নিজেকে সরাসরি ফিল্মি বলতে একেবারে বাধে না! চার পুরুষের ইঞ্জিনিয়ার পরিবারের ছেলে হয়েও স্কুলবেলা থেকেই সিনেমার পোস্টার দেখে আয়নার সামনে অভিনয় করতে সবচেয়ে মজা পেতেন। সময়ের সঙ্গে অভিনয়ের ব্যাপ্তি বেড়েছে। বর্তমানে অভিনয় ছাড়িয়ে কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত হয়েছে। সব নিয়ে ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে আড্ডা দিলেন প্রীতিকণা পালরায়
আরও পড়ুন-কলকাতায় ১৩৫টার বেশি আসন পেয়ে জয়ী হবে তৃণমূল কংগ্রেস, আত্মবিশ্বাসী অভিষেক
অভিনেতা হব এটা কি ছোট থেকেই ভাবতেন?
ভাস্বর : শুধু ভাবতাম না, ছোট থেকেই ‘বড় হয়ে কী হবি’ কেউ জিজ্ঞেস করলে, ‘অভিনেতা হব’, বলেও বেড়াতাম। স্কুল-কলেজে সুযোগ পেলেই অভিনয় করতাম। পড়াশোনা শেষে যখন চাকরিতে জয়েন করলাম, তখন থিয়েটারে যোগ দিলাম। এরপর থিয়েটার করতে করতেই একটা-দুটো করে সিরিয়ালে ডাক আসতে লাগল।
চাকরি তো তখনও চলছে? কোথায় চাকরি করতেন?
ভাস্বর : আমি চাকরি করতাম গ্ল্যাক্সো ফার্মাসিটিক্যালস-এ। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলাম। আমার প্রথম ধারাবাহিক বিষ্ণু পাল চৌধুরীর ‘কনকাঞ্জলি’। পাশাপাশি আরও কিছু কাজ পাচ্ছিলাম। দেখলাম দুটোর সময় একেবারে ম্যাচ করছে না, তখন ‘গ্ল্যাক্সো’র চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। একটা কল সেন্টারে চাকরি নিলাম। কল সেন্টারে নাইট ডিউটি করে সকালে অফিসেই স্নান সেরে রেডি হয়ে স্টুডিও চলে যেতাম।
অভিনয়ের প্যাশন এতটাই ছিল তার মানে?
ভাস্বর : হ্যাঁ। স্ট্রাগলিং পিরিয়ডটা এভাবেই চালিয়েছিলাম। এরপর যখন ‘ভগৎ সিং’-এর জন্য ডাক পেলাম, তখন ছ’মাস আমায় মুম্বই গিয়ে থাকতে হত। অতটা ছুটি আমায় কেউ দিত না। বাবা বলল, চাকরি ছেড়ে চলে যাও। এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। সেই চাকরি ছাড়লাম পুরোপুরি।
আরও পড়ুন-কারও জন্য দল বিন্দুমাত্র কলুষিত হলে তাঁকে বহিষ্কার স্পষ্ট জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
২৩ বছর কেটে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে? মোট ক’টা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন?
ভাস্বর : সেঞ্চুরি পার! ১১৬টা চলছে।
দীর্ঘ এই জার্নিতে কী কী চেঞ্জ দেখলেন ইন্ডাস্ট্রিতে?
ভাস্বর : এক-আধটা নয়, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আর আজ, প্রায় পুরো সিস্টেমটাই পালটে গেছে। ভাল-খারাপের কথা বলছি না কিন্তু, পালটে যাওয়ার কথা বলছি। প্রথমদিকে ডিরেক্টররাই ছিলেন শেষ কথা। ক্রিয়েটিভ পুরোটাই তাঁরা ডিসাইড করতেন। কাস্টিংও তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিতেন। প্রোডিউসাররা থাকতেন ব্যাক স্টেজ-এ। তাঁদের মূল কাজ ছিল শুধু সংশ্লিষ্ট চ্যানেল থেকে স্লট বের করা ও গল্প স্যাংশন করা। সেটা হয়ে গেলে বাকি সবটা এবার পরিচালকের ওপর ছেড়ে দিতেন তাঁরা। এরপর একটা সময় এল যখন প্রোডিউসাররা বেশি দায়িত্ব নিতে শুরু করলেন, অনেক ব্যাপারেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতেন। তাঁদের কাছের লোকেরা কাজ পেত তখন। এরপর কিছুদিন প্রোডাকশন ম্যানেজাররা ডিসিশন মেকার হয়ে উঠলেন। খানিক বছর বাদে এল প্রোগ্রামারদের যুগ। এটা অবশ্যই আমি আর্টিস্ট নির্ধারণের কথা বলছি। প্রোগ্রামাররা তখন প্রায় শেষ কথা কোন আর্টিস্ট নেওয়া হবে, কার কত ডেট হবে ইত্যাদি ব্যাপারে। এখন যে সিস্টেমটা চলছে, তাতে চ্যানেলই সর্বেসর্বা। প্রতিটা বিভাগের খুঁটিনাটি সবকিছুতে তারাই সিদ্ধান্ত নেয়, বাকিদের শুধু মেনে নেওয়া কাজ! আর ডিরেক্টররা এখন এক্কেবারেই ব্যাক সিট-এ। তাদের কাজ শুধু অ্যাকশন আর কাট বলা। এমনকী গল্প সম্বন্ধেও তাদের প্রপার কোনও ধারণা থাকে না অনেক সময়। আর প্রোডিউসারদের কাজ ফের শুধু সেই প্রোজেক্ট বের করে আনা আর প্রোডাকশন মিটিং অ্যাটেন্ড করা।
আরও পড়ুন- কারও জন্য দল বিন্দুমাত্র কলুষিত হলে তাঁকে বহিষ্কার স্পষ্ট জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
আপনার কি মনে হয় এই সিস্টেমটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য পারফেক্ট?
ভাস্বর : দেখুন, সব সিস্টেমেরই প্লাস-মাইনাস দুটো দিকই থাকবে। এখন যেমন পুরো সিস্টেমটাই অনেক বেশি অরগানাইজড। প্রত্যেকটা বিভাগেই নির্দিষ্ট প্রসেসে কাজ হয়। আগে সেটা এতটা ছিল না। চ্যানেল বসিং করে ঠিকই আবার দায়িত্ব নেয় বা ভরসা দেয় এটাও হয়। পারফর্ম করলে তার রেকগনিশনও দেয়। সব মিলিয়ে একটা কর্পোরেট কালচার আর কী! সিস্টেমও আছে আবার ইনসিকিউরিটিও আছে।
এবার আপনার কথায় আসি। তেইশ বছর আগে যাঁদের সঙ্গে শুরু করেছিলেন, তাঁরা আজ বাবা-কাকা-দাদার কিংবা মা-কাকিমার চরিত্রে। আপনি কিন্তু পজিটিভ হোক বা নেগেটিভ, এখনও প্রোটাগনিস্টের চরিত্রই করে যাচ্ছেন। এটা সম্ভব করলেন কী করে?
ভাস্বর : স্ট্রিক্ট রুটিন মেনটেন করে চলি। আর যাদের কথা বললেন, তাদের অনেককে অনেক সময় হতাশ হতে দেখেছি একঘেয়ে মেগার কাজ করতে করতে, এইটা আমি আমার মধ্যে চাপতে দিইনি। কারণ একঘেয়েমি পৃথিবীর প্রতিটা কাজের মধ্যেই তো আছে। আমার কাছে এখনও প্রত্যেকটা দিন নতুন শুরুর দিন। আর সিনেমা, সিরিয়াল সব মিলিয়ে যত ধরনের চরিত্র করেছি, তাতে আমার কোনও আক্ষেপ নেই জীবনে। আর আক্ষেপ নেই বলেই হয়তো তরতাজা থাকতে পারি।
রাজনীতি আর ইন্ডাস্ট্রি এখন মিলেমিশে গেছে। ভাস্বর কি ভাবছে রাজনীতি নিয়ে?
ভাস্বর : রাজনীতি আমি বুঝি না তাই সেভাবে কিছু ভাবি না। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে গত নির্বাচনে প্রচার করেছি। কারণ এটুকু বলতে পারি, এই সরকার আসার পর আর্টিস্ট ফ্রেটারনিটি অনেক সংঘবদ্ধ হয়েছে।
আরও পড়ুন-অকাল বোধন
রাজনীতি বোঝেন না কিন্তু সমাজসেবামূলক প্রচুর কাজ তো কয়েক বছর লাগাতার করে যাচ্ছেন? সেটা কোন ভাবনা থেকে?
ভাস্বর : এটা একেবারে আমার মায়ের জন্য। ২০১৭ তে মা চলে গেল যখন, প্রথম ভাবনায় এল মায়ের নামটা বাঁচিয়ে রাখব কীভাবে। মায়ের নামেই একটা ফাউন্ডেশন গড়লাম তাই। অপর্ণা ফাউন্ডেশন। প্রথমদিকে সবার থেকে পুরনো জামা কালেক্ট করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বা কলকাতারও কিছু অঞ্চলে বিলি করতাম। এরপর আমফানের সময় মেদিনীপুরের কিছু জায়গায় রিলিফ পাঠালাম। দ্বিতীয় ফেজ-এ লকডাউনের সময় মনে হল আমায় আরও বেশি ফিল্ড-এ নেমে কাজ করতে হবে। এই সময়টায় কলকাতার প্রচুর জায়গায় মাঝেরহাট ব্রিজ, কালীঘাট, হাজরা, বেহালা, নিউ আলিপুর, আলিপুর, বাইপাসের ভেতরদিকে অনেক অংশে, ধাপার কাছে বৃহন্নলাদের একটা গ্রামে গিয়ে সাধ্যমতো রিলিফ দিয়ে এসেছি। এছাড়া ‘বাগধারা’ ও সোনু সুদের সংগঠনের সঙ্গে মিলে রেড লাইট এরিয়াতে গিয়েও তাদের কিছু রিলিফ, পুজোর সময় তাদের বাচ্চাদের নতুন জামাকাপড় দেওয়া এগুলো করেছিলাম। ভাইফোঁটায় আবার গিয়ে আমি ভাইফোঁটা নিয়ে আসি।
ভাস্বর তার মানে নানা রূপে উজ্জ্বল?
আরও পড়ুন-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রেমের ছবি
ভাস্বর : চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সাধ্যমতো মানুষ হিসেবে বাঁচার সার্থকতা পেতে। যাদের জন্য করা তাদের মনে উজ্জ্বল থাকতে পারলেই সবচেয়ে বড় পাওয়া।