মহানিষ্ক্রমণের ৮১তম জয়ন্তী। ১২৫তম জন্মজয়ন্তী সমাগত। তবুও রাজধানীর রাজপথে ব্রাত্য নেতাজিকে নিয়ে ট্যাবলো। দিল্লির শাসক দলের বঙ্গ-বিদ্বেষের ট্র্যাডিশন অব্যাহত। এসব করেও ভারতের জনগণমন থেকে, ভারতবাসীর অন্তরের অন্তস্তল থেকে সুভাষচন্দ্রকে মুছে ফেলা যায়নি, যাবে না। লিখছেন নেতাজি গবেষক কেশব ভট্টাচার্য
১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ভোর রাতে (আক্ষরিক অর্থে ১৬ জানুয়ারি, রাত ১ট ৩৫ মিনিটে) আজকের নেতাজি ভবন ছেড়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বেরিয়ে পড়লেন। কেউ জানতে পারল না। প্রায় ন’দিন বাদে ২৬ জানুয়ারি সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ ভেবেছিল সুভাষচন্দ্রকে যদি গৃহবন্দি রাখা যায় তাহলে স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। কথাটাকে ভুল প্রমাণিত করেছিলেন নেতাজি স্বয়ং তাঁর মহানিষ্ক্রমণের মধ্যে দিয়ে।
আরও পড়ুন-নিখরচায় প্লাস্টিক সার্জারি
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে ক্লিমেন্ট এটলি ভারতে এসে অস্থায়ী রাজ্যপাল ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সঙ্গে রাজভবনে দেখা করেন। কথা প্রসঙ্গে, তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকার সুভাষচন্দ্র বসুর ভয়েই ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের আনুগত্যের অভাব, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের আবহ তৈরি করতে পারে। এই ভয়টা তাঁদের বেশি মাত্রায় ছিল। সে তুলনায় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের বিষয়ে তাঁদের আশঙ্কা ছিল ‘minimal’ অর্থাৎ, ন্যূনতম। সে কথাটাও অকপটে স্বীকার করেন এটলি।
১৯২৮-এ কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে জেনারেল অফিসার ইন কমান্ডিং ছিলেন সুভাষচন্দ্র। মতিলাল নেহরু সভাপতি ছিলেন। ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি স্বায়ত্ত্বশাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পূর্ণ স্বরাজের কথা বলেছিলেন।
এর পরের বছর ১৯২৯-এ লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজ বিষয় যা আলোচনা হয়েছিল তাতে তিনি সংশোধনী দিয়েছিলেন এবং ‘parallel government’ বা সমান্তরাল সরকারের দাবি তুলেছিলেন।
আরও পড়ুন-সমস্যার সমাধানে দুয়ারে তৃণমূল কর্মীরা
১৯৩৮-এ হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি জিতলেন। ১৯৩৯-এ গান্ধীজির সঙ্গে মতবিরোধ। সুভাষচন্দ্র পদত্যাগ করলেন এবং ফরোয়ার্ড ব্লক গড়লেন।
হলওয়েল মনুমেন্ট নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর পর সুভাষচন্দ্র গ্রেফতার হলেন। তাঁকে অন্তরিনে রাখা হল। সেখানে বসে তিনি ভেবেছিলেন, বাড়িতে বসে থাকলে এদেশে আর কিছু হবে না।
১৯৩৯ সালেও তিনি parallel government এর কথা বলেছিলেন বারবার। আয়ারল্যান্ডে সিনফেইনরা আন্দোলন করেছিল এবং parallel government হয়েছিল। সুতরাং, তিনিও পাল্টা সরকার করতে চেয়েছিলেন। সেই সরকারের নেতৃত্বে আন্দোলন হবে, যুদ্ধ হবে, সবকিছু হবে। এই পরিকল্পনা ও তাঁর বাস্তবায়নের কাজ ১৯৪০-এ বন্দিদশাতেই তিনি শুরু করেছিলেন। এমন নয় যে হঠাৎ করেই ১৯৪১ এর ১৭ জানুয়ারি (১৬ জানুয়ারি, রাত ১টা ৩৫ নাগাদ) তিনি আচমকা দেশত্যাগ করবেন বলে বেরিয়ে পড়লেন।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ডহারবারে করোনার পজিটিভিটি হার কমছেই
এখনও পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান নিয়ে কোনও তথ্যই কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করেননি। ২০০০-এ বিজেপি সরকার ৩০৪টি ফাইল প্রকাশ করে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র সম্পর্কিত সব গোয়েন্দা ফাইল এখনও প্রকাশ পায়নি। জাপান, জার্মান, আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, চিন, বাংলাদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার পাতার নথি সংরক্ষিত আছে যা ভারত সরকার আনার চেষ্টাই করেননি। এগুলো যদি এত বছরেও না আনা হয়, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে, তাঁর মহানিষ্ক্রমণের বিষয়ে দেশের মানুষ কিছুই জানতে পারবে না। আমাদের কাছে যেটুকু নথি আছে তা আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র!
এই প্রসঙ্গে একটি কথা না বলে পারছি না। সাইবেরিয়ার শহর ওমস্ক ও ইরকুতস্ক -এ গিয়েছিলাম। জানতে পারি ১৯৪৩-এ ১ অক্টোবর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের দূতাবাস ছিল ওমস্কে। ১১টা দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল, তবে সোভিয়েত রাশিয়া দিয়েছিল কি না জানা যায়নি। সোভিয়েত রাশিয়ার অনুমোদন ব্যতীত এখানে দূতাবাস রাখা সম্ভবও ছিল না! আমরা কেজিবির অফিসারদের কাছে নথিগুলো দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, ভারত সরকার যদি সরাসরি এব্যাপারে অনুরোধ বা আর্জি না জানায় তাহলে কোনও তথ্যই দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটা দেশ এই একই কথা বলেছেন। এটাই বাস্তব।
আরও পড়ুন-বাঘ খুঁজতে ৮২টি দলের ৪০০ প্রশিক্ষিত বনকর্মী ৬ দিন তল্লাশি চালাবে বক্সায়
ফলত নেতাজির মহানিষ্ক্রমণ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাই যে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সত্য, তা কিন্তু নয়। সমস্ত নথি সামনে এলে আমরা হয়তো আরও অনেক কিছু জানতে পারব। এখনও পর্যন্ত অনালোকিত ও অনালোচিত নানা বিষয় সামনে আসবে। তাতে নেতাজির পুনর্মূল্যায়ন অন্য মাত্রা পাবে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের সারথি শিশির কুমার বসু একদা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে জানতে চান, নেতাজি কীভাবে কলকাতা থেকে কাবুলে এবং ইউরোপে চলে গেছিলেন, সে বিষয়ে। অর্থাৎ সারথি শিশির বসুরও অর্জুনের তাবৎ রণকৌশল, যুদ্ধ পরিকল্পনার পুরোটা জানা ছিল না।
আসলে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাটাকেই বদলে দিয়েছিল। স্বদেশবাসীর চিরাচরিত চিন্তা পদ্ধতির ভেতরেই এই ঘটনা জাগিয়ে তুলেছিল একটা বিদ্রোহ। দেশের ভেতর যে রক্ত-কলুষ শান-বাঁধানো পথে চলছিল অহিংস কর্মকাণ্ডে ভরা একটা স্বাধীনতা জয়ের প্রয়াস, ভারতীয় জনসাধারণের ভেতরে বহুদিন থেকেই তার বিরুদ্ধে জাগছিল বিদ্রোহ। সশস্ত্র সংগ্রামের বোমা বন্দুকে আমরা শুনতে পাই সেই বিদ্রোহের একটা সুর, সেই বিদ্রোহের অপর একটি সুরের রক্তমাংসে মূর্ত হয়ে ওঠার তাগিদ দেখা গিয়েছিল নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের মতো কর্মকাণ্ডের মধ্যে।
আরও পড়ুন-বুলবুলির জমাটি লড়াই
সেই মহানিষ্ক্রমণের পর ৮০ বছর কেটে গেল। এই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। রাজধানীর রাজপথে নেতাজিকে নিয়ে ট্যাবলো নামাতে চাইছে না মোদি-সরকার। অর্থাৎ, নেতাজিকে নিয়ে দিল্লির অ্যালার্জির ট্যাডিশনে আজও ভাটা পড়েনি।
কিন্তু এসব করে কি আর নেতাজিকে জনমানস থেকে মুছে দেওয়া যায়? এই অনির্বাণ বহ্নিশিখা ভারতমনে চিরকাল থেকে যাবে।