অনেকেই জানেন যে, ভারতের বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের নতুন বছর শুরু করেন হয় চৈত্রের শুক্লা প্রতিপদে অথবা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে (Pahela Boisakh)। একটি চন্দ্রবর্ষ ও অন্যটি সৌরবছর অনুযায়ী। আসলে কিন্ত দুটি দিনের মধ্যে খুব একটা ব্যবধান হয় না, কখনও মাত্র কয়েক দিনের বা কোনও কোনও সময়ে দু-এক সপ্তাহের। মহারাষ্ট্রে এবং গোয়ায় এই চৈত্র নববর্ষের নাম গুঢ়ি পড়বা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা আর কর্নাটকে উগাড়ি, সিন্ধিদের চেইতি চাঁদ, পার্সি ও কাশ্মীরিদের নওরোজ এবং বেশ কয়েকজন মাড়োয়ারি গোষ্ঠীদের ঠাপনা। হিমাচলিরা এই দিনটিকে চৈত্তি বলে।
অবশ্য গাঙ্গেয় অববাহিকা ও মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগঢ়, ঝাড়খণ্ডে হোলিকে তাঁদের বছরের সূচনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর ভারত সরকারের নববর্ষ শুরু হয় সাধারণত ২২ মার্চ-এ, মহাবিষুবের (স্প্রিং ইকুইনক্স) সময়কালীন এই শক সম্বৎকে ধরা হয়। এই বছর চৈত্র নববর্ষ ছিল ২ এপ্রিল আর পয়লা বৈশাখ (Pahela Boisakh) ১৫ তারিখে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশে এক দিন আগে। তিথি দিন ক্ষণে এই রকম হয়েই থাকে, আশ্চর্যের কিছু নেই। বৈশাখের নববর্ষ বিভিন্ন নামে পরিচিত। পাঞ্জাবে বৈশাখী, আসাম ও পূর্বাঞ্চলের অনেক জায়গায় রঙ্গলি বিহু, কেরালায় বিশু, তামিলনাডুতে পুথান্ডি, ওড়িশায় পণিসংক্রান্তি আর মৈথিলিরা বলে জুড়ে শীতল।
ভারতের অতুলনীয় বৈচিত্র্যের সবচেয়ে ভাল প্রমাণ হল এত রকমের ক্যালেন্ডার এবং ‘নববর্ষ’। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে একে অন্যের কাছে এসেছে, মিলেছে, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। তাদের উপর গায়ের জোরে কেউ কোনও একমাত্রিক তকমা চাপিয়ে দিতে পারেনি। তাই এই বহু ‘নববর্ষ’র বৈচিত্র্যের মধ্যে ক্রমশ একটা ঐক্যের ধারণা তৈরি হয়েছে। গুজরাতের নববর্ষ অবশ্য একটি ব্যতিক্রম, চৈত্রের শেষের দিকেও না বৈশাখের গোড়াতেও নয়। তারা অর্থ ও লক্ষ্মীকে প্রচুর ঘটা করে পুজো করে দেওয়ালির দিন আর সেই দিন থেকেই তাদের নতুন বর্ষ। তা সত্ত্বেও কোনও একটি নির্ধারিত দিন না থাকলেও ১২৫ কোটির বেশি ভারতবাসী যে খুব কাছাকাছি দুটি দিনের মধ্যে যে কোনও একটিতে নববর্ষ পালন করেন, সত্যি বিস্ময়কর ব্যাপার, তাই না?
কিন্ত দুঃখের ঘটনাটি হল— এই সাংস্কৃতিক মহাসংঘ যার ভিত্তিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল এক রাজনৈতিক যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল তার মাত্র ৬৫ বছরের মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করা শুরু হয়েছে। এখন সাম্প্রদায়িক শক্তি বলতে আরম্ভ করেছে যে, চৈত্র মাসের নববর্ষই নাকি একমাত্র সাচ্চা হিন্দু নববর্ষ। এই বিষয়ে ঢোকার আগে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বাংলার নতুন বছরের আদি কাহিনি।
৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা শশাঙ্কের আমলে সূর্যসিদ্ধান্ত মতে পয়লা বৈশাখ পালন শুরু হয়েছিল। কিন্ত আমরা সঠিক বলতে পারব না এই গণনাকে সাধারণ মানুষ কতখানি মানত বা পালন করত। পয়লা বৈশাখ প্রথাকে সত্যি জনপ্রিয় আর বাধ্যতামূলক করার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিঃসন্দেহে মুঘল সম্রাট আকবরের এবং তাঁর জ্যোতির্বিদ ফতেউল্লাহ্ শিরাজির। চন্দ্রমতে নির্ধারিত হিজরি ক্যালেন্ডার দিয়ে কৃষির ফসল তোলার সময়ের হিসেব রাখা কঠিন ছিল, ফলে খাজনা তোলার সুবিধের জন্য একটা নতুন ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন হল : ফস্লি সন বা তারিখ-ই-ল্হালি। এটি ছিল সৌর ও চান্দ্র গণনার সংমিশ্রণ। ধর্ম ও সংস্কৃতির আড়ালে থাকে অর্থনীতি আর তা স্পষ্ট বোঝা যায় যখন আমরা দেখি কত লক্ষ হালখাতা এই দিনে খোলা হয়, কত পুজো আর মন্ত্র দিয়ে। লক্ষ্মীর মন্দির বেশি না থাকায় কালীবাড়িতেই হাজার হাজার ব্যবসায়ী ভিড় করে ভোরের আগে থেকে আর লাইনের ঠেলা সামলানো মুশকিল হয়। পশ্চিমবঙ্গে যতই নতুন পোশাক পরুক আর ঘর রঙ করুক সকলেই জানে যে এই উৎসবটি প্রধানত ব্যবসায়ীদের। তাঁরা এ দিন দ্বার খুলে সকলকে মুক্ত হস্তে মিষ্টিমুখ করায় আর এই কারণে দোকানে ভিড়ও উপচে পড়ে।
আরও পড়ুন-বঙ্গাব্দ মানে বাদশাহি পাঞ্জা
ওপার বাংলায় কিন্ত এই উৎসবের চরিত্র একদম আলাদা। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না ওদের পয়লা বৈশাখের কত জনপ্রিয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহি ও অন্যান্য শহরে লক্ষ লক্ষ লোক সুন্দর সেজে গান করে বা বাজনা বাজিয়ে এই বিশাল শোভাযাত্রায় একত্রিত হয়। এই মহামিছিলের সঙ্গে চলে সুসজ্জিত যানবাহন যার উপর থাকে আকাশছোঁয়া নানান রঙের বড় বড় বাঘ সিংহ ও অন্যান্য আকর্ষণীয় মুখ, মুখোশ বা কাগজ, কাপড়ের বানানো পুত্তলিকা। ইসলামিয়া চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে এটি হল এক অভিনব প্রতিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের এক নজিরবিহীন প্রতিবাদ। ১৯৮৯-এ রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা এই চমৎকার অহিংস প্রতিবাদ শুরু করেছিল। এখন সব মিলিয়ে এক কোটির কাছাকাছি সংখ্যার সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহণ করেন। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু বাণী দিয়ে রক্ষা করা যায় না, এর জন্যে মাঠে নেমে শত্রু-শক্তিকে দেখাতে হয় আমরা ভয় পাই না, আমার লড়তে জানি। কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই অনুষ্ঠানকে বিশ্বের প্রাণশক্তিপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিশেষ সম্মান দিয়েছে।
ফিরে আসা যাক সেই তথাকথিত হিন্দু নববর্ষে। গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে ভারতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীরা কী চেষ্টাই না চালিয়ে যাচ্ছে সব কিছুতে ধর্মের ছাপ দিতে। এই বছর বেশি করে তারা প্রচার করেছে যে চৈত্রের নববর্ষই আসল হিন্দু নতুন বছরের দিন। কারণ বোধহয় সংঘ পরিবারের উৎস ও প্রধান ঘাঁটি নাগপুরে এই দিবসটি বেশি মানা হয় সেই জন্যে। সে যা-ই হোক, গত ২ এপ্রিল সামাজিক গণমাধ্যমে ঘন ঘন প্রচার চলল এই মনগড়া হিন্দু নববর্ষের। এর থেকে আঁচ করা যায় যে প্রথম অবকাশেই ওরা এটা সবার ওপর চাপিয়ে দেবে। আর আঘাত করবে ভারতের বহুত্ববাদের গোড়ায়। এই প্রচেষ্টাকে আমাদের রুখতে হবে, নাহলে ওরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি আদর্শকে এক এক করে ধ্বংস করবে। কোনও দিন কল্পনাও করিনি যে নববর্ষের দিনও নোংরা রাজনীতির শিকার হবে।