যিনি সমগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন, বিপদ নাশ করেন, তিনি বিপত্তারিণী মা। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া থেকে দশমী পর্যন্ত এই পুজো করা হয়ে থাকে। আরও সঠিক করে বললে আষাঢ় মাসের রথযাত্রা থেকে উল্টোরথের মধ্যে যে শনি ও মঙ্গলবার পড়ে সেই দিনেই বিপত্তারিণী ব্রত করা হয়। জনমানসে সুদীর্ঘকাল থেকে এই বিশ্বাস যে, এই ব্রত পালন করলে সংসারের সব বিপদ কেটে যায়।
আরও পড়ুন-ফ্রক পরিহিতা অমলা
বিপত্তারিণীর মাহাত্ম্যকথা নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনি। বিদর্ভের রাজা ছিলেন সত্যদাস। তাঁর পুত্র অলোকেশ একদিন মৃগয়া করতে বেরিয়ে পথ ভুল করে পাশের রাজ্য অবন্তিপুরে ঢুকে পড়েন। সে জায়গাটি ছিল মূলত অবন্তিরাজের মৃগয়াক্ষেত্র। সেখানে একটি হরিণ শিকার করলে রাজার সেনারা তাঁকে বেঁধে নিয়ে যায়। চক্রধর ছিলেন সেই সময় অবন্তির রাজা। রাজা তো বেজায় ক্রুদ্ধ। খবর পেয়ে বিদর্ভের রাজা সত্যদাস ছুটে গেলেন। কিন্তু বন্দি হলেন তিনিও। রাজা ও রাজপুত্রের অর্থাৎ স্বামী ও সন্তানের বন্দি হওয়ার খবর পেয়ে রানি রত্না ভেঙে পড়েন। এবং দেবীর পুজোর আয়োজন করেন। সেই দিনটা ছিল রথযাত্রার পরের মঙ্গলবার। রানি দেবীর শরণাগত হয়ে স্তব করে স্মরণ করতে লাগলেন এবং সংকল্প করেন এই সংকট থেকে দেবী উদ্ধার না করলে অর্থাৎ মায়ের কৃপা না হলে দেহত্যাগ করবেন তিনি। আকুল প্রার্থনায় সেই রাতেই অবন্তির রাজাকে স্বপ্ন দেন মা বিপত্তারিণী। ‘‘অবিলম্বে মুক্ত কর বন্দিদের। কেননা, এরা আমার পরম ভক্ত। আমি এতে কষ্ট পাচ্ছি।’’ দেবীর আদেশের পর দু’জনেই মুক্তি পান। এরপর সত্যদাসের সঙ্গে নিজের কন্যার বিয়ের প্রস্তাবও দেন তিনি। দুই রাজ্যের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়। দেবীর কৃপায় শান্তি ফেরে দুই রাজ্যে।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতের প্রচারে কাল কোচবিহারে মুখ্যমন্ত্রী
আজও তাই বাংলার ঘরে ঘরে সুখ, শান্তি ও বিপদ কাটাতে মা বিপত্তারিণীর আরাধনা করা হয়। এই থেকেই বিশ্বাস যে, বিপদে অভয়দাত্রী এই মা। এই ব্রত পালনে সুখ-সমৃদ্ধি শান্তি বজায় থাকে।
বিপত্তারিণীর রূপের সঙ্গে দেবী শঙ্কটার রূপের সাদৃশ্য রয়েছে। কোথাও তিনি শঙ্খচক্র, শূল ও আসিহস্তা, স্বর্ণবর্ণা, ত্রিনয়নী। কোথাও তিনি খড়্গহস্তা, বরাভয়দায়িনী, ঘোরকৃষ্ণা।
মার্কেণ্ডেয় পুরাণে এই পুজোর বিধি-বিধান রয়েছে। তেরোটা ফল, তেরোটা ফুল, তেরোটা পান-সুপারি ও তেরোটা নৈবেদ্য দানের কথা বলা হয়েছে। ১৩ গাছা লালসুতোতে ১৩ গাছা দূর্বা দিয়ে ১৩টি গিঁট বেঁধে ধাগা তৈরি করতে হয়। ব্রাহ্মণ দ্বারা আম্রপল্লব-সহ ঘটস্থাপন করে নাম-গোত্র সহযোগে পুজো দেন বাঙালি মেয়েরা। পুজোর পরে শোনা হয় বিপত্তারিণীর ব্রতকথা। জবা ফুল এই পুজোর বিশেষ অঙ্গ। লাল সুতোর ধাগা পুরুষদের ডান এবং মহিলাদের বাম হাতে ধারণ করা এই পুজোর নিয়ম। বিপত্তারিণী ব্রত সাধারাণত মহিলাদের ব্রত। এই ব্রত শুরু করলে পরপর অন্তত ৩ বছর পালন করার নিয়ম রয়েছে। ব্রত পালনের দিন চালের কোনও খাবার বা পোড়া— যেমন ভাত, চিঁড়ে, মুড়ি, রুটি ইত্যাদি খাওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
মা বিপত্তারিণী বাংলার এক লৌকিক দেবী। পুজো নিয়ে রয়েছে প্রচলিত নানান কাহিনি। এখন যে ঘটনার কথা লিখব, সেই ঘটনার পটভূমি মল্লভূম রাজবংশ। পরাক্রমশালী মল্লরাজারা সপ্তম শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত একটানা বিষ্ণুপুর শাসন করেছিলেন। নবম রাজবংশেরই এক রাজার পত্নী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা।
রানি নিষ্ঠা সহকারে বিপত্তারিণী ব্রত পালন করতেন। সামাজিক বৈষম্য থাকলেও এক মুচি বউ তাঁর বান্ধবী ছিলেন। মাঝেমধ্যে খুশি হয়ে উপহারস্বরূপ রানি এটা-সেটা দিতেন। ফল-মিষ্টিও থাকত তার মধ্যে। সেই মুচি-বউয়ের আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল প্রখর। তিনিও তাঁর সাধ্যের মধ্যে সামান্য কিছু রানিকে দিতে চাইতেন। রানি বলতেন, যথাসময়ে চেয়ে নেবেন তিনি। সেই মুচিনীরা গোমাংস খেতেন। রাজরানির ভীষণ কৌতূহল হল গোমাংস দেখবার। বললেন, ‘‘সই, তোরা তো গরুর মাংস খাস, একদিন এনে আমায় দেখাস তো!’’
আরও পড়ুন-আরও ৩১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে!
মুচি-বউ তো মহাখুশি। বাড়ি ফিরে খুব যত্নে গরুর মাংস রান্না করে এনে রানিকে দিলেন। রানি কাপড় চাপা দিয়ে রেখে দিলেন।
এদিকে, এক চাকর গিয়ে রাজাকে মুচিনীর মাংস আনার কথা বলে দিল।
রাজা ছিলেন পরম ধর্মিক ও শুদ্ধাচারী। অত্যন্ত রেগে রাজা ছুটে এলেন। মুচিনীর দেওয়া জিনিস দেখতে চাইলেন। শুধু তাই নয়, তিনি এ-ও ফরমান জারি করলেন আপত্তিকর কিছু থাকলে রানির মুণ্ডচ্ছেদ হবে।
ভয়ে আধমরা হয়ে রানি একমনে বিপত্তারিণী মাকে স্মরণ করে যেতে লাগলেন— ‘‘বিপদ থেকে উদ্ধার করো মাগো’’। রাজামশাই যখন মুচিনীর দেওয়া উপহার খুলে দেখলেন, দেখা গেল কিছু লাল টুকটুকে জবাফুল পড়ে আছে। মা বিপত্তারিণীর কৃপায় রানি সে-যাত্রায় রক্ষা পান এবং নিষ্ঠাভরে বাকি জীবন এই ব্রত পালন করেছিলেন। পৌরাণিক অনেক তথ্য পাওয়া যায় এই পুজোকে ঘিরে।
আরও পড়ুন-পাটনায় বৈঠকের পর কী জানালেন দলনেত্রী
যুদ্ধের আগে পাণ্ডবদের বিপদ ও নিজের বৈধব্য প্রতিরোধের জন্য দ্রৌপদী গৌরীর আরাধনা করেছিলেন। যুদ্ধে স্বামীর জীবন রক্ষায় তাঁদের হাতে তেরোটি লাল সুতো বেঁধে দিয়েছিলেন। আজও সেই হিসেবে ত্রয়োদশ গ্রন্থি-যুক্ত ডোর ধারণ করা হয়।
পুরাণের আরও একটি কাহিনি অনুযায়ী, একদিন মহাদেব দেবী পার্বতীকে কালী বলে উপহাস করেন। এতে দেবী ক্ষুব্ধ হয়ে তপস্যার মাধ্যমে নিজের কৃষ্ণবর্ণা রূপ পরিত্যাগ করেন। পার্বতীর অঙ্গ থেকে সৃষ্টি জয়দুর্গা বা কৌশিকী দেবী, বিপত্তারিণী দুর্গা।
দেবীর অনেক রূপ দেখা যায়।
আরও পড়ুন-তলিয়ে গিয়েছে টাইটান ডুবোযান, ৫ যাত্রীর মৃত্যু
উত্তর ভারতে অষ্টাদশ রূপের ধ্যান পুজো করা হয়। কোথাও দশভুজা কোথাও আবার কৃষ্ণাবর্ণে পূজিতা হন দেবী। আজও চারদিন ধরে পুজোপাঠ চলে ধুমধাম সহকারে। বাংলা লোকগান ভজন-কীর্তন পালা গান চলে প্রথা অনুসারে। ভক্তরা লাল পবিত্র সুতো ও দূর্বা বাঁধে।
মহামায়া মহাশক্তির একশো আটটা রূপের এক রূপ হল বিপত্তারিণী মায়ের রূপ। কলকাতায় রাজপুরে বিপত্তারিণী চণ্ডীর বড় মন্দির রয়েছে। সেখানে মহাসমারোহে বিপত্তারিণী মায়ের পুজো হয়।