সবার ঘরে জ্বলুক দীপাবলির আলো

সদ্য-অতিক্রান্ত আলোর উৎসব। তারই নিভু-নিভু আলোয় এখনও দীপ্র ভারত-আত্মার নিজস্ব সংহতির শিখা, সম্প্রীতির প্রদীপ। দ্বেষহীন উৎসবের বর্ণময়তা। অর্বাচীন কালে যারা ভারতের সত্যিকার ইতিহাসকে ঘুলিয়ে, ভুলিয়ে দিতে উদ্যোগী, তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলম ধরলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

‘I do not like the commercialization of festivals, be it Dewali or Christmas. For me, Diwali is all about the victory of good over evil, and victory of truth and justice.’
আমি কোনও উৎসবেরই বাণিজ্যিকীকরণ পছন্দ করি না, সে দেওয়ালি হোক বা খ্রিস্টমাস। আমার কাছে দেওয়ালি অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়। সত্য আর ন্যায়ের জয় বই অন্য কিছু নয়। কথাগুলো যাঁর তিনি ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দু নন। জন্মসূত্রে ভারতীয়ও নন। আমেরিকায় জন্ম। কাজের সূত্রে নয়াদিল্লিতে আসা। কোরিওগ্রাফার এবং ভারতনাট্যমের শিল্পী। নাম জাস্টিন ম্যাকার্থি।
তাঁর স্পষ্ট অভিমত, দীপাবলি যে-কোনও ধর্মের মানুষ পালন করতে পারেন, এমনকী ধর্মবিহীন নাস্তিকেরও আনন্দ উদযাপন হতে পারে দীপাবলি। হিন্দুত্ব বিদ্বেষে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের আইকন হয়ে ওঠার শতাধিক বর্ষ আগে থেকেই রামকে ভক্তি করতেন, রামে আস্থা রাখতেন, রামকে পুজো করতেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁরা মানতেন, বিশ্বাস করতেন, শ্রীরামই হলেন মর্যাদা— পুরুষোত্তম। তিনিই ধর্মকে ধারণ করেন, ধর্ম তাঁকে আশ্রয় করেই প্রাণবান থাকে। এই ধর্মের পালন মানে রাবণবধ নয়। রাবণ তো বাইরের শত্রু। বহিরঙ্গের বিরোধী। আসল তো অন্তরঙ্গের শত্রু সংহার। সেই, অন্তস্তলবাসী শত্রু হল শ্লাঘা, অহংকার, আত্মাহংকার।
দেবদূত পট্টনায়কের মতো মিথ-চর্চাকারীরা বলেন, কোনও নির্দিষ্ট কাল বা স্থানের বেষ্টনীতে শ্রীরামচন্দ্রকে আবদ্ধ রাখা যায় না। রামের শাসনকালে একটি সুসংহত রাজ্য গড়ে উঠেছিল ন্যায়ের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, সুখস্বপ্নের বাস্তব রূপ হল সেই রামরাজ্য। এ-জন্যই, চোদ্দো বছর বাদে রাম যখন বনবাস পালনের পর স্বদেশে প্রত্যাগমন করলেন, তখন মানুষ— সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ— তাদের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় জ্বালিয়েছিল প্রদীপ ঘরে ঘরে, পালিত হয়েছিল দীপাবলি।
কয়েক বছর আগেও, ভারতের আনাচে কানাচে ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির লোকজন বিদ্বেষের চারা, বিভাজনের বাগান তৈরি করার আগে অবধি, হিন্দু মহল্লায় মহল্লায়, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পাড়ায় পাড়ায়, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বড়রা প্রদীপ জ্বালাত দীপাবলির রাতে, ছোটরা মাতত বাজির আনন্দে। মুসলমানদের মসজিদের গায়ে, পাঁচিলে বা বারান্দায়, হিন্দুরা প্রদীপ কিংবা মোমবাতি ওই দিন জ্বালালে, মসজিদের ভেতর থেকে কোনও আপত্তি আসত না। লিখছেন জিয়া উস সালাম। মুসলমান ধর্মাবলম্বী এই মানুষটার বক্তব্য, দীপাবলিতে দীপ জ্বালানো নিয়ে কোনও অবাঞ্ছিত স্মৃতি তাঁর নেই, কারণ মানুষ তখন অন্তরের আলো নিয়ে বেশি সংবেদনশীল ছিল।
এই আবহে জাস্টিন ম্যাকার্থিও দীপাবলি পালন করেছেন আলোর উৎসব হিসেবে। তাঁর মনের মণিকোঠায় জাগরুক, একটি ট্রেনযাত্রার স্মৃতি। চেন্নাই থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন সেবার দীপাবলির সময়। ট্রেনে যেতে যেতে দেখলেন মথুরার কাছে, রেল লাইনের ধারের বাড়িগুলোতে প্রদীপ জ্বলছে শয়ে শয়ে। চার দশক আগে ওই অঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন গিয়ে পৌঁছয়নি। নিশুতি রাতে প্রদীপের শিখায় অন্ধকার বিমোচনের সেই স্মৃতি আজও ম্যাকার্থির হৃদয়পটে উজ্জ্বল।
মেয়েবেলাটা লখনউতে কেটেছিল শিরিন মুসভির। ইতিহাসবিদ এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। লখনউতে থাকতেন মুসলমান মহল্লায়। সেখানে একটা অ-মুসলমান পরিবার বাস করত। তারা ছিল সোনার বেনে। তবু, অহিন্দু-অধ্যুষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও, সেই মহল্লায় দীপাবলির রাতে, বাড়ির মেহরাবে মেহরাবে জ্বলত দিয়া। দেওয়ালিতে (Diwali) নয়া পোশাক পরার রীতি ছিল সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ভেতরেও। দেওয়ালি, ইদ আর হোলি— এই তিন উৎসব হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একযোগে পালনের রেওয়াজ ছিল। আলিগড়ে এসেও সেই অভ্যাসে ছেদ টানেননি শিরিন মুসভি। এখন তাঁর বয়স প্রায় ৭৫ বছর।
আজও তাঁর মনে পড়ে একবার কলেজ ফাংশানের কথা। সেটা ছিল তুলসীদাস জয়ন্তী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বেগম আলি জাহির। কলেজের সভাপতি ছিলেন একজন হিন্দু মহিলা। যথাসময়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। তাই মঞ্চে উঠে তুলসীদাসের ছবিতে আরতি করার ভার পড়েছিল শিরিন মুসভি আর তাঁর বান্ধবী জুবেইদার ওপর।
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! মুঘল জমানা থেকে এমনটা হয়ে আসছে। হিন্দুদের দীপাবলিতে অ-হিন্দুদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

আরও পড়ুন- ভোগ রেঁধে মাতৃ আরাধনায় মুখ্যমন্ত্রী

দিল্লির বাদশা তখন মুহম্মদ শাহ রঙ্গিলা (১৭১৯-১৭৪৮)। লালকেল্লাকে প্রদীপ দিয়ে সাজানোর রেওয়াজ ছিল তখন দীপাবলিতে। দেওয়ালিকে (Diwali) বলা হত জেশন-এ চিরাগ। ষোড়শ শতকে আকবর বাদশার জমানা থেকে এই প্রথা চলে আসছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের আমলে এই উৎসব পালন অন্য মাত্রা লাভ করেছিল। কেবল উচ্চবংশীয় বাদশাহ অমাত্যরা নন, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চাষাভুষোরাও এই উৎসবে আতশবাজি ফাটাত। অনুমান, তখন থেকেই শবে-এ-বরাত পরবে বাজি ফাটানোর প্রথা চলে আসছে।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেন— ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। ধর্মরেখার বিভাজন বিলোপ করে সেই উৎসব পালনের মেজাজ আবার ফিরে পাক আমাদের দেশ। এটুকুই আজকের প্রার্থনা।

Latest article