ভ্রাতৃদ্বিতীয়া কোনও ধর্মীয় উৎসব নয়

ধর্ম পরিচয়ের বেড়া ভাঙা উৎসব হল ভাইফোঁটা। এই উৎসব জুড়ে বিরাজ লোকাচারের। এই উৎসব আরও বেঁধে বেঁধে থাকার উৎসব, ভাঙনের কালে, বিভাজনের প্রহরে জড়িয়ে থাকার উৎসব, এক হয়ে মিলেমিশে থাকার বার্তাবহ উৎসব। লিখছেন ড. মইনুল হাসান

Must read

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’। আমার অনেকদিন থেকে মনে হচ্ছে সংখ্যাটা বেড়ে গিয়েছে। তা যাক। বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। উৎসব মানে মিলন, উৎসব মানে জমায়েত, উৎসব মানে মনের আদান-প্রদান। আবার উৎসব মানে সংস্কৃতির বিনিময়। বাংলায় কোনও উৎসবই জাত, ধর্মের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ থাকে না। আকাশে- বাতাসে সমন্বয় তথা মিলনের সুর বাজে। বিজয়া দশমী শেষ। শেষ দীপাবলির আলোর রোশনাই। আমাদের হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে ভালবাসার আলো। জ্বেলেছে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের আলো। এভাবেই বাংলার উৎসব সার্থক হয় কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ।

আরও পড়ুন-উসকানির দায় কেন নেবে না সিপিএম ও এক শ্রেণির মিডিয়া

দীপাবলি শেষ হয়েই চলে এল ভাইফোঁটা। এটাই আবার উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকায় দার্জিলিং বা কার্শিয়াংয়ে ‘ভাইটিকা’। কালীপুজোর অমাবস্যা তিথির দু’দিন পর কার্তিক মাসের দ্বিতীয়ার দিন বাঙালি মিলিত হবে ভাইফোঁটায়। একান্নবর্তী পরিবার আর নেই। এখন পরিবার ছোট হতে হতে পরমাণু পরিবার। বাড়িতে একটা, খুব জোর দুটো সন্তান। একসঙ্গে থাকার আনন্দ শেষ হতে হতে অন্তর্হিত। আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় পিসিমণির বিছানায় আমাদের ৮/১০ বাচ্চার শোয়ার ব্যবস্থা হত। অতবড়, ঘরজোড়া বিছানা আজও আমি কোথাও দেখিনি। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল কে পিসির কত কাছে শোবে। এখন আমাদের সন্তানদের কাছে সেটা প্রস্তর যুগের কথা। সবার, ভাইবোনেদের একটা সন্তান। ভাইফোঁটা একদিনের জন্য একান্নবর্তী পরিবারের স্বাদটা ফিরিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন-টার্গেট শিল্প সম্মেলন, প্রায় দেড় হাজার কোটি লগ্নি, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে শীর্ষে যেতে দৌড় শুরু রাজ্যের

এখানে কোনও পুরোহিত বা মৌলবি লাগে না। বোনেরা মন্ত্র পড়ে ভাইয়ের কপালে তিনবার ফোঁটা দেয়। কাঁসা বা পিতলের থালায় ঘি, চন্দন, দই ও কাজল রাখা হয়। রাখা হয় সকালের শিশিরবিন্দু। পাশে রাখা থাকে ধান-দুর্বা। শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে বোন উচ্চারণ করে মন্ত্র— ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা। যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা…।’ মন্ত্রটা সব জায়গায় একরকম হবে তা নয়। একটু এদিক-ওদিক হতে পারে। তবে মূল বিষয় হল ভাইয়ের মঙ্গল কামনা। এই পবিত্র সম্পর্ককে দৃঢ় বন্ধনে স্বীকার করার মধ্যে একটা অনাবিল তৃপ্তি ও আনন্দ আছে। ধ্বনি, তা শাঁখ বা উলু, তখন এক পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করে। তার তুলনা বিশ্বব্যাপী সন্ধান করেও পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন-এক লাখের সুপারি, স্বীকার করল ধৃত

বাঙালির জীবনের সঙ্গে ভাইফোঁটা জুড়ে গিয়েছে। ধর্ম পরিচয়ের বেড়া ডিঙিয়ে তা সর্বজনীন আকার নিয়েছে বহু আগে। হিন্দু বোন মুসলমান ভাই বা দাদার কপালে ফোঁটা দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছে। তার উলটোও আছে বহু বহু ক্ষেত্রে। মুসলমান বাড়ির মেয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন তার দাদা ফিরবে বিদেশ থেকে ফোঁটা নিতে। সে হিন্দু। তাতে কী? আজ এই তিথিতে মিলনের উৎসবে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা ছাড়া কোনও ইচ্ছা নেই। আজ ভাইফোঁটা! তবুও উল্লেখ করি এই পার্বণের বুকের ভিতর একটি ছোট পৌরাণিক গল্প আছে। পুরাণ মতে যম ও কন্যা যমুনা যমজ ভাইবোন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছিল গভীর স্নেহ-ভালবাসা। যম তো মৃত্যুর দেবতা। তিনি তো সকলের মরণ-বাঁচনের নির্ধারক, সেখানে তাঁর অমরত্ব কামনায় যমুনা কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমের কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন। সেটাই ‘যম দ্বিতীয়া’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে। পঞ্জিকাতেও ‘যম দ্বিতীয়ার’ কথা লেখা থাকে। আমরা তো দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা— একাজে আমাদের কোনও জুড়ি নেই। পৃথিবীতে, বিশেষ করে বাংলায় আমাদের বাংলার বোনেরা ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ফোঁটা দিতে শুরু করলেন। আর একটা মত হচ্ছে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টিমুখ করান। তারপর ভাইফোঁটা উৎসব হিসাবে চালু হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

এ তো গেল অনেক বড় কথা। বাংলার বোনেদের কড়ে আঙুল কবে থেকে ভাই বা দাদার কপালে উঠল তার হালহকিকত আমাদের জানা দরকার। একই লোকাচারের শুরুর দিনের খোঁজ পাওয়া সহজ কাজ নয়, তবে এর প্রচীনত্ব নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ‘সবানন্দ সুন্দরী’ বলে এক তালপাতার পুঁথিতে এমন উৎসবের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে বোঝা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ সাল থেকে এই প্রথা চালু হয়ে আসছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মহাবীর জৈনের প্রয়াণে রাজা নন্দিত বর্ধনের শোকবিহ্বল বোনকে সান্ত্বনা দিতে অন্নগ্রহণ করানো হয়। সেই থেকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার প্রথা চালু হয়।

আরও পড়ুন-প্রয়াত সাহারা গ্রুপের স্রষ্টা সুব্রত রায়

আগেই বলেছি পরমাণু পরিবারে আগের একান্নবর্তী পরিবারের আস্বাদ পাওয়া যাবে না। কিন্তু ভাইফোঁটা একদিন আমাদের এক অনাবিল ভাসিয়ে দেবে— সব বাধাকে ছিন্ন করে ভালবাসা বড় হয়ে উঠবে। বোন সাজিয়ে দেবে নানারকম মিষ্টির পশরা। আর হঠাৎ দাদা/ভাই লুকিয়ে রাখা উপহার তুলে দেবে বোনের হাতে। বাড়িতে তখন হাসির ছররা। এ আনন্দের স্বাদ বাঙালির জীবনকে গড়ে দেয় সামনের দিকে, যা অপেক্ষা করছে সকলের ভাল চিন্তা, ভাললাগা হয়ে।

আরও পড়ুন-প্রয়াত পাহাড়ের লেপচা বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াংসং তামসাং, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

আজকের শত ব্যস্ততার মধ্যে ভাই-বোন মিলে এই উৎসব পালন করতে চায়। অনেক সময় হয় না। বাড়ির চৌকাঠে ফোঁটা দেয়, অথবা নারকেলের মালাতে, অথবা দেওয়ালে। এই দিনে বোনকে চোখ ফেলতে নেই। কিন্তু তার বুক মুচড়ে ব্যথা জাগে। কিন্তু বিশ্বাস করে প্রবাসী দাদা একদিন এসে এই ফোঁটাগুলো দেখবে। বোন ছাড়া আর কে এ কাজ করতে পারে? বাঙালির জীবনে তাই ভাইফোঁটার এত আদর।
কবি বলেছেন বেঁধে বেঁধে থাকতে। ভাইফোঁটা বন্ধনের উৎসব। আমার বোন নেই। দিদি নেই। কোথায় থাকি তার ঠিক নেই। তাতে কী? কোনও অসুবিধা নেই। ঘরে ঘরে বোন-দিদিরা অপেক্ষা করে আমাকে ফোঁটা দেবে বলে। ছোটবেলায় মালতীদির কাছ থেকে ফোঁটা নিয়ে আমার ভাইফোঁটার কাল শুরু হয়েছে। আর আমার মায়ের সেই ঘোষণা—‘‘ভাইফোঁটার আবার হিন্দু-মুসলমান কী?’’ আমার জীবনের ভিত তৈরি করে দিয়েছে। কোনও ধর্ম উৎসবে, আদরে, আহারে, আনন্দে বাধা হতে পারে না। সারা বাংলায় বোনেরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দেবে। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ভাই/দাদা অশুভের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়যুক্ত হবে। জয় বাংলা।

Latest article