দৃশ্য এক : বৃহস্পতিবার সকাল ৭.১৫৷ সবে ভোট শুরু৷ হরিশ মুখার্জি রোড সংলগ্ন ৭১ নং ওয়ার্ড। মন্মথ প্রাইভেট স্কুল। মন্থর গতিতে এলেন এক অশীতিপর ভদ্রমহিলা। হাতে ভোটার স্লিপ। গেটে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় বাহিনীর দশাসই জওয়ান নিয়মমাফিক কাগজপত্র দেখে বুথে ঢোকার অনুমতি দিলেন। মিনিট দশেক বাদে বেরিয়ে এলেন৷ জিজ্ঞেস করলাম, মাসিমা সাত সকালেই ভোট দিতে এলেন? সপাট উত্তর, শোনো বাবা, বয়স ৮৪৷ এখনও যখন কারও সাহায্য ছাড়াই চলাফেরা করতে পারি তবে ভোট দিতে আসব না কেন? আর এটা আমাদের মমতার ভোট। এই কাঁসারিপাড়ায় বিয়ে হয়ে এসেছি সেই কবে৷ আজ সেটাও মনে পড়ে না। মমতাকে চোখের সামনে বড় হতে দেখেছি। ওকে ছাড়া কোনওদিন অন্য কাউকে ভোট দিইনি। যতদিন বাঁচব মমতাকেই ভোট দেব। নাম জিজ্ঞেস করায় বললেন, সুভাষিণী দত্ত। বলেই হাঁটতে শুরু করলেন৷ যাওয়ার আগে বলে গেলেন, দরকার হলে মমতাকে বুক পেতে দেব। মানুষকে ওর মতো কেউ ভালোবাসে না। কেউ ওর মতো এত ভাবে না, এত কাজ করে না।
আরও পড়ুন: কোন্দলে জেরবার কংগ্রেস, প্রশ্নে নেতৃত্ব
দৃশ্য দুই : সকাল ৮.৫৫। চেতলা গার্লস স্কুল। বাবা-মায়ের সঙ্গে ভোট দিতে এসেছে সৌমালি সাহা। এবারই প্রথম ভোট সৌমালির। নতুন ভোটার, তাই চোখমুখে উত্তেজনা। এমনিতে রাজনীতিতে আগ্রহ কম। কিন্তু পছন্দের রাজনীতিবিদ দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমালি রাজনীতির অতশত কঠিন বিষয় না বুঝলেও এই বয়সে এটুকু বুঝেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী থেকে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড-সহ একাধিক প্রকল্প এনেছেন, যা পড়ুয়া থেকে শুরু করে মহিলা এবং আমজনতার কাজে লাগছে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প কোথায়? সৌমালি বলছে…দিদি প্রত্যেক বছর মহালয়ার দিন আমাদের পাড়ায় আসেন চক্ষুদান করতে। সেদিন থেকেই তো আসলে পুজো শুরু। এটা বাড়তি পাওনা।
বিচ্ছিন্ন দুটি ঘটনা৷ আসলে এটাই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে ‘পাবলিক পালস’৷ বৃহস্পতিবার শহর দেখল মমতা আবেগ৷ ঘরের মেয়েকে নিয়ে আবেগ৷ যত বেলা গড়িয়েছে ৬৩, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৭, ৮২ ওয়ার্ডে দেখা গিয়েছে মহিলাদের ভিড়, নানা ভাষাভাষীর ভিড়৷ পাড়ার মেয়েকে আবেগে উজাড় করে দেওয়ার চিহ্ন যেন ভোট যন্ত্রে রেখে যেতে চান তাঁরা৷ একই দৃশ্য মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ও সামশেরগঞ্জে৷ উত্তেজনা তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা ছিল বিরোধীদের৷ কিন্তু জাকির হোসেন কিংবা আমিরুল ইসলাম কেউই সেই প্ররোচনায় পা দিলেন না৷ মাথা ঠান্ডা রেখে ভোট করলেন৷ বুথে বুথে ঘুরলেন৷ এবং ভোটের শেষে বলে গেলেন, মানুষ দিদিকে জেতাতে বদ্ধপরিকর৷ ইভিএমে তার ছাপ পড়বে৷
মিত্র ইনস্টিটিউশন বুথ। যেখানে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়-সহ ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের সকলে ভোট দিতে এসেছেন। অশক্ত শরীরে অন্যের সাহায্যে হুইল চেয়ারে ভোট দিতে এসেছেন অনেকেই৷ তাঁদেরই একজন বললেন, শুধু মমতার ভোট বলে এসেছি৷ কবে আছি, কবে নেই জানি না। এখনও যখন বেঁচে আছি তখন ভোটটা দিতে এলাম মনের জোর নিয়ে। আমাদের ঘরের মেয়েরই তো ভোট৷ তাই আর ঘরে থাকতে পারিনি।
আরও পড়ুন: হাইভোল্টেজ ভবানীপুরে ভিভিআইপিদের ভোটদান
দুর্যোগ ছিল না। যদিও কাজের দিন। তাই মানুষ কাজ সেরে ভোট দিতে গিয়েছেন। সকালের দিকে স্বাভাবিকভাবেই ভবানীপুরে ভোটের হার কম ছিল। যদিও মুর্শিদাবাদের দুই কেন্দ্রে সকাল থেকেই ভোটের লাইনে ভিড় ছিল। কিন্তু বেলা বাড়তেই ভবানীপুরের চিত্রটা অন্যরকম হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভোট দিলেন। ঘড়ির কাঁটা তখন বলছে বিকেল ৩.১৫। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভোট দিলেন ৪.২০ নাগাদ। ভোট কেন্দ্রে মিনিট তিনেক ছিলেন নেত্রী। ভোট নিয়ে কেউই কোনও শব্দ খরচ করেননি। সকাল থেকেই বিজেপি প্রার্থী নানা ধরনের অভিযোগ করে গিয়েছেন কমিশনে। কিন্তু দিনের শেষে বিজেপির ‘এই নাটক’-এর অভিযোগ কমিশন খারিজ করে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল, গোটা ভবানীপুর কেন্দ্র খুঁজে বিজেপির ক্যাম্প অফিস খুঁজতে হয়েছে দূরবিন নিয়ে। রাজনৈতিক মহল বলছে, আসলে হারার আগে হেরে যাওয়ার চিত্রনাট্য পরিষ্কার। সকালে বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায় ফিরহাদ হাকিম ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএমের একটি ক্যাম্প অফিসে গিয়ে গল্পে মাতেন, চাও খান। অন্যদিকে সামশেরগঞ্জে ভোটারদের প্রভাবিত করার ভুয়ো অভিযোগ তুলে দিনের শেষে বেইজ্জত হয়েছে গেরুয়া শিবির। তবে ভোট ঘিরে স্বতঃস্ফূর্ততা চোখে পড়ার মতো ছিল। যা দেখে সকলেই বলেছেন, এটা আসলে মমতা আবেগ।