কখনও পাশে কেউ থাকে, কখনও কেউ থাকে না। তবু এই লড়াই চলতেই থাকে। রিও থেকে টোকিও। তারপর বার্মিংহাম। সবাই নিশ্চিত, প্যারিসেও সাফল্যের ছবিই ভেসে উঠবে। কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত উদ্যাগই বড় ভূমিকা নেবে।
৩৮ বছর আগেকার একটা ঘটনা। লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য ব্রোঞ্জ হাতছাড়া হয়েছিল পি টি উষার। সেদিন তিনি পদক তুলে নিতে পারলে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড-এ প্রথম সাফল্যের জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করতে হত না ভারতকে। উষার সময় বিদেশে ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা ছিল না। নীরজ তাঁর জার্মান কোচের সঙ্গে অলিম্পিকের আগে অনেকটা সময় বিদেশে কাটিয়েছেন। উন্নত ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। এই ক’দিন আগে নীরজ আমেরিকায় প্রথম ভারতীয় হিসাবে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে রুপো জিতলেন। এখন তিনি সেখানে থেকেই পরের টুর্নামেন্টে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাঝে চোটের জন্য কমনওয়েলথে নামতে পারেননি।
আরও পড়ুন-রাহুল ঘনিষ্ঠদের কটাক্ষ কংগ্রেস সাংসদ মণীশের
কিন্তু উষা? যিনি বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্য। তাঁর ছিল নাম্বিয়ার স্যার যিনি তাঁর দেশজ ট্রেনিংয়েই অলিম্পিক মানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। উষার আগে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এরকম পারফরম্যান্স ছিল মিলখা সিংয়ের। তিনিও চতুর্থ হয়েছিলেন। অনেকদিন বাদে শ্যুটিংয়ে চতুর্থ হন বঙ্গসন্তান জয়দীপ কর্মকার। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে হার্ডলসে চতুর্থ হয়েছিলেন অঞ্জু ববি জর্জ। পরে অভিনব বিন্দ্রা, পি ভি সিন্ধু। চানু, নীরজরা ভারতীয় খেলাধুলাকে আরও অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
হাই জাম্পার তেজস্বীন শঙ্করের জীবনে যা ঘটেছে, তাও কি ঘটার ছিল? বার্মিংহামে তাঁর ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছেন তিনি। কিন্তু দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল এই ২৩ বছরের তরুণকে। তাঁর নাম বাদ পড়ে গিয়েছিল কমনওয়েলথ গেমস থেকে। আর সেটা হয়েছিল চেন্নাইয়ে আন্তঃরাজ্য অ্যাথলেটিক্সের আসরে। সেটাই ছিল বার্মিংহামের ছাড়পত্র পাওয়ার কোয়ালিফিকেশন ম্যাচ। এরপর আদালত পর্যন্ত গড়ায় ব্যাপারটা। ভারতীয় অলিম্পিক আ্যাসোসিয়েশন শেষমুহূর্তে তেজস্বীনের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন ভারতীয় অ্যাথলিট এই দোটানায় পড়বেন কেন? কেন খেলোয়াড়কে শুধু খোলামনে প্রস্তুতি নিতে দেওয়া হবে না।
আরও পড়ুন-বিশ্ব ব্যাডমিন্টন: ব্রোঞ্জে থামলেন সাত্ত্বিক ও চিরাগ
তেজস্বীন বলেছেন, তিনি এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন যে সেখানে যাবেন না ঠিক করেছিলেন। তবে তাঁর কোচ ক্লিফ রোবালটো বলেছিলেন, তুমি যখন সুযোগ পেয়েছ, এখান থেকে যতটা পার নিয়ে নাও।
অলিম্পিক, কমনওয়েলথ গেমসে পদক পেলে জমকালো সংবর্ধনাও অপেক্ষা করে থাকে অ্যাথলিটদের জন্য। কিন্তু পদকের আড়ালে যে এমন সব ঘটনাও পড়ে থাকে, তা কতজন জানে!
জাতীয় দলে খেলা প্রাক্তন এক ফুটবলার সেদিন আক্ষেপ করছিলেন, আমরা নিজেরাই নিজেদের তৈরি করেছি। বড় দলে এসে নামী কোচের হাতে পড়েছি। কিন্তু যখন পড়েছি, ততদিনে শেখার সময় পার হয়ে গিয়েছে! নেওয়ার একটা সময় থাকে। আমরা ঠিক বয়সে কিছুই পাইনি। এই প্রাক্তন কলকাতার বড় দলের হয়ে দাপিয়ে খেলেছেন। সেটা স্থানীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের কথা। এই প্রাক্তন খেলতেন সাত ও আটের দশকে। তেজস্বীনের দুর্ভোগের ছবিটা ২০২২-এর। এই এক তথ্যে এটা পরিষ্কার, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
আরও পড়ুন-চেয়ার চলে যাবে! উপাচার্যকে হুমকি এবিভিপি নেতার
ঠিক এই কারণেই ক্রিকেট আলাদা সমীহ পায়। বিসিসিআই স্বশাসিত সংস্থা। বিশ্বের সবথেকে ধনী ক্রীড়া সংস্থা। তাদের কারও সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। জাতীয় ক্রীড়ানীতি বা ক্রীড়া বাজেটের কোনও আঁচও এখানে এসে পড়ে না। হপ্তা কয়েক আগের কথা। ইংল্যান্ড সফর সেরে কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের উড়ান গিয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ করে। ভাবা যায়! যায়। শুধু বিসিসিআইয়ের ক্ষেত্রেই এটা ভাবা যায়। যারা আইপিএল করে কোটি কোটি টাকা রোজগার করে। এমন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের নিলামে একজন ক্রিকেটারের দাম ওঠে সাড়ে ১৬ কোটি।
আরও তথ্য আছে। বিসিসিআই এখন অন্য ক্রীড়া সংস্থা পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। এবারই অলিম্পিকগামী ভারতীয় দলকে দশ কোটি টাকা দিয়েছে। অন্যদেরও আগে সাহায্য করেছে। ইস, অন্যান্য স্পোর্টস ফেডারেশনের কপাল যদি বিসিসিআইয়ের মতো হত।