ফসফোটেমিয়া

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তড়িৎবিশ্লেষ্য ফসফেট মূলকের স্বাভাবিক উপস্থিতি কম বা বেশি হলেই একেবারে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে মানবদেহ; তার উপর এটা যদি আবার বংশগত হয় তাহলে তো বিপদের শেষ নেই! লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

মানবদেহে ইলেক্ট্রোলাইটস
মা খুব করে শেখাতেন— এক গ্লাস জল নিয়ে/ এক চামচ চিনি দিয়ে/ কয়েক ফোঁটা লেবুর রসে/ এক চিমটি নুনের কষে স্যালাইনের আছে গুণ। সামান্য বমি, পায়খানা কিংবা জ্বর হলেই খাও স্যালাইন! তার উপর গ্রীষ্মকালে তো রয়েছেই আখের গুড়ের শরবত! আসলে মা সবসময় আমাদের মনে করিয়ে দিতেন, ওইসব পান করার ফলে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রোলাইটস বা তড়িৎবিশ্লেষ্য পদার্থের ঘাটতি পূরণ হয়; ফলে শরীর থাকে সুস্থ।

আরও পড়ুন-সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং শুরু সিবিএসই-র

মানবদেহের এই প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রোলাইটস হল সাধারণত রাসায়নিক খনিজ উপাদান বা তার সমষ্টি, যা জলে দ্রবীভূত হয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি বহন করে ও শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। আমরা দৈনিক যে খাবার ও পানীয় গ্রহণ করি সেখান থেকেই শরীর তার উপযোগী ইলেক্ট্রোলাইটস-এর জোগান পায়। ঠিক এইরকম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রোলাইট হলো ফসফরাস; তবে ফসফরাস নামের এই মৌলিক রাসায়নিকটিকে মুক্ত অবস্থায় আমাদের দেহে পাওয়া যায় না; এটি ফসফেট মূলক রূপে বিভিন্ন জৈব এবং অজৈব যৌগের অংশ হিসেবে উপস্থিত।

আরও পড়ুন-মনরেগা নিয়ে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে চিঠি তৃণমূলের, সাংসদ চাইলেন একাধিক প্রশ্নের উত্তর

ফসফেট মূলক
ফসফেট হল একটি ফসফরাস ঘটিত আম্লিক খনিজ রাসায়নিক লবণ বিশেষ, যা দেহের অন্তঃস্থিত মেরুকৃত দ্রাবক, বিশেষ করে জলের মধ্যে সহজেই দ্রবীভূত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য ইলেক্ট্রোলাইটস-এর মতোই ফসফেট মূলকও আমাদের দেহের হোমিওস্ট্যাসিস বা জীবন্ত দেহের অভ্যন্তরীণ শারীরিক, রাসায়নিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে রক্ষা করে। হৃদস্পন্দন, স্নায়বিক কার্যকলাপ, দৈহিক তরলের সাম্য, দেহ-মধ্যে সর্বত্র প্রাণবায়ু অক্সিজেনের ডেলিভারি এবং ক্ষার-অম্ল সাম্য— এ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে ইলেক্ট্রোলাইটস।

আরও পড়ুন-নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্কুলে হাজিরা নিয়ে নিয়মে বদল

আমাদের শরীরে ফসফরাস
জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আমরা যেসব প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, শাকসবজি, ডালশস্য, বাদাম, ডিম, মাছ, পোল্ট্রির ও পশুর মাংস, দুগ্ধজাত, বেকারিজাত ও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ করে থাকি, তার মধ্যে দিয়েই আমাদের শরীরে ফসফরাস প্রবেশ করে। এ ছাড়াও আমরা অতিরিক্ত সংযোজন হিসেবে নানাভাবে ফসফরিক অ্যাসিড, সোডিয়াম ফসফেট ও সোডিয়াম পলিফসফেট হিসেবেও এটি গ্রহণ করি।
প্রাথমিকভাবে ফসফরাস আমাদের দেহে ফসফেট মূলক রূপে হাড়, দাঁত, ডিএনএ ও আরএনএ-এর মূল উপাদান হিসেবে বহির্কোষীয় ম্যাট্রিক্সে কেলাসাকারে উপস্থিত থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক মনুষ্যদেহে দৈনিক গৃহীত ফসফরাসের পরিমাণ প্রায় ১০০০ মিলিগ্রাম। গৃহীত ফসফরাসের প্রায় ৯০ শতাংশই ক্ষুদ্রান্তের জেজুনাম দ্বারা শোষিত হয়। শরীরের মধ্যে আবার এই জমাকৃত ফসফরাসের প্রায় ৯০ শতাংশই কিডনি নির্বাহ করে এবং বাকিটা পরিপাকনালি নির্বাহ করে।

আরও পড়ুন-কলকাতায় ১০ বছরের মেয়ের শরীরে ছোঁয়াচে ব্যাকটেরিয়া

মনুষ্য শরীরে ফসফরাসের গুরুত্ব
আমাদের সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রোলাইটস-এর মধ্যে ক্যালসিয়ামের পরেই ফসফরাসের স্থান। ফসফরাস ফসফোলিপিড হিসেবে সঞ্চিত থাকে। আমাদের দেহের চর্বিহীন মাংস পিণ্ডের প্রায় ১-১.৪ শতাংশ ফসফরাস দিয়েই তৈরি; হাড় ও দাঁতের প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং রক্ত ও কোমল কোষের প্রায় ১৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এই ফসফরাস। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও লিপিডের সঙ্গে মিশে হাড়ের হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট কেলাসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস পাওয়া যায়।
ফসফেট মূলক আমাদের শরীরে কোষের ঝিল্লি ও তার গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি কোষের মধ্যে বিভিন্ন উৎসেচকধর্মী প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী। যেমন, ফসফোরাইলেশন অব প্রোটিন, গ্লাইকোলাইসিস এবং অ্যামোনিয়াজেনেসিস প্রভৃতি আন্তঃকোষীয় বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ফসফেট। এই মূলক মানবদেহের মূখ্য শক্তির উৎসদের মধ্যে অন্যতম এবং এটি কোষের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। জিনের প্রতিস্থাপনে ও অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট নামে একটি হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে এবং কোষের বাইরের অঞ্চলে দেহতরলের স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রা বজায় রাখে।

আরও পড়ুন-পর্যটনের নয়া দিশা বেঙ্গল সাফারি

ফসফোটেমিয়া
মানবদেহে রক্তের মধ্যে ফসফরাস অর্থাৎ ফসফেট মূলকের স্বাভাবিক উপস্থিতিকেই ফসফোটেমিয়া বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেহের রক্ত বা সিরামে উপস্থিত ফসফেট মূলকের স্বাভাবিক ঘনত্ব প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটারে প্রায় ২.৫-৪.৫ মিলিগ্রাম এবং শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটারে প্রায় ৪-৭ মিলিগ্রাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশানুসারে। এখন কোনও কারণে এই স্বাভাবিক মাত্রার কম-বেশি হলেই দৈহিক, স্নায়বিক, রাসায়নিক, সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়; মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে থাকেন; জীবনে নেমে আসে অন্ধকার!
রক্তে ফসফেটের পরিমাণ তার স্বাভাবিক মাত্রার ঊর্ধ্বসীমার চেয়ে বেশি হলে হয় হাইপারফসফোটেমিয়া এবং ফসফেটের পরিমাণ তার স্বাভাবিক মাত্রার নিম্নসীমার চেয়ে কমে গেলে হয়ে থাকে হাইপোফসফোটেমিয়া। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গৃহীত খাদ্যের মধ্যে যদি ফসফরাসের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে হাইপারফসফোটেমিয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়াও দীর্ঘস্থায়ী কিডনির সমস্যা, শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়া, অত্যধিক মদ্যপান, চূড়ান্ত পর্যায়ের মধুমেহ ও এমনকী সেপসিস বা কোনও দীর্ঘস্থায়ী জীবাণুদূষণ থেকেও হাইপারফসফোটেমিয়া হতে পারে। এর ফলে রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন; এ ছাড়াও দেহের চামড়া শুষ্ক, ফাটা ও আঁশযুক্ত হয়ে যায়, পেশির খিঁচুনি দেখা দিতে পারে ও মারাত্মক পর্যায়ে গেলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

আরও পড়ুন-জয়চণ্ডী পাহাড়ে উৎসবের আমেজে পর্যটকের ঢল

অন্যদিকে, দীর্ঘদিন যাবৎ মদ্যপান, অপুষ্টি, ডায়াবেটিস মেলিটাস, দীর্ঘস্থায়ী বমি, ঘনঘন খাদ্যগ্রহণ ও বহুদিন ধরে ভেন্টিলেশনে থাকলে ফসফেটের পরিমাণ কমে গিয়ে হাইপোফসফোটেমিয়া হয়ে থাকে। এর ফলে আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শ্বাসের গন্ধ ফলের মতো হয়, ক্ষুধামান্দ্য, মনোযোগের অভাব দেখা দেয়, শ্বাসকষ্ট হয়, মাংসপেশিগুলো ভেঙে যায় এবং যন্ত্রণা হয়, প্রস্রাবের রঙ হয় চায়ের মতো এবং কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে; রোগী অনেকসময় কোমায় চলে যায়।
ফ্যামিলিয়াল হাইপোফসফোটেমিয়া
উপরি উক্ত দু-ক্ষেত্রে আমাদের পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস অনেকাংশে দায়ী হলেও শরীরের মধ্যে লিঙ্গ-নির্ণায়ক গুণসূত্র বা এক্স-ক্রোমোজোমের সমস্যাযুক্ত কারণে যে ‘ফ্যামিলিয়াল হাইপোফসফোটেমিয়া’ হয়ে থাকে, তা দুরারোগ্য এবং বংশানুক্রমিক। খুবই বিরল এই রোগটি সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়, এর ফলে কিডনির ফসফরাস নির্বাহ ক্ষমতা কমে যায় এবং শরীরের মধ্যে ভিটামিন ডি-এর বিপাকক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। আক্রান্ত শিশুটির দেহের হাড় ধনুকের মতো বেঁকে যায়, রিকেট রোগে আক্রান্ত হয়। একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পঙ্গু হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেন না, তুলোধোনা ডেপুটি স্পিকারের, মুখ্যমন্ত্রীর গ্যারান্টি খাঁটি, উপকৃত মানুষ

জিনগত হোক বা অন্য কারণে, দেহে ফসফেটের মাত্রা কমবেশি হলেই ভিটামিন ডি ও প্যারাথাইরয়েড হরমোনগুলোর বিপাক ঠিকঠাক হয় না, ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যায় যা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এই রোগের লক্ষণ প্রকট নয় বলে এর শনাক্তকরণে অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই সামান্য কিছু শারীরিক অসুবিধা হলেই একটি সহজ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে।

Latest article