এ-বছর শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পেলেন চার বাঙালি বিজ্ঞানী, চিকিৎসায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজির দীপ্যমান গাঙ্গুলি, রসায়নে আইআইটি বম্বের দেবব্রত মাইতি, পদার্থবিদ্যায় পুরস্কার পেয়েছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের অনিন্দ্য দাস এবং মুম্বই টিআইএফআরের বাসুদেব দাশগুপ্ত।
আরও পড়ুন-শিশু নক্ষত্রের ভিড়ে
প্রতিবছর দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণা ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকারের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদ বা কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) ‘শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার’ (এসএসবি) দিয়ে থাকে। জীবন বিজ্ঞান, রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান (পৃথিবী, বায়ুমণ্ডল, মহাসাগর, গ্রহবিজ্ঞান), ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ভৌত বিজ্ঞান-সহ মোট সাতটি ক্ষেত্রে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জন্য এবছর মোট ১২ জন বিজ্ঞানীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে চার জনই হলেন বাঙালি। বাঙালি হিসেবে আমরা সকলেই তাঁদের জন্য গর্বিত, খবরের কাগজের পাতা অনেক আগেই আমাদের জানান দিয়েছে তাঁদের সাফল্যের কথা, তাঁদের কাজের ক্ষেত্রের কথা, কিন্তু তাঁদের গবেষণার বিষয় জানা থাকলেও তাঁদের কাজের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে আমরা ক’জনই বা জানি? ক’জনই বা জানি তাঁদের পরিশ্রম বা প্রতিকূলতার কথা, তাঁদের জীবনযাত্রার কথা। তাই আজ এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই ঘুরে আসা যাক তাঁদের সাফল্যের যাত্রাপথে, ছুঁয়ে আসা যাক সেই সমস্ত মাইলস্টোন যা পেরোতে তাঁদের মাথার ঘাম ঝরেছে, এসেছে বহু প্রতিকূলতা, দেখে আসা যাক তাঁরা কীভাবে একজন গবেষক থেকে দেশের সর্বকালীন সেরা বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের সামনে ভাটিকা, আই লিগে আজ অভিযান শুরু কিবুর দলের
ভাটনগর পুরস্কার নিয়ে দু-চার কথা
ড. শান্তি স্বরূপ ভাটনগর শুধুমাত্র একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীই ছিলেন না, বরং বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও (পরবর্তীকালে প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল) ছিলেন। মাত্র বারো বছরে ১২টি জাতীয় গবেষণাগার স্থাপনের কৃতিত্ব তাঁর। ভারতের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো নির্মাণে এবং দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি প্রণয়নে তাঁর প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ড. ভাটনগর সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রথম চেয়ারম্যান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। তিনি প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রথম সচিব এবং পরমাণু শক্তি কমিশনের সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এমনকী তিনি ভারতের ন্যাশনাল রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (NRDC) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রশাসনিক ভূমিকা ছাড়াও ড. ভাটনগর চুম্বক রসায়ন এবং ইমালশনের ভৌত রসায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তাঁর গবেষণা, কাজ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছিল এবং তিনি বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (OBE) উপাধিতে ভূষিত হন, ১৯৪১ সালে নাইট উপাধিতে ভূষিত হন এবং ১৯৪৩ সালে রয়্যাল সোসাইটি, লন্ডনের ফেলো হিসাবে নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও তিনি ১৯৫৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানে ড. ভাটনগরের উল্লেখযোগ্য অবদান এবং ভারতের বৈজ্ঞানিক সক্ষমতাকে এগিয়ে নেওয়ার পথকে আরও সুদৃঢ় করা এবং ভারতীয় গবেষকদের ব্যতিক্রমী বৈজ্ঞানিক কাজের স্বীকৃতিকে কুর্নিশ জানানোর উদ্দেশ্যেই ১৯৫৮ সালে শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারটি চালু হয়েছিল।
আরও পড়ুন-স্বচ্ছতা আনতে বিজ্ঞপ্তি জারি করল অর্থ দফতরের ই-গভর্ন্যান্স শাখা
ড. ভাটনগরের উত্তরাধিকার অব্যাহত রাখতে দেশে গবেষণার প্রচার এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এটি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শাখায় ৪৫ বছরের কম বয়সি অসামান্য বিজ্ঞানীদের প্রতি বছর পুরস্কৃত করে।
দীপ্যমান গাঙ্গুলি
প্রথমেই পরিচয় করা যাক দীপ্যমান গাঙ্গুলির সঙ্গে। ইনি হলেন একজন ভারতীয় চিকিৎসা-বিজ্ঞানী তথা ইমিউনোলজিস্ট এবং কোষজীববিজ্ঞানী, বর্তমানে ইনি CSIR-ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজি (IICB)-এর স্বর্ণজয়ন্তী ফেলো এবং একজন প্রধান বিজ্ঞানীও বটে। তিনি IICB-এর ডেনড্রাইটিক কোষ ল্যাবরেটরির প্রধান যা গাঙ্গুলি ল্যাব নামে পরিচিত, যেখানে তিনি সহজাত অনাক্রম্যতা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রদাহজনিত রোগের প্যাথোজেনেসিসের ওপর গবেষণায় জড়িত বেশ কয়েকজন গবেষককে হোস্ট করেন। ড. গাঙ্গুলি ২০০১ সালে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, কলকাতা থেকে মেডিসিনে স্নাতক হন কিন্তু বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় তাঁর মনোযোগ স্থানান্তরিত করেন এবং ক্লিনিক্যাল সহযোগী হিসেবে ইনস্টিটিউট অফ জিনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজিতে যোগ দেন। ২০০৩ সালে, তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজিতে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৬ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং হিউস্টনে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস হেলথ সায়েন্স সেন্টার থেকে তিনি আরও একটি পিএইচডি অর্জন করেন। তাঁর পোস্ট-ডক্টরাল কাজ ছিল কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে একজন এসএলই ফাউন্ডেশন ফেলো হিসেবে। এরপর ভারতে ফিরে এসে তিনি আইআইসিবি-তে যোগ দেন যেখানে তিনি বর্তমানে একজন প্রধান বিজ্ঞানী। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একজন স্বর্ণজয়ন্তী ফেলো এবং পূর্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল গবেষণা বোর্ডের রামানুজন ফেলো ছিলেন।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের ৬ ইস্যুতে উত্তাল সর্বদল বৈঠক
বিজ্ঞানে অবদান : গাঙ্গুলি ল্যাবের গবেষণার মূল বিষয়গুলি হল স্ব-বিক্রিয়ক প্রদাহজনক প্রসঙ্গে ডেনড্রাইটিক কোষের ভূমিকা অন্বেষণ, সহজাত অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়ার আণবিক নিয়ন্ত্রণের পাঠোদ্ধার এবং ইমিউন কোষগুলিতে যান্ত্রিক সংকেতের ভূমিকা। গাঙ্গুলি ল্যাবের গবেষকরা সম্প্রতি মানুষের (T cell) টি কোষে পাইজো১ মেকানোসেন্সর জড়িত একটি অভিনব নিয়ন্ত্রক মডিউল আবিষ্কার করেছেন, যা যান্ত্রিক সংকেত দ্বারা চালিত হয়। তারা মানুষের মধ্যে স্থূলতা এবং সংশ্লিষ্ট বিপাকীয় সিন্ড্রোমে প্লাজমাসাইটয়েড ডেনড্রাইটিক কোষের জড়িত থাকার জন্য প্রথম প্রমাণও প্রদান করেছে। দীপ্যমান গাঙ্গুলির পূর্ববর্তী কাজ সোরিয়াসিসে ঘটা ত্বকের স্ব-অনাক্রম্যতা জনিত প্যাথোজেনেসিসের মূল সূচনা ঘটনাগুলির আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত করেছিল এবং সেইসঙ্গে সিস্টেমিক লুপাসে পারমাণবিক অ্যান্টিজেনের প্রধান উত্স হিসেবে মৃত নিউট্রোফিলগুলির প্রথম শনাক্তকরণ, যা ২০১২ সালে মেডিসিনে প্রধান অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আরও পড়ুন-অসমে তৃণমূল-সহ ১৫ দলের বৈঠক, বিজেপিশূন্য উত্তর-পূর্ব গড়ার লক্ষ্য
দেবব্রত মাইতি
আমাদের দ্বিতীয় বাঙালি হলেন গ্রাম থেকে উঠে আসা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এক তরুণ বাঙালি দেবব্রত মাইতি। এই বাঙালি বিজ্ঞানী পূর্ব মেদিনীপুরের ছেলে। ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত তমলুকের শ্রীরামপুর গ্রামের স্থানীয় কৃষি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। এর পর বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির থেকে ২০০১ সালে তিনি বিএসসি পাশ করেন এবং ২০০৩ সালে আইআইটি বম্বে থেকেই এমএসসি পাশ করেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জি কে লাহিড়ী। এর পর সোজা বিদেশে পাড়ি দেন দেবব্রত। আমেরিকার জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন তিনি। সেখানে কে ডি কারলিনের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি শেষ করেন ২০০৮ সালে। এর পর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিট অব টেকনোলজিতে গবেষণা সেরে দু’বছর পোস্ট ডক্টরেটের গবেষণা সেরে ফিরে আসেন দেশে। দেশে ফিরে তিনি সেই বম্বে আইআইটিতেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন দেবব্রত।
বিজ্ঞানে অবদান : আইআইটি বম্বের অধ্যাপক দেবব্রত মাইতি এই বছর রসায়নে ভাটনগর পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মূল গবেষণা কার্বন এবং হাইড্রোজেন পরমাণুর পারস্পরিক রাসায়নিক বন্ধন নিয়ে। এ ছাড়াও, সন্ধিগত মৌলের অণুঘটন ক্ষমতাকে অভিনব উপায়ে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর দেখানো পথেই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন জীবনদায়ী ওষুধ। এমনকী কীটনাশক প্রস্তুতিতেও লাগছে সেই রাসায়নিক। তাঁর বর্তমান কাজ প্রসঙ্গে, প্রফেসর মাইতি বলেন, ‘‘আমি বর্তমানে কাজ করছি, যাকে লোকেরা C–H অ্যাক্টিভেশন বলে। সিন্থেটিক কেমিস্ট হিসেবে, আমরা সহজে উপলব্ধ প্রারম্ভিক উপকরণ থেকে নতুন, সহজে অ্যাক্সেসযোগ্য রাসায়নিক তৈরি করার লক্ষ্য রাখি। সাধারণত, এটি খরচসাপেক্ষ এবং একাধিক কঠিন পদ্ধতি ব্যবহার করে করা হয়। আমাদের লক্ষ্য হল এই পথটিকে একটি একক-পদক্ষেপ প্রক্রিয়ায় সংক্ষিপ্ত করা।
আরও পড়ুন-বঞ্চনা-অপমানের প্রতিবাদে উত্তাল, গর্জে উঠল কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ
জৈব অণুতে সাধারণত প্রচুর কার্বন-হাইড্রোজেন (C–H) বন্ধন থাকে। আপনি কল্পনা করতে পারেন যে কোনওভাবে যদি C–H বন্ডগুলিকে নতুন রাসায়নিক বন্ডে সম্পাদনা করতে পারেন তবে অনেক সহজ এবং সস্তায় আপনি নতুন অণু তৈরি করতে পারবেন।’’ যদিও এটি লক্ষ্য করা উচিত যে C–H বন্ধন সম্পাদনা করা অতটা সহজ নয়। C–H বন্ধন শক্তির ভিত্তিতে, বলা যায় যে বন্ধনটি ভাঙা কতটা সহজ বা কঠিন, তবে এই প্রক্রিয়াটি অর্জন করাও বেশ পরিশ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষও বটে। তাদের সাম্প্রতিক কাজের একটিতে, প্রফেসর মাইতি এবং তাঁর দল জৈবিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যৌগগুলির উত্পাদনকে সহজ করার জন্য একটি প্রতি-স্বজ্ঞাত রাসায়নিক বিক্রিয়া তৈরি করেছে। তারা যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে তা প্রাকৃতিক পণ্য এবং ওষুধে পাওয়া ল্যাকটোন নামক অপরিহার্য যৌগ গঠনের জন্য নিষ্ক্রিয় কার্বন-হাইড্রোজেন (C–H) বন্ধনকে সক্রিয় করে।
আরও পড়ুন-রিঙ্কু, অক্ষরে সিরিজ ভারতের
অনিন্দ্য দাস
বাঙালি বিজ্ঞানী অনিন্দ্য দাসের পড়াশোনা বেলুড়ের রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরে। বর্তমানে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেন অনিন্দ্য। পাশাপাশি আইআইএসসি-এর কোয়ান্টাম ট্রান্সপোর্ট ল্যাবরেটরির প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি পাশ করেন এই শতকের গোড়াতেই। এর পর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন বেঙ্গালুরু। সেখানে প্রথমে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এরপর রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ শুরু হয় তাঁর। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত গবেষণার পর পোস্ট ডক্টরেটও করেন সেখান থেকেই। তাঁর গবেষণার বিষয়ের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে সেমিকনডাক্টর ন্যানোটিউব, অন্যদিকে রয়েছে জিরোডাইমেনশনাল কোয়ান্টাম ডটস। এ ছাড়াও, দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক টোপোলজিকাল ইনসুলেটর নিয়েও কাজ করেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই দুটি বিশেষ ধরনের ন্যানোটিউবের পেটেন্টও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
আরও পড়ুন-অমৃতা মামলার তদন্তের রিপোর্ট জমা সুপ্রিম কোর্টে
বিজ্ঞানে অবদান : তাঁর টিম মূলত যে বিষয়ে পারদর্শী, সেটি হল পরীক্ষামূলকভাবে ঘনীভূতকরণযোগ্য পদার্থের পদার্থবিদ্যা এবং তাদের মূল লক্ষ্য হল উদীয়মান কোয়ান্টাম ন্যানো-ডিভাইসগুলিতে পরিবহণক্ষমতার পর্যবেক্ষণ। তাদের মূল কৃতিত্বের মধ্যে রয়েছে দুটি মাত্রায় নতুন যৌথ পর্যায় এবং কোয়ান্টাম ঘটনা উন্মোচন করা, ভ্যান ডের ওয়ালস হেটেরো-স্ট্রাকচারে গ্রাফিন এবং স্তরযুক্ত উপকরণ জড়িত অত্যাধুনিক কৌশলগুলি যেমন তাপীয় পরিবহণ ব্যবহার করা। এই ফলাফলগুলির ঘনীভূত-পদার্থের পদার্থবিদ্যা জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এবং এটিকে কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন-যায় যদি যাক গজের প্রাণ, গজাননই ভগবান
বাসুদেব দাশগুপ্ত
আমাদের চতুর্থ বাঙালি বিজ্ঞানী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পদার্থবিদ্যার স্নাতক স্তরের ছাত্র ছিলেন। এর পর তিনি টিআইএফআর থেকে স্নাতকোত্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেন। গবেষণাস্তরের পড়াশোনাও সেখানেই সম্পূর্ণ হয় তাঁর। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাই হল তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয় । প্রসঙ্গত, গবেষণায় তাঁর আগ্রহের মূল কারণ হল নিউট্রিনো কণা এবং ডার্ক ম্যাটার। সেই নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে চলেছেন তিনি। এ-ছাড়া ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের অধ্যাপক বাসুদেব। বর্তমানে ইউরোপিয়ান ফিজিক্যাল জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলীতেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর গবেষণার বিষয়ের মধ্যে নিউট্রিনো কণা এবং ডার্ক ম্যাটার ছাড়াও রয়েছে কসমোলজি ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। প্রসঙ্গত, ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের একটি সহযোগী সংস্থার সঙ্গে বর্তমানে কর্মরত তিনি। বলা বাহুল্য এই বিজ্ঞানী আবার শিল্পীও— অ্যাক্রিলিক পেন্টিং-এর শখ রয়েছে তাঁর। এ ছাড়াও খাওয়াদাওয়া ও ভ্রমণ তাঁর অন্যতম নেশা।
আরও পড়ুন-৫ রাজ্যে ভোট মিটতেই ফের বাড়ল গ্যাসের দাম
বিজ্ঞানে অবদান : তাঁর গবেষণা মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানের পদার্থবিদ্যা এবং কণা পদার্থবিদ্যার মধ্যে সংযোগ বোঝার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। দাশগুপ্ত ব্যাখ্যা করেন যে, যেমন পরমাণুকে বোঝা বা জানা আমাদের রসায়ন এবং পদার্থের বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাহায্য করে, তেমনি কণা পদার্থবিদ্যা বোঝা বা জানা আমাদের জ্যোতির্পদার্থগত বস্তুর আচরণ বুঝতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, নিউট্রিনো নামক সাব-অ্যাটমিক কণা অধ্যয়ন নাক্ষত্রিক বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে পারে। নিউট্রিনো আসলে বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান এবং এরা সহজেই এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। এই একই প্রক্রিয়া বিশাল নক্ষত্রের মধ্যেও ঘটে এবং তাদের বিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে।
নিউট্রিনো নিয়ে দাশগুপ্তের গবেষণা একটি অস্থিরতার পূর্বাভাস দিয়েছে যা কোনও ঘন পরিবেশে একে অপরের সঙ্গে অনেক নিউট্রিনোর সুসঙ্গত মিথস্ক্রিয়া হওয়ার কারণে ঘটে। এই অস্থিরতা তারকা বিস্ফোরণ এবং মহাবিশ্বে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে বলে মনে করা হয়। নিউট্রিনো নিয়ে তাঁর কাজ ছাড়াও দাশগুপ্ত রহস্যময় ‘ডার্ক ম্যাটার’ অধ্যয়ন করেন যার অস্তিত্ব তাত্ত্বিক কিন্তু এখনও তার পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা হয়নি। ছায়াপথ এবং মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণগুলি অতিরিক্ত ভরের উপস্থিতির আভাস দেয়, যা দৃশ্যমান পদার্থ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। অন্ধকার পদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার বোঝা বা জানা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।
আরও পড়ুন-আদিবাসী সমাজকে কলুষিত করল বিজেপি, গদ্দারদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাংলা
আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা-দের এই বাংলা যে এখনও একেবারেই বিজ্ঞানচ্যুত হয়ে যায়নি, বাঙালি যে এখনও তাদের যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞানের দিক থেকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের দাবিটা রাখে তা এই ভাটনগর পুরস্কারই বোধ হয় আবারও প্রমাণ করে।