স্বাধীনতা দিবসের সকালটি কালিমালিপ্ত হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী তার ৮৩ মিনিটের অসার ভাষণ শেষ করার পরেই খবর পাওয়া গেল বিলকিস বানো (Bilkis Bano Case) ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ১১ জনকেই গুজরাট সরকারের পরামর্শক্রমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরেই আরএসএস-ঘনিষ্ঠ সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হল। মালা পরিয়ে লাড্ডু খাওয়ানো হল।
এমন হাড়হিম করা ভয়াবহ কাণ্ড বহুকাল ভারতবাসী শোনেনি। ২০০২ সালে গোধরা অগ্নিকাণ্ডের পর সারা গুজরাট জুড়ে একতরফা মুসলমানদের উপর আক্রমণ হয়। সরকারি তথ্য যা-ই বলুক না কেন, হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা, প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরি-সহ তাঁর বাড়িতে আশ্রয়প্রার্থী ৫৯ জনকে হত্যা করা হয়। জাফরি ২০০টি ফোন করেছিলেন পুলিশ, প্রশাসন, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীকে। কোনও সাহায্য পাননি।
বিলকিস (Bilkis Bano Case) বানো প্রাণভয়ে তাঁদের আত্মীয়স্বজন-সহ অন্য কোথাও আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ রক্ষা হয়নি। ঘাসের মধ্যে লুকানো অবস্থায় তাঁকে ও আত্মীয়স্বজনকে টেনে বের করা হয়। একই জায়গায় ১৭ জনকে খুন করা হয়। বিলকিস গণধর্ষণের শিকার হন। তখন তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাত্র ২১ বছর বয়স। সঙ্গে ৩ বছরের শিশু। বাচ্চাটিকে পাথরে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলা হয়। বিলকিস মৃত মনে করে গুন্ডারা পালিয়ে যায়। এরা সবাই বিলকিসের প্রতিবেশী ছিল। কেউ ছিল ‘ভাই’ অথবা ‘চাচা’। কিন্তু এমন হিংস্রতা দেখিয়েছিল যা নজিরবিহীন।
আরও পড়ুন: রাজ্য সরকারের গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কর্মীদের সুবিধার জন্য ব্যবস্থাগ্রহণ
হাসপাতালে গ্রামবাসীরা বিলকিসকে নিয়ে যায়। চিকিৎসায় বেঁচে যায়। থানা কোনও অভিযোগ নিতে চায়নি। বহু কাগজপত্র নষ্ট করে দেয়। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যান বিলকিস। গুজরাটে ভয়ে থাকতে না পেরে মুম্বই চলে যান। দীর্ঘ আইনি লড়াই-এর পর নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে বিলকিস জেতেন। ভারত জেতে। সিবিআই এই মামলায় বলেছিল ‘এটা বিরল থেকে বিরলতম’ ঘটনা। তেমন যেন রায় হয়। ১২ জন দোষী সাব্যস্ত হয়। তাদের যাবজ্জীবন হয়। ১ জন এই সময় মারা যায়। গুজরাট সরকারকে কোর্ট নির্দেশ দেয় ৫০ লক্ষ টাকা, বাসস্থান ও চাকরি দিতে হবে বিলকিসকে। টাকা দিলেও চাকরি ও বাসস্থান কিছুই দেয়নি।
কেন ধর্ষকরা মুক্তি পেলেন? ১ জন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে যে, ১৫ বছর সাজা খাটা হয়ে গেছে। এবার এদের মুক্তি দেওয়া হোক। আদালতের পক্ষ থেকে গুজরাট সরকারের মতামত জানতে চাওয়া হয়। রাজ্য সরকার একটা কমিশন তৈরি করে। তার মধ্যে ২ জন বিজেপি বিধায়ক। কোনও অপরাধ-বিজ্ঞানী ছিলেন না। অন্যরা সরকারি আধিকারিক। বিধায়কের কথায় তাঁরা সবাই ঘাড় নাড়বেন এটা স্বাভাবিক। তাই হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের আইন হচ্ছে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ‘মার্সিপিটিশন’ গ্রাহ্য হবে না। তাকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে বিলকিস বানো মামলায় এই আইন প্রযোজ্য নয়। কেন? কোনও উত্তর নেই। এক্ষেত্রে মুক্তির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। সেটা কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছিল— অথবা দেয়নি তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী তেরঙা পতাকা উড়িয়ে বললেন— নারীদের সম্মান রক্ষা করতে হবে। এ-ব্যাপারে আপস করা যাবে না। আর সেদিনই বিলকিস বানোর (Bilkis Bano Case) ধর্ষকরা মুক্তি পেয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর কথায় ও কাজে যে কোনও মিল নেই তা আর একবার প্রকাশিত হল।
একজন উঁচু মাপের বিজেপি নেতা বেশ উচ্চ স্বরে বলেছেন— ওদের (ধর্ষক) আটকে রাখা যাবে না। কারণ তারা ব্রাহ্মণ। বিজেপির আমলে এটাই এখন তাহলে আইন হয়েছে! ব্রাহ্মণদের জন্য একরকম, মুসলমানদের একরকম, দলিতদের জন্য আর একরকম। তাই বিলকিস বানোর ধর্ষকরা ছাড়া পেয়ে যাবেন। সিদ্দিকি কাপ্পান বিনা দোষে ২ বছরের বেশি সময় জেলে থাকবেন। জামিন পাবেন না। রাজস্থানের জালোর-র বাচ্চাটি দলিত বলে খুন হবে। এটাই এখন স্বাধীন ভারতের ঠিকানা হয়েছে? যে ভারত তৈরি করছে নরেন্দ্র মোদি। যেখানে সংবিধানে থাকা অধিকার লাগু নয়।
আমার মনে হয়, কেন বিলকিস বানোর ক্ষেত্রে এমন হল? তিনি কি মহিলা বলে, না মুসলমান বলে? আমার মনে হয় দু’টোই সত্যি। কারণ নরেন্দ্র মোদির দল কোনও সময় মহিলাদের সম্মান করে না। মুখে যা বলে কাজে তা মান্য করে না। স্বাধীনতা দিবসে নারীদের নিয়ে ভাষণ আর সেই দিনই বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি এ-কথাই প্রমাণ করে।
আর মুসলমান? সে কথা বলাই বাহুল্য। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন পোশাক দেখে বোঝা গেছে কারা বা কে? বাড়িতে গরুর মাংস আছে এই মিথ্যা অজুহাতে আখলাক খুন হয়েছে। লম্বা ঝুলের পোশাক ও মুখে দাড়ি আছে বলে তরুণ জুনায়েদ খুন হয়েছে। আরএসএস-এর গৃহীত ও লিখিত তত্ত্ব হচ্ছে স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। সুতরাং ধর্ষকরা মুক্তি পাবে। কারণ তারা শুধু হিন্দু নয়, উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ। বছর শেষে গুজরাট ভোট। জাতপাতই হবে লড়াইয়ের একমাত্র অস্ত্র। ধর্মের জিগির ছাড়া মোদি সরকারের জেতার কোনও রাস্তা নেই।
খুনি ও ধর্ষকদের মুক্তি আমাদের কাছে এবং সারা বিশ্বে এক নতুন বার্তা এনেছে। নরেন্দ্র মোদি সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার স্বীকার করে না। যে-দেশে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ, মৌলানা আজাদ জন্মেছেন, যে-দেশের স্বাধীনতার জন্য ক্ষুদিরাম, আশফাকুল্লাহ খানরা ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন, যে-দেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে— সে-দেশে বিচারের বাণী নীরবে কাঁদছে। শিশুসন্তানকে মায়ের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবে, অসহায় নারীকে ধর্ষণ করবে— তারপর ধর্ষকরা মুক্তি পাবে না। আমি বিশ্বাস করি এটা ভারতের ঠিকানা নয়। দেশকে নতুন ঠিকানা আমাদের দেবার সময় উপস্থিত। আমরা বিলকিস বানোর পক্ষে আছি।