সাচ্চা গণতান্ত্রিক পরিবেশের অন্যতম অনুষঙ্গ হল নাগরিকের কাঙ্ক্ষিত জীবনচর্যার জন্য এবং সে যে মূল্যবোধে আস্থা রাখে, সেটার অস্তিত্ব নিশ্চিত যাতে হয় সেজন্য নাগরিকের যথাযথ ক্ষমতায়ন। অর্থাৎ, প্রত্যেক নাগরিকেরা সশক্তীকরণ এমনভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে যাতে সে মূল্যবোধে বিশ্বাসী সেই মূল্যবোধেই থিতু হতে পারে। মূল্যবোধের প্রশ্নে যেন তাকে আপস করতে না হয়। একই ভাবে তাকে এমন ভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন করতে হবে যাতে সে যেমনটা চায় তেমন ভাবে জীবন কাটাতে সমর্থ হয়।
আরও পড়ুন-বাড়ি থেকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স
এটাকে যদি আদর্শ গণতন্ত্রের মাপকাঠি ধরি আর সেই মাপকাঠিতে ভারতের ৭৫ বছর আগে পাওয়া আর ৭৬তম বছরে পা-দেওয়া স্বাধীনতাকে বিচার করি তাহলে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে।
১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এ নেহরু প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘আমরা কোনদিকে যাব আর কী-ইবা চেষ্টা করব?” (Whither do we go and what shall be our endeavour?)
এই প্রশ্নের উত্তর নেহরু নিজেই দিয়েছিলেন। একযোগে দিশা এবং বিস্তারিত কার্যসূচি প্রকাশ করেছিলেন স্বকীয় ভঙ্গিতে। জানিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য, কৃষক-শ্রমিককে স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য, নিরক্ষরতা ও অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করার জন্য, দারিদ্র্যর অবসান ঘটানোর জন্য, একটি সমৃদ্ধশালী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশ গড়ে তোলার জন্য এবং সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য, প্রত্যেক নরনারীর জন্য ন্যায় ও জীবনের পূর্ণতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যা যা করার সেটাই আমাদের করতে হবে।
আরও পড়ুন-বিশ্বকর্মা নিয়ে বিজেপির মিথ্যাচার, পাল্টা জবাব দিল তৃণমূল কংগ্রেস
এ কথাগুলো বলার আগের দিনই নেহরু গণপরিষদে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ভারতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভারতকে সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের পথ দেখাতে পারবে কি না।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায়, ভারতে বৈষম্য পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এদেশে রয়েছে, সেকথা সম্প্রতি বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে। যে-কোনও কৌম গোষ্ঠীতে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি অপুষ্টিতে ভোগে। অনেক বেশি সাক্ষরতার আলোকহীন জনসংখ্যায়। তাদের শতাংশ যাই হোক না কেন আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের নিরিখে তারা সদা পিছিয়ে। অথচ তাদের ভোটদানের অধিকারে কোনও বৈষম্য নেই। তাদেরও প্রত্যেকের একটা করে ভোট প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মতোই। শাসনব্যবস্থার শীর্ষপদে মহিলাদের বিশেষ দেখতে পাওয়া যায় না। এটা সত্যি। আবার এটাও সত্যি শ্রমজীবী মহলেও নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে কম মজুরি পায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার কম। সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে তারা ঘরের বাইরে কাজ করতে যাওয়ার সুযোগ পায় না অনেক ক্ষেত্রেই।
আরও পড়ুন-ছন্দে কুমোরপাড়া, প্রতিমা নির্মাণে মগ্ন মৃৎশিল্পীরা
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র্য, এই তিনটে বিষয়ে তো ভারতের দুরবস্থার কথা নতুন করে বলার বিষয় নয়। এই তিনটে ক্ষেত্রে চিনের হাল ভারতের চেয়ে অনেক, অনেক ভাল, তবু, তবুও মানবোন্নয়নের সূচকে ভারত যে চিনের চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে, তার কারণ গণতন্ত্র। চিনে গণতন্ত্রের কণ্ঠরুদ্ধ। ভারতে অবস্থাটা ততটা খারাপ নয়। এই বিচারেই অপুষ্টি, দারিদ্র্য, অশিক্ষার প্রকোপে পড়া ভারত মানবোন্নয়ন সূচকে চিনের আগে।
ভারতে কিন্তু সব প্রদেশের চেহারা, সব প্রদেশের অবস্থা একরকম নয়। এক এক রাজ্যে এক এক রকম অবস্থা। ২০২১-এ নীতি আয়োগের প্রতিবেদনেই তা ভালমতোই প্রতিফলিত। যেমন, বিহারে যেখানে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে সেখানে কেরলে কেবল এক শতাংশ মানুষকে দরিদ্র বলা চলে। জাতীয়স্তরে বেকারত্ব যখন বেলাগাম, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সে তুলনায় ভাল।
সারা দেশে আইনকানুন অভিন্ন। তা সত্ত্বেও আর্থসামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে এই বৈষম্য খুবই আশ্চর্যজনক।
আবার, আশ্চর্য হওয়ার তেমন কারণও নেই।
আরও পড়ুন-পুলিশের ‘নবদিশা’, শেখাবে পড়ুয়াদের
যেহেতু দেশের বিভিন্ন অংশে নাগরিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমানরা আক্রান্ত ও বঞ্চিত হচ্ছেন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাঁরা দেশের বিভিন্ন অংশে, আইনকে হাতিয়ার করে সর্বপ্রকার বিঘ্ন নিশ্চিত করা হচ্ছে, সেহেতু দেশের বিভিন্ন অংশে মানবোন্নয়ন সূচকের হার, অর্থনৈতিক বিকাশের হার বেশ কম।
জীবনের অন্তিমে নেহরু বিলাপ করতেন এই ভেবে যে, ভারত কৃষিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর— আমরা বিলাপ করছি এই অনুভবে যে, ৭৫টা বছর কেটে গেলেও আমাদের গণতন্ত্র স্বনির্ভরতা অর্জন করে উঠতে পারল না। আমরা হয়তো ভেবেছিলাম, ধর্মাশ্রিত রাজনীতির বেসাতি যাঁরা করেন তাঁদের হাতে দেশের রাজনৈতিক ভাগ্য সমর্পণ করলে দেশটা ভাল থাকবে। তা যে হয়নি সেটা এখন স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে। ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ৭৫ বছরে দেশের অর্থনৈতিক নীতির সুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছে, কিন্তু তাঁরা বোধহয় গণতন্ত্রকে তেমনভাবে জোরালো রক্ষাকবচ দিতে পারেননি বলেই এই অবস্থা, এমন অভিমত অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক পুলাপরে বালকৃষ্ণনের মতো অনেকেরই।
আরও পড়ুন-ফলের গাড়িতে চোরাই কয়লা
অনেকেই আতঙ্কিত, ভারতে নাগরিক স্বাধীনতার প্রহরের বুঝি অবসান ঘটল। এমন আশঙ্কা অমূলক। আমাদের ভোটাধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। আগামী ২০২৪-এ শুধু বুঝিয়ে দিতে হবে, আমরা ঠিক কী চাই।
সামনে কঠিন লড়াই।
বিভ্রান্ত না হয়ে ইভিএম-এ সঠিক বোতাম টিপলেই খতম হবে এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী মোদি জমানা।