ত্রিপুরায় বিজেপি’র মুখ বদল হলেও, চরিত্র বদল হয়নি। সদ্যসমাপ্ত রাজ্যের চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ফের সেটা প্রমাণ হল। বল্গাহীন সন্ত্রাস। রেকর্ড রিগিং। গণতন্ত্রের মস্তবড় প্রহসন এই ভোটেও ত্রিপুরাবাসী প্রত্যক্ষ করলেন। চার কেন্দ্রের অধিকাংশ বুথে বিরোধী দলের এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি। তবে, ভোটে পদ্ম শিবিরের সন্ত্রাস দেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ত্রিপুরায় বিজেপির মুষলপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-নিয়ম বদল বিশ্বকাপে, এক দলে ২৬ ফুটবলার
দল যে ক্রমশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলেন গেরুয়া শিবিরের দিল্লির কর্তারা। তাই বিপ্লব দেবকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসানো হয় মানিক সাহাকে। সামনের বছর ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচন। তার আগে জনরোষ থেকে দলকে বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ পরিবর্তনের কৌশল গ্রহণ করে বিজেপি। কিন্তু বৃহস্পতিবার চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে সন্ত্রাস-রিগিংয়ের বহর দেখেই মালুম হচ্ছে, জনগণের প্রতি কোনও আস্থা ত্রিপুরার শাসক দলের নেই। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ বদল করেও বিজেপির স্বস্তি নেই।
অনুন্নয়নের অন্ধকারে থাকা ত্রিপুরার মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে, জোড়াফুল শাসকের আসনে এলে, পশ্চিমবঙ্গের মতো উন্নয়নের জোয়ার বইবে। তৃণমূল কংগ্রেসের এই বার্তা নিয়ে পরপর ত্রিপুরা ছুটে যাচ্ছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। জোড়াফুলের পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল-মিটিংয়ে মানুষের ভিড় বাড়ছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমজনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ভোট প্রচারেও দেখা গিয়েছে। অভিষেকের কর্মসূচিগুলিই তার প্রমাণ।
আরও পড়ুন-নিয়ম বদল বিশ্বকাপে, এক দলে ২৬ ফুটবলার
আর এতেই চোখে সরষে ফুল দেখছে বিজেপি। ত্রিপুরায় ভোটের প্রচার তুঙ্গে উঠতেই তারা নখ-দাঁত বের করে বেপরোয়া আক্রমণ শানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর। নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত জোড়াফুলের নেতা-কর্মীদেরও রেহাই দেয়নি তারা। সীমাহীন সন্ত্রাস চালিয়েছে বিজেপি। আর কেন্দ্রীয় এজেন্সি সিবিআই এবং ইডি-কে লেলিয়ে দিয়েছে অভিষেকের পরিবারের পিছনে।
সিপিএমকে সরিয়ে ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। দীর্ঘদিন রাজ্যে কোনও উন্নয়ন নেই। বেকার যুবক-যুবতীরা দিশাহারা। তারা কর্মহীন। শিল্পের নামগন্ধ নেই। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল শোচনীয়। বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্য শাসনে পুরোপুরি ব্যর্থ। তাই বিজেপি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে আমদানি করেছে মানিক সাহাকে। তাঁর আমলে মানুষের মন পাল্টেছে কি না সেই পরীক্ষার সুযোগ ছিল চারটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব কোনও ঝুঁকি নেয়নি।
আরও পড়ুন-দুরন্তে নিম্নমানের খাবার, বিক্ষোভ
আগরতলা, বড়দোয়ালি, যুবরাজনগর এবং সুরমা বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। এরমধ্যে দুটি সিপিএমের এবং দুটি কেন্দ্র কংগ্রেসের দুর্গ বলে পরিচিত। বড়দোয়ালি কেন্দ্রের প্রার্থী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছিল ত্রিপুরার স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের কন্যা সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কয়েকমাস আগে পুর নির্বাচনেও তিনি জোড়াফুলের প্রার্থী হয়েছিলেন। তখন যা ঘটেছিল এবারও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। বিজেপির সন্ত্রাসের পয়লা টার্গেট ছিলেন সংহিতাই। তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে চরম সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়েছে। ভোটের দিন মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে বহু বুথে ভোটারদের ঘেঁষতেই দেওয়া হয়নি। বিরোধীদের এজেন্ট বসাও ছিল মস্তবড় অপরাধ। বুথে বুথে গেরুয়া সন্ত্রাস পরিচালনা করেছে বাইকবাহিনী। তাদের হাত থেকে নিস্তার পাননি বুকে পেসমেকার লাগানো ৮০ বছরের বৃদ্ধও। তাঁর অপরাধ ছিল, সাহস করে তিনি ভোট দিতে এসেছিলেন। বাদ যায়নি পুলিশ কর্মীও। বিজেপি ক্যাডাররা পুলিশের পেটেও চাকু চালিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিকদেরও পেটানো হয়েছে যত্রতত্র।
আরও পড়ুন-বাম দুর্নীতি, চাকরি গেল ৬১৪ জনের
কয়েকমাস আগে বিজেপি ত্যাগ করে কংগ্রেসে নাম লেখান সুদীপ রায়বর্মন। প্রার্থীও হন। তাঁকেও নির্বাচনের দু’দিন আগে বেদম মারে গেরুয়া ঝান্ডাধারীরা। সুরমা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অর্জুন নমঃশূদ্রের পরিবারকে ভোটের আগের দিন নৃশংসভাবে মারধর করা হয়। একসময় ত্রিপুরায় সিপিএম যে কায়দায় ভোট করত, এখন ক্ষমতা ধরে রাখতে বিজেপি একই কৌশল অবলম্বন করছে।
আরও পড়ুন-ইতিবৃত্তের বিধবারা
ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় চারটি কেন্দ্রের ভোটের পর নিজের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট তুলে ধরেছেন। তাঁর বিশ্লেষণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ত্রিপুরার মানুষ নতুন করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘন ঘন ত্রিপুরা সফরে বিজেপির সাজানো বাগানে ঝড় উঠে গিয়েছে। তারই ফল হল, ভোটে ব্যাপক রিগিং এবং সন্ত্রাস। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, বিজেপির পায়ের তলা থেকে মাটি দ্রুত সরে যাচ্ছে। তাদের ভরসা এখন জনগণ নয়, গুন্ডারা। তারাই বিজেপির ঝান্ডা ধরে ভোটের দিন দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তবে, আসন্ন বিধানসভা ভোটে ত্রিপুরার মানুষ এসব অত্যাচারের যোগ্য জবাব দেবেন।