মুঘলসম্রাজ্ঞী মুমতাজ। সবদিকে ছিল তাঁর নজর। একদিন তিনি ব্যারাকে গিয়েছিলেন সৈনিকদের অবস্থা দেখতে। কিন্তু তাদের ভগ্নস্বাস্থ্য দেখে তিনি রীতিমতো হতাশ হয়ে যান। এমন চেহারা নিয়ে এরা দেশকে রক্ষা করবে কী করে! ডেকে পাঠান সেনাবাহিনীর বাবুর্চিকে। নির্দেশ দেন, চাল, ঘি এবং মাংস দিয়ে বানাও এমন এক খাবার, যেটা খেয়ে সৈনিকরা হয়ে উঠবে সুস্থ-সবল!
সেই আদেশ মেনেই বাবুর্চি তৈরি করেন এক সুস্বাদু অথচ পুষ্টিকর খাবার। বর্তমানে যেটা পরিচিত বিরিয়ানি নামে। মুঘলদের আমলেই এই খাবার প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে।
আরও পড়ুন-আধ্যাত্মিকতা সামাজিকতা ও অর্থনীতির সুষম মেলবন্ধন এই কোরবানি
আছে ভিন্ন মতও। অনেকেই মনে করেন, কোনও এক বিদেশি মুসলমান শাসকের হাত ধরে উত্তর ভারতে এসেছিল বিরিয়ানি। কিছু মানুষের ধারণা, উত্তর ভারতে নয়, দক্ষিণ ভারতেই বিরিয়ানির উৎপত্তি। বিশেষত হায়দরাবাদে।
মতের পিছনে না দৌড়ে বিরিয়ানি শব্দের উৎসের দিকে নজর দেওয়া যাক। বিরিয়ানি আসলে একটি উর্দু শব্দ। এসেছে ফারসি থেকে। ফারসি ভাষায় বিরিঞ্জ-এর মানে চাল বা ভাত। ফারসি শব্দ বিরিয়ান থেকেও আসতে পারে বিরিয়ানি শব্দটি। যার অর্থ ভেজে নেওয়া। বিরিয়ানি রান্নার আগে ঘি দিয়ে সুগন্ধীচাল ভাল করে ভেজে নিতে হয়। তাই হয়তো এইরকম নামকরণ।
আরও পড়ুন-ফের দুর্গামার রান্নাঘরে পাঁচ টাকায় ভরপেট
কলকাতার সঙ্গে বিরিয়ানির সম্পর্ক আজকের নয়। অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের হাত ধরে বিরিয়ানি প্রথম এসেছে কলকাতায়। জানা যায়, ১৮৫৬ সালে অওয়ধ ছেড়ে তিনি কলকাতায় পা রাখেন। নবাব ছিলেন নৃত্য এবং সংগীতের অনুরাগী এবং অত্যন্ত ভোজনরসিক। খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। বিরিয়ানি ছিল তাঁর খুব প্রিয়। তাঁর সুবাদেই কলকাতা তথা বাংলা পেয়েছে প্রথম বিরিয়ানির স্বাদ।
আজও নবাব পরিবারের যেকোনও উৎসব-অনুষ্ঠান অঙ্গন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিরিয়ানির সুঘ্রাণে। এই পরিবারের বর্তমান বংশধর শাহেনশাহ মির্জা জানালেন, ‘নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ছিলেন আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার। কলকাতার সঙ্গে তিনি শুধুমাত্র বিরিয়ানির পরিচয় করাননি, পাশাপাশি পরিচয় করিয়েছিলেন বিভিন্ন ধরনের অওয়ধি খাবারের। তবে সবথেকে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল বিরিয়ানি।’
আরও পড়ুন-মুঘলদের রান্নাঘর
এখন কিছু কিছু জায়গায় বিরিয়ানিতে ডিম দেওয়া হয়। এটা অপছন্দ শাহেনশাহ মির্জার। বললেন, ‘বিরিয়ানিতে ডিম একেবারেই অওয়ধি ঘরানার সঙ্গে যায় না। আমরা মনে করি ডিম দিলে বিরিয়ানিকে অসম্মান করা হয়। বিরিয়ানিতে দেওয়া হয় পরিমাণমতো মশলা। মশলা বেশি বা কম হলেই স্বাদ নষ্টের সম্ভাবনা থাকে। ডিমের চড়া গন্ধও বিরিয়ানির স্বাদের হেরফের ঘটায়। এই গন্ধটা বিরিয়ানির সঙ্গে একেবারেই ম্যাচ করে না। ফলে বিরিয়ানির আসল মজাটা হারিয়ে যায়।’
অওয়ধি ঘরানার বিরিয়ানির অন্যতম বৈশিষ্ট্য আলুর ব্যবহার। এটা চালু হয়েছিল নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সময়েই। এই প্রসঙ্গে শাহেনশাহ মির্জা বললেন, ‘কেউ কেউ মনে করেন, একটা সময় নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই খরচ কমাতেই তিনি বিরিয়ানিতে মাংসের বদলে আলুর ব্যবহার চালু করেন। এটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। তাঁর রাজ্য অওয়ধ ব্রিটিশ অধিকারে চলে যাবার পরে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। বসবাস শুরু করেন মেটিয়াবুরুজে। সেইসময় ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি পেনশন পেতেন। তখনকার দিনে বছরে ১২ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে ৩ লক্ষ টাকা তিনি খরচ করতেন চিড়িয়াখানায়। ফলে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর আর্থিক অবস্থা মোটেও খারাপ ছিল না। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কেন আলুর ব্যবহার? আসলে তিনি সবকিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন। একবার এক বাবুর্চি বিরিয়ানিতে আলু মিশিয়ে ছিলেন। সেটা খেয়ে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের খুব ভাল লেগে যায়। তারপর তিনি বাবুর্চিকে নিয়মিত বিরিয়ানিতে আলু মেশানোর পরামর্শ দেন। মনে রাখতে হবে, সেইসময় আলু ছিল খুব দামি। কারণ চাষ হত খুব কম। তখন থেকেই বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়।’
আরও পড়ুন-আইপিএলে উপরে ব্যাট করার সুবিধা পাচ্ছি: হার্দিক
ঈদের দিনে নবাব পরিবার নেয় বিরিয়ানির স্বাদ। শাহেনশাহ মির্জা জানালেন, ‘আমাদের ঈদ সেলিব্রেশন বিরিয়ানি ছাড়া ভাবাই যায় না। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সময় থেকেই সেই ধারা চলে আসছে। আমরা পছন্দ করি মাটন বিরিয়ানি। অওয়ধি বিরিয়ানির বিশেষত্ব হল, রান্না হয় দামি মশলা দিয়ে, খুব হালকা ভাবে। যাতে হয় সহজপাচ্য। বিরিয়ানির সঙ্গে দেওয়া হয় বোরহানি। এই বোরহানি হজমে সাহায্য করে। আমরা বিরিয়ানি হাত দিয়ে খেতেই পছন্দ করি। চামচ দিয়ে নয়। হাত দিয়ে খেলে অন্যরকম অনুভূতি হয়। তা ছাড়া খাবার কতটা গরম, বোঝা যায়।’
কলকাতা তথা বাংলার মানুষের মধ্যে বিরিয়ানিকে জনপ্রিয় করেছে যে-কয়েকটা রেস্টুরেন্ট, তারমধ্যে অন্যতম নিজাম’স। সংস্থার কর্ণধার সমর নাগ মনে করেন গত দশ বছরে বিরিয়ানির বিপ্লব ঘটে গেছে। কথায় কথায় জানালেন, ‘বিরিয়ানি এখন সারা দেশে দারুণ জনপ্রিয়। কলকাতাতেও। আমাদের রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় অওয়ধি ঘরানার বিরিয়ানি। সুগন্ধী, সুস্বাদু। এখন সবাই স্বাস্থ্য সচেতন। তেল-চপচপে খাবার এড়িয়ে চলেন। বিষয়টা মাথায় রেখেই সহজপাচ্য বিরিয়ানি তৈরি করা হয়।’
আরও পড়ুন-বিষমদ কাণ্ডে ধৃত ২২, মৃত্যু বেড়ে পাঁচ
ঈদের দিন ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষরাও বিরিয়ানির টানে নিজাম’স-এ ভিড় জমান। সমরবাবু জানালেন, ‘সব সম্প্রদায়ের মানুষ আমাদের এখানে আসেন। বিরিয়ানির স্বাদ নেন। বিশেষত যাঁরা পুরোনো কাস্টমার, তাঁরা তো নিয়মিত আসেন। আগে খুব কম সংখ্যক মানুষ বিরিয়ানি খেতেন। সেই ছবিটা এখন বদলে গেছে।
ঈদের দিনে বিরিয়ানির পাশাপাশি সবাই জমিয়ে খান কাবাব, চাঁপ ইত্যাদি। আসলে বাঙালির স্বভাব হল, যেকোনও উৎসবের মেজাজকে চেটেপুটে উপভোগ করা। ঈদেও আছি, বড়দিনেও আছি, আবার দুর্গাপুজোতেও আছি। এটা বাঙালির চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে। আনন্দ ভাগ করে নেবার ক্ষেত্রে কোনও কার্পণ্য দেখা যায় না।’
আরও পড়ুন-লিগে মোহনবাগান অনিশ্চিতই
চাইনিজ খাবার কি বিরিয়ানির জনপ্রিয়তায় থাবা বসিয়েছে? সমরবাবুর জবাব, ‘বিভিন্ন রকমের চাইনিজ খাবার এখন শহরে পাওয়া যাচ্ছে। তবে তার জন্য বিরিয়ানির জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বরং গত এক দশকে বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা প্রবল ভাবে বেড়েছে। কলকাতায় তো বটেই, মফস্সলেও। এখন মোড়ে মোড়ে বিরিয়ানির দোকান। আগে যেমন রোলের দোকান দেখা যেত। কিছুদিন আগেই বসিরহাট গিয়েছিলাম। যেতে যেতে রাস্তার একদিকে প্রায় ৮০টার বেশি বিরিয়ানির দোকান চোখে পড়ল। শান্তিনিকেতনে যাবার পথেও দেখেছি একই ছবি। এটাই প্রমাণ করে বিরিয়ানি আজ সর্বজনীন খাবার হিসেবে খাদ্যরসিকদের পাতে জায়গা করে নিয়েছে। চাইনিজ খাবার এখনও এর ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেনি। বাঙালির উৎসব, অনুষ্ঠানে এই মুহূর্তে বিরিয়ানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এটা দিন দিন বাড়ছে।’
আরও পড়ুন-নাইরোবি ফ্লাই: অসুস্থ শিশু
কারণ? সমরবাবু বললেন, ‘বিরিয়ানি অত্যন্ত সুস্বাদু, তাড়াতাড়ি রান্না হয়, হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিলে ঝটপট খেয়ে নেওয়া যায়, সহজেই পেট ভরে, পঞ্চব্যঞ্জন লাগে না। এতরকম সুবিধা। তাই গত দশ বছরে সারা দেশে বিরিয়ানির বিপ্লব ঘটে গেছে।’
কী হল, জিভে জল? তাহলে দেরি না করে চটপট চলে যান কাছাকাছি কোনও রেস্টুরেন্টে। উৎসবের দিনে প্রাণ ভরে নিন বিরিয়ানির স্বর্গীয় স্বাদ!